রুয়ান্ডার কিগালি যা পারে, ঢাকা কেন পারে না

রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালি, আফ্রিকার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর।ছবি: রয়টার্স

মাসখানেক আগে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিশ্বে বসবাসযোগ্য শহরগুলোর একটা তালিকা প্রকাশ করেছে। সে তালিকায় ঢাকা শহরের অবস্থান হয়েছে নিচের দিক থেকে চার নম্বর। অর্থাৎ আমাদের প্রিয় ঢাকা শহর বসবাসের প্রায় অযোগ্য একটি শহর। নিচের দিক থেকে প্রিয় ঢাকার শহরের অবস্থা চার নম্বরে আবিষ্কার করার পর বারবার আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডার কথা মনে হচ্ছিল। দেশটির রাজধানী কিগালি। আচ্ছা, আমাদের কি জানা আছে, কিগালি হচ্ছে আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে পরিষ্কার শহর? শহরটি এতই পরিষ্কার, এটি এখন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে ইউরোপ-আমেরিকার যেকোনো শহরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অবস্থায় পৌঁছে গেছে।

রুয়ান্ডা তো সেই দেশ, যারা মাত্র দেড় দশক আগেও নিজেরা নিজেরা যুদ্ধ করছিল। হুতু আর তুতসিদের মধ্যে কী ভয়ংকর সংঘাত হয়েছিল তা আমাদের অনেকের জানা। সেই রুয়ান্ডার রাজধানীকে এখন বলা হয় আফ্রিকার সিঙ্গাপুর। তো কীভাবে সম্ভব হলো? কিগালি শহর কি সব সময় এমন ছিল?

মাত্র ১২ বছর আগেও কিগালি ছিল আফ্রিকার অন্য শহরগুলোর মতোই অগোছালো এবং অপরিষ্কার। একটা সময় দেশটির সরকার সিদ্ধান্ত নিল পুরো শহরকে (আসলে পুরো দেশকে) তারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফেলবে। শহরের সব বস্তি ভেঙে ফেলা হলো। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হলো, তাদের আর্থিক সাহায্য দেওয়া হলো। শুধু তা-ই নয়, তাদের জন্য ওই শহরেই অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক তৈরি করা হলো। তারা সেখানেই এখন থাকে।

আমরা কি রুয়ান্ডার উদাহরণটা কাজে লাগাতে পারি না? এর জন্য ধনী দেশ হওয়ার দরকার নেই। অনেক সুযোগ-সুবিধার দরকার নেই। স্রেফ দরকার নীতিনির্ধারকদের সঠিক নীতি এবং সেগুলো বাস্তবে প্রয়োগ করা। রুয়ান্ডা পারলে আমরা পারব না কেন?

শহরের সব রাস্তাঘাট নতুন করে ঢেলে সাজানো হলো। ট্রাফিক সিস্টেম নতুন করে তৈরি করা হলো। রাস্তাগুলোয় নতুন সাইন বসানো হলো। শুধু এটা করেই দেশটির সরকার বসে থাকেনি; সাধারণ জনগণ যাতে এই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন প্রক্রিয়ার একটা অংশ হতে পারে, এ জন্য ‘কমিউনিটি ক্লিনিং’ প্রোগ্রাম চালু করা হলো। প্রতি মাসের শেষ বৃহস্পতিবার প্রতিটি কমিউনিটির সদস্যকে নিজ এলাকা পরিষ্কার করতে হবে। আবার ভেবে বসবেন না, এটা স্বেচ্ছাশ্রম বা এ ধরনের কিছু! এ কাজ দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক। এমনকি দেশের সব মন্ত্রী-এমপি-প্রেসিডেন্টও প্রতি মাসের শেষ বৃহস্পতিবার রাস্তায় বের হয়ে নিজ এলাকা পরিষ্কার করতে বাধ্য।

পুরো দেশ মাত্র ১২ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ বদলে গেছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে। কিগালি শহরের কোনো ছবি কিংবা ভিডিও দেখলে আপনার মনে হবে এক্ষুনি গিয়ে ঘুরে আসি। আমরা হয়তো ভাবতে পারি, এতে নিশ্চয়ই অনেক টাকা লেগেছে এবং তারা নিশ্চয়ই অনেক ধনী। রুয়ান্ডার মাথাপিছু আয় মাত্র ৮৮৩ মার্কিন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ডলারের বেশি। অথচ বসবাসের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট শহরগুলোর একটি হচ্ছে ঢাকা শহর।

আমরা কি রুয়ান্ডার উদাহরণটা কাজে লাগাতে পারি না? এর জন্য ধনী দেশ হওয়ার দরকার নেই। অনেক সুযোগ-সুবিধার দরকার নেই। স্রেফ দরকার নীতিনির্ধারকদের সঠিক নীতি এবং সেগুলো বাস্তবে প্রয়োগ করা। রুয়ান্ডা পারলে আমরা পারব না কেন? এমন যদি হতো, পুরো এশিয়ার না হোক, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হয়ে গেছি!

আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে প্রতিদিন কত রকম সংবাদ শুনতে হয়। যার বেশির ভাগই নেতিবাচক। হাসপাতালে ডাক্তার নেই। ডাক্তার থাকলেও ভালো চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই। ওষুধ নেই ইত্যাদি আরও হাজারটা সমস্যা আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায়। স্বাস্থ্যব্যবস্থা আমাদের মৌলিক চাহিদাগুলোর একটি। যেটা পাওয়ার অধিকার সবার আছে।

আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার চিত্র মনে হলে প্রায়ই ক্যারিবীয় দেশ কিউবার কথা মনে হয়। কোভিড পরিস্থিতিতে হয়তো দেশটি এখন কিছুটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে সেখানে আন্দোলনও হয়েছে। তবে দেশটির স্বাস্থ্যব্যবস্থা দৃষ্টান্তমূলক ও অনুকরণীয়। আর্থিক অবস্থায় খুব একটা ভালো না হওয়া সত্ত্বেও দেশটিতে জনসংখ্যা অনুপাতে ডাক্তারের সংখ্যা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য প্রায় ৬৮ জন ডাক্তার আছে তাদের। যেটি পুরো পৃথিবীতেই তৃতীয়। দেশটি চিকিৎসাব্যবস্থা পুরোপুরি ফ্রি। কোথাও কোনো বেসরকারি হাসপাতাল নেই। গ্রামাঞ্চলে একদম কমিউনিটি পর্যায়ে সবাই বিনা খরচে একই রকম চিকিৎসা পায়। অর্থাৎ গ্রাম ও শহরের চিকিৎসাব্যবস্থায় তেমন কোনো ফারাক নেই। কিউবা কিন্তু প্রতিবছর অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে ডাক্তারের জোগান দিয়ে থাকে। কিউবা তো কোনো ধনী দেশ নয়। ওরা পারলে আমরা কেন পারব না?

এমন যদি হতো, আমরা রুয়ান্ডার উদাহরণ কাজে লাগিয়ে আমাদের ঢাকা শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফেলেছি। এমন যদি হতো, আমরা কিউবার উদাহরণ কাজে লা্গিরয়ে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে উন্নত করে ফেলেছি। এমন যদি হতো, পাশের দেশ ভারতের উদাহরণ কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশ্বমানের করে ফেলেছি।

এমন কি হতে পারে না যে আমাদের দেশেও জনসংখ্যা অনুপাতে চিকিৎসকের সংখ্যা যথেষ্ট। সেই চিকিৎসকেরা সঠিক চিকিৎসা দিচ্ছেন। আমাদের কাউকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার চিন্তা করতে হচ্ছে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অনেক আধুনিক হয়ে গেছে। স্কুল পর্যায়ে সুন্দরবন থেকে বান্দরবান, সবাই এক রকম শিক্ষা পাচ্ছে। এরপর স্কুল পার হয়ে ছাত্রছাত্রীরা এমন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, যার ফলে পৃথিবীর নানান দেশে তারা স্কিলড হিসেবে চাকরি করার জন্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়বে এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে।

পাশের দেশ ভারত তো তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে একটা অবস্থায় ঠিকই নিয়ে যেতে পেরেছে। প্রতিবছর দেশটি মেধাবী গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে, সেই সঙ্গে নানান বিষয়ে পারদর্শী ছাত্রছাত্রী, যারা কেবল নিজ দেশ নয়, পৃথিবীর নানান দেশে চাকরি করছে। নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা তো খুব শক্তিশালী নয়। মাথাপিছু জিডিপিতে নাকি বাংলাদেশ ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে। তাহলে কেন আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ভালো একটা অবস্থায় নিতে পারছি না?

এমন যদি হতো, আমরা রুয়ান্ডার উদাহরণ কাজে লাগিয়ে আমাদের ঢাকা শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফেলেছি। এমন যদি হতো, আমরা কিউবার উদাহরণ কাজে লাগিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে উন্নত করে ফেলেছি। নেই সুচিকিৎসা পাওয়ার জন্য হাহাকার। এমন যদি হতো, পাশের দেশ ভারতের উদাহরণ কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশ্বমানের করে ফেলেছি। যেখান থেকে ছেলেমেয়েরা শুধু নিজ দেশে নয়, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে চাকরি পাচ্ছে এবং নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। এমন স্বপ্ন পূরণের কাজটি কি খুব কঠিন?

ড. আমিনুল ইসলাম শিক্ষক, ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড ইনোভেশন বিভাগ, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি