রূপপুরের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য কত হতে পারে?

নির্মাণাধীন রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র, পাবনা
ছবি: প্রথম আলো

নির্মাণাধীন রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ইউনিটপ্রতি (কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুতের উৎপাদন মূল্য নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক রয়েছে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করে প্রকৃত মূল্যের কথা কাউকে বলতে দেখা যায়নি। আর্থিক ও কারিগরি দিক বিবেচনায় দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মেগা প্রকল্প রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ কেন্দ্র থেকে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন মূল্য কী রকম হতে পারে, তার সম্ভাব্যতা মূল্যায়ন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

রূপপুর প্রকল্প থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ভিভিউআর-১২০০ মডেলের দুটি ইউনিট থেকে এ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে রাশিয়া শতকরা ৯০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১১ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করছে। এ বিনিয়োগের শর্ত হচ্ছে, মূল বিনিয়োগসহ সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ সুদে ২৮ বছরে অর্থ পরিশোধ করতে হবে এবং প্রয়োজনে আরও ১০ বছরের সময় বৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে। প্রকল্পের বাকি ১০ শতাংশ ব্যয় অর্থাৎ ১ দশমিক ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশ নিজস্ব তহবিল থেকে বহন করছে।

এ প্রকল্পের আর্থিক দিক বিশ্লেষণের জন্য ইউনিট দুটির জীবনকাল ধরা হয়েছে ৬০ বছর। নির্মাণকাল ধরা হয়েছে ৬ বছর, বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি ২ শতাংশ এবং শুল্ক ২৫ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ১ (এক) ডলারের বিপরীতে ৮০ (আশি) টাকা ধরা হয়েছে। অবচয়ের হার জীবনকালব্যাপী রৈখিক নীতি অবলম্বন করা হয়েছে। মূল্যহ্রাস ধরা হয়েছে ১০ শতাংশ। জ্বালানি মূল্য এবং চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচের উচ্চসীমা হিসাবে ধরা হয়েছে প্রতি মেগাওয়াট ঘণ্টায় যথাক্রমে ১১ দশমিক ২ এবং ১৪ দশমিক ৫ মার্কিন ডলার। অপরদিকে জ্বালানি মূল্য এবং চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচের নিম্নসীমা হিসাবে ধরা হয়েছে প্রতি মেগাওয়াট ঘণ্টায় যথাক্রমে ৪ দশমিক ৫ ও ৭ দশমিক ৮২ মার্কিন ডলার। জ্বালানি মূল্য এবং চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচের বৈশ্বিক গড় হার হচ্ছে প্রতি মেগাওয়াট ঘণ্টায় যথাক্রমে ৬ দশমিক ২৮ এবং ১২ দশমিক ৭৯ মার্কিন ডলার।

আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও দুটি ইউনিট ডিকমিশনিংয়ের (পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল শেষে সেটি নিষ্ক্রিয় করা) জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে মোট বিনিয়োগের ওপর ৯ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্ল্যান্ট দুটির উৎপাদন সক্ষমতা সর্বনিম্ন ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ ধরা হয়েছে। আমাদের দেশে থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের গড় উৎপাদন ক্ষমতার হার হচ্ছে শতকরা ৫০ ভাগ। অন্যদিকে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের গড় উৎপাদন ক্ষমতার হার হচ্ছে শতকরা ৯০ ভাগ এবং ভিভিউআর-১২০০ রি-অ্যাক্টরের উৎপাদন ক্ষমতার হার হচ্ছে শতকরা ৯৩ ভাগ।

জ্বালানির উচ্চমূল্য ১১ দশমিক ২ থেকে নিম্ন মূল্য ৪ দশমিক ৫ এবং চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের উচ্চমূল্য ১৪ দশমিক ৫ থেকে নিম্ন মূল্য ৭ দশমিক ৮২ মার্কিন ডলার পরিবর্তন সাপেক্ষ প্ল্যান্টের উৎপাদন সক্ষমতার হার ৫০, ৭৫, ৮০, ৮৫ ও ৯০ শতাংশ ধরে মোট ৯টি কেস স্টাডি তৈরি করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার তৈরি করা ফিনপ্ল্যান নামক সফটওয়্যার ব্যবহার করে ৯টি কেস স্টাডির মডেল করা হয়েছে।

