রোগ নতুন, রোগের রাজনীতি কি নতুন

২০১৫ সালে এক বক্তৃতায় বিল গেটস মানবসভ্যতার জন্য দুটি ভয়াবহ বিপদের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এক জলবায়ু পরিবর্তন, দুই জীবাণুবাহী মারণাস্ত্র। ছয় বছরের মধ্যেই দুই বিপদের সঙ্গেই মোটামুটি আমাদের দেখা হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিপদের ভয়াবহতার মাত্রা আমরা হাড়ে-রক্তে-ফুসফুসে টেরও পাচ্ছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রোগজীবাণুকে অস্ত্র কিংবা রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার কি একদমই নতুন কোনো ধারণা?

রোগ অনেক রকম। তবে সহজে ছড়ায়, মানে সংক্রামক রোগই সাধারণত রাজনীতি বা যুদ্ধবিগ্রহে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। যেমন ইউরোপে বাস করা কারও জন্য সর্দি-কাশি ডাল-ভাত হতে পারে, কিন্তু ম্যালেরিয়া মানেই সাক্ষাৎ যম। আফ্রিকার গ্রামে বাস করা মানুষের জন্যও সর্দি-কাশি হতে পারে প্রাণঘাতী।

চার্লস ডারউইন তাঁর দ্য ভয়েজ অব দ্য বিগল বইয়ে লিখেছেন, ইউরোপীয়রা যেদিক দিয়ে গেছে, সেখানেই আদিবাসীদের মৃত্যু ছুঁয়ে গেছে। এককভাবে সাদা বর্ণের মানুষদের উনি বিধ্বংসী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কলম্বাসেরও বহু আগে জীবাণুকে মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের চল শুরু হয়েছিল। ১৩৪৮ সালে কাফার যুদ্ধে তাতাররা রোগ ছড়াতে প্লেগে মৃত মানুষের লাশ পাথর ছোড়ার যন্ত্র দিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর নিক্ষেপ করত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৭৬৩ সালের ফ্রেঞ্চ-ইন্ডিয়ান যুদ্ধে ফরাসিরা আমেরিকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীদের গুটিবসন্তের জীবাণু মাখানো কম্বল ও রুমাল দিয়েছিল। গুটিবসন্তের জীবাণু অনেক দিন কাপড়ে বেঁচে থাকে। যুদ্ধে জীবাণুর ব্যবহার ১৮৬৮ সালের সেন্ট পিটার্সবার্গ এবং ১৯০৭ সালের হেগ কনফারেন্সে নিষিদ্ধ করা হয়।

কিন্তু তারপরও যুদ্ধ ও রাজনীতিতে জীবাণুর ব্যবহার থামানো যায়নি। বরং নিত্যনতুন কৌশলে জীবাণুকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় ১৯৪৩ সালে এসে ইতালি জার্মানপক্ষ ত্যাগ করে মিত্রশক্তির সঙ্গে যোগ দেয়। জার্মানরা মিত্রশক্তির হাত থেকে রোমকে বাঁচাতে লাজ্জিও অঞ্চলের পন্টাইন জলাধার ঘিরে একটা ভয়াবহ পরিকল্পনা করে। পন্টাইন ছিল ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী স্ত্রী মশা অ্যানোফিলিসের অভয়ারণ্য। ইতালীয়রা জলাধারের পানি কমিয়ে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে আসছিল। জার্মানরা চাইলে বোমা মেরে সেই জলাধারের পানি পাম্প করার সব মেশিন উড়িয়ে দিতে পারত। কিন্তু তারা তা করল না। তারা পাম্প মেশিনগুলো দিয়ে জলাধারের পানি কিছুটা নোনা করে দিল। মহাসুবিধা হলো অ্যানোফিলিস মশার। ইতালিতে দেখা দিল ম্যালেরিয়া মহামারি। জার্মানরা ইতালির কুইনাইন সরবরাহ জব্দ করে নিল। এই একটা ঘটনাই বর্তমান সময়ে কোভিড-১৯ এবং তার টিকা নিয়ে যে রাজনীতি চলছে, সেই বিষয়ে আমাদের সোজাসুজি ধারণা দেয়।

এই বছরের প্রথম দিন থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে গেছে যুক্তরাজ্য। ভৌগোলিকভাবে যুক্তরাজ্যের আছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং ইইউর আছে ফাইজারের টিকার ওপর নিয়ন্ত্রণ। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দাবি, তাঁর দেশের অর্ধেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন। অন্যদিকে, ইইউর দাবি, তার অঞ্চলের মানুষ পর্যাপ্ত টিকা পাচ্ছেন না, তাই যুক্তরাজ্যে তারা টিকা রপ্তানি করবে না। শুধু তা–ই না, ইইউর দাবি, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকায় শরীরে রক্ত জমাট বাঁধে। ১৫ মার্চ পর্যন্ত ১৭ মিলিয়ন মানুষ অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়েছেন, রক্ত জমাট বেঁধেছে মাত্র ৩৭ জন মানুষের শরীরে।

গবেষণা বলছে, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নেওয়ার পর শরীরে রক্ত জমাট বাঁধার আশঙ্কা শূন্য দশমিক ০০০২ শতাংশ, যা মোটের ওপর খুবই নগণ্য। কোনো রকম বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছাড়াই যুক্তরাজ্যর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বানানো এই টিকা প্রদান বন্ধ করে দিয়েছিল ইইউ। চীন বলছে, শুধু তাদের উদ্ভাবিত টিকা ব্যবহারকারীকেই তারা দেশে প্রবেশ করতে দেবে। রোগের প্রতিষেধক নিয়ে ক্ষমতা আর অর্থের রাজনীতির এই নোংরা খেলার ভেতরই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানাল, ১৩০টি দেশ কোভিড–১৯-এর কোনো টিকাই পায়নি।

মোটামুটি গোটা পৃথিবীর স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে উঠেছে পশ্চিমা ঔপনিবেশিকতার ছায়াতলে। পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানের হাতেই রাজ্যের সব ওষুধ ও প্রতিষেধক। দেশি রোগের দেশি ওষুধের বদলে আমাদের তাই নির্ভর করতে হচ্ছে বিদেশি ওষুধের ওপর। সেই ওষুধ আবার চাইলেই পাওয়া যাচ্ছে না। ভৌগোলিক রাজনীতির ওপর নির্ভর করছে ওষুধের সরবরাহ।

তাই সামগ্রিক অবস্থা বিচারে মনে হচ্ছে, কোভিডের চেয়েও ভয়ংকর অতিমারি হচ্ছে জাতিভেদ। মহামারি, অতিমারি মানবসভ্যতার পথপরিক্রমারই অংশ। রোগ এসেছে, রোগের প্রতিষেধকও এসেছে। অনেক রোগ নির্মূলও হয়েছে। কিন্তু জাতিভেদের মতো ভয়ংকর রোগের টিকা এখনো অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে।

তথ্য এবং চিন্তাসূত্র: প্রফেসর ফ্রান্সিস কক্সের গবেষণা, গার্ডিয়ান, বিজনেস ইনসাইডারের বিভিন্ন সংখ্যা।

রিনভী তুষার রাজনীতি গবেষক এবং যুক্তরাজ্যে কর্মরত অভিবাসন উন্নয়নকর্মী
[email protected]