১ ফেব্রুয়ারি সকালে মিয়ানমারের সদ্য নির্বাচিত সংসদের অধিবেশন রাজধানী নেপিডোতে শুরু হওয়ার কথা ছিল। সেই অধিবেশনের মাধ্যমে মিয়ানমারে বিপুল ভোটে বিজয়ী অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) পুনরায় ক্ষমতায় আসীন হতো। গত নভেম্বরে মিয়ানমারের নির্বাচনে দলটি সংসদের উন্মুক্ত আসনের প্রায় ৮৪ শতাংশ আসন পেয়েছিল। অন্যদিকে নির্বাচনে সামরিক বাহিনী-সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) ভরাডুবি হয়। তার অর্থ, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সংবিধান মোতাবেক সরকারের ব্যাপক ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক অঙ্গনে ইউএসডিপির তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখার অবস্থা ছিল না।
ইউএসডিপির ভরাডুবির পর থেকেই নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ভুয়া ভোটার তালিকার মাধ্যমে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উত্থাপিত হয়। কয়েক হাজার অভিযোগ দাখিল হয় নির্বাচন কমিশনে। কিন্তু এর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বা নিতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। সামরিক বাহিনীর তরফ থেকেও নির্বাচনের সততা নিয়ে অভিযোগ তোলা হয়। এ ছাড়া সামরিক বাহিনী নভেম্বরের নির্বাচন পেছানোর দাবি তুলেছিল এবং সেটা আমলে নেওয়া হয়নি। তবে মূলত নির্বাচনে কারচুপি প্রসঙ্গেই সু চির সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর তিক্ততা চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।
তা ছাড়া মিয়ানমারের বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সরাসরি আলোচনা, বিশেষ করে আরাকান রাজ্যে আরাকান আর্মির সঙ্গে প্রথমবারের মতো শান্তি আলোচনা নিয়ে বেসামরিক সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের বর্তমান সংবিধানে সামরিক বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরাসরি পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া আছে।
বর্তমান সামরিক বাহিনী প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের আগামী জুলাই মাসে অবসরে যাওয়ার কথা ছিল এবং সু চি সরকার তাঁর মেয়াদ বৃদ্ধিতে আগ্রহী ছিল না। অবসরে যাওয়ার মানে তাঁর ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে তিনি একেবারে ক্ষমতাশূন্য ব্যক্তিতে পরিণত হতেন। অন্যদিকে যথেষ্ট রাজনৈতিক সমর্থন না থাকায় প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের সম্ভাবনাও কম ছিল। শুধু সেনাপ্রধানই নন, তাঁর সঙ্গে ডজনখানেক জেনারেলের অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। এই সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিধনের অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়সহ নানা অভ্যন্তরীণ কারণে সু চির শক্তি বৃদ্ধিকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী সহজভাবে নিতে পারেনি। যদিও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সু চি মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আনা রোহিঙ্গা নিধনের অভিযোগ ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থেকে খণ্ডন করার প্রয়াস নিয়েছিলেন।
যা–ই হোক, এরই প্রেক্ষাপটে কয়েক দিনের গুঞ্জনের মধ্যে সংসদ শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে সামরিক বাহিনী এক বছরের জরুরি অবস্থা প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে ঘোষণা করিয়ে সর্বময় ক্ষমতা সামরিক প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের হাতে ন্যস্ত করে। বর্তমান এ ব্যবস্থাকে জরুরি আইনের সময়কাল বলা হলেও কার্যত মার্শাল ল বা মিলিটারি শাসনই বলা যায়। সামরিক শাসন মিয়ানমারে নতুন নয়। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখল করেন। নে উইন মিয়ানমারের স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা জেনারেল অং সানের ৩০ কমরেডের একজন ছিলেন। প্রায় দুই যুগ নে উইন ছিলেন কঠিন সামরিক শাসক (১৯৬২-৮৮)। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাসীন হন জেনারেল সা মং।
যা–ই হোক, এককথায় মিয়ানমার ২০১১ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। এত বছরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী শুধু শক্তিশালীই হয়নি, সংবিধান রচনা করে কথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দৃশ্যত সহযোগিতা করেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ বছর বন্দী থাকবার পর সু চি গত পাঁচ বছর সামরিক বাহিনীর অংশীদারত্বের মধ্য দিয়ে সরকারপ্রধান ছিলেন। এরই মধ্যে ২০১৭ সালে মিয়ানমারের ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ ও বর্বরতা সংঘটিত হয় রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ওপর। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
রোহিঙ্গা সংকটের কারণে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর অবৈধ ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে তেমন শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি। সরকারের নীতিনির্ধারকদের অনেকে ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে মিয়ানমারে সামরিক শাসনকালে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে এবারও তেমন কিছু ফল পাওয়ার আশা করছেন। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, তিনি আশাবাদী। আমরাও আশাবাদী হতে চাই। তবে বাস্তবতা হলো, রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ ও গণহত্যার জন্য সু চি ধিক্কৃত হলেও এর মূল হোতা মিয়ানমার সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে সিনিয়র জেনারেল মিন হ্লইং। কাজেই সেই বাহিনী এবং বাহিনীপ্রধান ক্ষমতায় গিয়ে রোহিঙ্গাদের সসম্মানে ফেরত নেবেন এবং রোহিঙ্গাদের মূল দাবি নাগরিকত্ব প্রদান করবেন—এমন মনে হয় না। বস্তুত, সামনের এক বছর মিয়ানমারের সামরিক সরকারের কাছে রোহিঙ্গা সমস্যা সবচেয়ে কম গুরুত্ব পাবে বলেই মনে হয়।
অন্যদিকে এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগর অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক অঙ্ক আরও জটিল হবে। এই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটন যতখানি জোরালো বক্তব্য দিয়েছে, তেমনটা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আসিয়ানভুক্ত দেশ বা জাপানের কাছ থেকে শোনা যায়নি। মিয়ানমারে চীনের পর সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ জাপানের। আসিয়ান দেশগুলো সদস্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে খুব সোচ্চার নয়। থাইল্যান্ড এই পরিবর্তনকে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বিবৃতি দিয়েছে।
লক্ষণীয় হলো মিয়ানমারের দুই গুরুত্বপূর্ণ দেশ ভারত ও চীনের প্রতিক্রিয়া। চীন সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল, সে কারণসহ অন্য কিছু কারণে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। এই পরিবর্তনকে চীন শুধু ‘পর্যবেক্ষণ’ করছে বলে বিবৃতি দিয়েছে। অন্যদিকে ভারত ‘উদ্বিগ্ন’ এবং গণতন্ত্রে ফেরার তাগিদ দিয়েছে। উল্লেখ্য, আগে মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের সঙ্গে চীনের মধুর সম্পর্ক ছিল, এখনো তেমনি হওয়ার কথা। যুক্তরাষ্ট্র যদি কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারের একমাত্র ত্রাণকর্তা হবে চীন।
ভারতের সঙ্গে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে নিবিড় হয়েছে। বিশেষ করে ভারতের পূর্ব নীতি ও কালাদান প্রকল্পের কারণে। তা ছাড়া ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যে বিদ্রোহীদের, বিশেষ করে নাগা এবং উলফাদের মোকাবিলায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী ভারতকে সহযোগিতা করেছে। তা ছাড়া ভারত মিয়ানমারকে ডুবোজাহাজসহ প্রচুর অস্ত্র সরবরাহ করেছে। ভারতের সেনাপ্রধান মাত্র মাসখানেক আগে মিয়ানমার সফর করে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার অঙ্গীকার করেছেন। এই অঞ্চলের ভূরাজনীতির নতুন মেরুকরণ ভারতের সঙ্গে চীনের যে প্রতিযোগিতা রয়েছে, তাতে ভারত সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে এবং অং সান সু চির পক্ষে কার্যত তেমন কোনো পদক্ষেপে যাবে বলে মনে হয় না। যেমনটা চীনও যাবে না।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে অন্তত চীন-ভারতের কাছ থেকে তেমন কোনো কার্যকর সহযোগিতা আশা করা যায় না। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আরও গভীর সংকটে পড়তে পারে। নতুন ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা হতে পারে দাবার ঘুঁটি। মিয়ানমার নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব নতুন আঙ্গিকে যাবে বলে মনে করা হয়। কাজেই বাংলাদেশের কূটনীতিবিদদের উদ্ভূত জটিল পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের পথ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)
hhintlbd@yahoo.com