পরমাণু শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী। আধুনিক নিরাপত্তা সংবলিত জেনারেশন-৩+ ভিভিইআর-১২০০ রি-অ্যাক্টর চেরনোবিল কিংবা ফুকুশিমার মতো দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার কোনো শঙ্কা নেই। এখন আমাদের করণীয় হচ্ছে, আনুষঙ্গিক অবকাঠামোসহ নির্মাণকাজ সময়মতো শেষ করা এবং দক্ষ জনবল তৈরির মাধ্যমে প্রযুক্তি বুঝে নেওয়া।

প্রাপ্ত ফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে সর্বোচ্চ জ্বালানি মূল্য এবং সর্বোচ্চ চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দর এবং সর্বনিম্ন প্ল্যান্টের উৎপাদনের সক্ষমতা ৫০ শতাংশ ধরলে ইউনিটপ্রতি ন্যূনতম বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ৮ দশমিক ২৫ সেন্ট (৭ টাকা)। সর্বনিম্ন জ্বালানি মূল্য এবং চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ দর এবং সর্বোচ্চ প্ল্যান্টের উৎপাদনের সক্ষমতা ৯০ শতাংশ ধরলে ইউনিটপ্রতি ন্যূনতম বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৩৮ সেন্ট (৩ দশমিক ৭২ টাকা)। অন্যদিকে সর্বোচ্চ জ্বালানি মূল্য এবং সর্বোচ্চ চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ দর এবং প্ল্যাটের উৎপাদনের সক্ষমতা ৭৫ শতাংশ ধরলে ইউনিটপ্রতি বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৩৮ সেন্ট (৫ টাকা)। উপরিউক্ত কেস স্টাডির জন্য মূল্যহ্রাস নির্দিষ্ট ১০ শতাংশ ধরে অভ্যন্তরীণ রিটার্ন হার দাঁড়ায় শতকরা ১৩ থেকে ২০ পর্যন্ত, যা অর্থনৈতিক ও আর্থিক বিশ্লেষণের আলোকে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। মূল কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে ৪ শতাংশ সুদ এবং প্রতি মেগাওয়াট ঘণ্টায় চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দর ৮ থেকে ১৪ মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের তুলনায় অনেকটা কম। বাংলাদেশে রি-অ্যাক্টর চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটা কম হবে বিধায় বৈশ্বিক গড়ের কাছাকাছি ধরা হয়েছে।

এবার দেখা যাক পরমাণু শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন অন্যান্য জ্বালানি শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কতটা কমবেশি। পিডিবি সূত্রে দেখা গেছে যে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের বিক্রয়মূল্য গ্যাস, কয়লা, ফার্নেস ওয়েল, ডিজেল, ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎ এবং সৌরবিদ্যুৎ যথাক্রমে ৩ দশমিক ৩১, ১০ দশমিক ৩১, ২১ দশমিক ৭০, ২৮ দশমিক ৪৩, ৬ দশমিক ৮৩ এবং ১৫ দশমিক ২৩ সেন্ট। এখানে দেখা যাচ্ছে যে, গ্যাস থেকে তৈরি করা ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ সর্বনিম্ন এবং তারপরই রয়েছে পরমাণু শক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ। আরও দেখা যাচ্ছে যে, কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ পরমাণু শক্তির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ এবং ডিজেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ হচ্ছে সর্বোচ্চ। ফার্নেস ওয়েল ও ডিজেলের তুলনায় সৌরশক্তি থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। আইপিপি, রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের ক্ষেত্রে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ আরও বেশি।

এবার দেখা যাক, আমাদের পরমাণু শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কতটা কমবেশি। এদিকে রূপপুরের রি-অ্যাক্টরের অনুরূপ মডেল এবং প্রায় অনুরূপ বিনিয়োগ ও ঋণের শর্তে রাশিয়া বেলারুশ ও হাঙ্গেরিতে দুটি করে রি-অ্যাক্টর নির্মাণ করছে। ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের ন্যূনতম বিক্রয়মূল্য বেলারুশ ও হাঙ্গেরিতে হচ্ছে যথাক্রমে ৮ দশমিক ৩ এবং ৭ দশমিক ২৮ সেন্ট, যা সেই দেশের কয়লা থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দামের তুলনায় কম। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে আমাদের দেশে পরমাণু শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেলারুশ ও হাঙ্গেরির থেকে কম।

বাংলাদেশে পরমাণু শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় বিক্রয়মূল্য হচ্ছে ৬ দশমিক ৩২ সেন্ট, যা বিশ্বের গড় বিক্রয়মূল্য (১০ সেন্ট) থেকে শতকরা প্রায় ৩৭ শতাংশ কম।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অর্থনৈতিক ও আর্থিক দিকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অত্যন্ত সুবিধাজনক পর্যায়ে রয়েছে এবং বিনিয়োগে ঝুঁকিও কম। তবে নির্মাণকাল ছয় বছরের বেশি হলে এ সুবিধাটুকু ব্যত্যয় ঘটতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বর্তমানে ৮৫ টাকা (এক ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান) হলে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ খুব বেশি বাড়বে না। দুটি ইউনিটের জীবনকাল যদি আরও ২০ বছর বেশি ধরা হয়, তাহলে আরও সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘নিউক্লিয়ার এনার্জি ও টেকনোলজি’ জার্নাল এ আর্টিকেলটি দেখা যেতে পারে (সূত্র: ইসলাম মো. শফিকুল এবং তানভির হাসান ভূঁইয়া, নিউক্লিয়ার এনার্জি অ্যান্ড টেকনোলজি ৬ (৩): ১৮১-১৯৪)।

যৌথ এ গবেষণাকর্মটি যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির অধ্যাপক কোনো বোয়ানজির্য়াগোকে পাঠালে তিনি অর্থনৈতিক ও আর্থিক বিশ্লেষণটি পর্যালোচনা করে বাংলাদেশে পরমাণু শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বিষয়টি আকর্ষণীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক ব্যয় একটু বেশি হলেও ৪ শতাংশ সুদ এবং চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ দরপ্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা ৮ থেকে ১৪ মার্কিন ডলার বিবেচনায় ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচে আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক করতে সহায়তা করেছে।

রাশিয়ার জেনারেশন-৩ (ভিভিউআর-১০০০) এবং জেনারেশন-৩+ (ভিভিউআর-১২০০ ও ভিভিউআর ১৩০০-TOI) এ তিনটি মডেলের মধ্যে কারিগরি ও আর্থিক বিষয়টি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে ২০১৫ সালের ৫ জুলাই টেকনোলজি নির্বাচনসংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী একটি সেমিনারে সর্বোচ্চ নিরাপত্তাবিশিষ্ট ভিভিউআর-১২০০ মডেল রি-অ্যাক্টরটি নির্বাচন করার জন্য মতামত দিয়েছিলাম। এ বিষয়ে আমি একটি নিবন্ধ প্রকাশ করি ‘কেমন হওয়া দরকার রূপপুরের চুল্লি?’ (সূত্র: ২ আগস্ট ২০১৫, প্রথম আলো)। এখানে এ বিষয়টি উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে কারিগরির সঙ্গে আর্থিক বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পরমাণু শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী। আধুনিক নিরাপত্তা সংবলিত জেনারেশন-৩+ ভিভিইআর-১২০০ রি-অ্যাক্টর চেরনোবিল কিংবা ফুকুশিমার মতো দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার কোনো শঙ্কা নেই। এখন আমাদের করণীয় হচ্ছে, আনুষঙ্গিক অবকাঠামোসহ নির্মাণকাজ সময়মতো শেষ করা এবং দক্ষ জনবল তৈরির মাধ্যমে প্রযুক্তি বুঝে নেওয়া।

ড. মো. শফিকুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক। [email protected]