রোহিঙ্গা ইস্যু আঞ্চলিক অস্থিরতার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে

রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে অস্থিরতা বাড়ছে
ফাইল ছবি

তিন বছর চলে গেছে কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ আর অত্যাচারের মাধ্যমে উৎখাত হওয়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে। এক হিসাব অনুযায়ী, শরণার্থীশিবিরগুলোতে প্রতিবছর ৬০ হাজার শিশু জন্মগ্রহণ করছে। ক্রমবর্ধমান এবং এত বড় এই জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মিয়ানমার-সংলগ্ন দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। কিছুদিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও অন্য পশ্চিমা দেশগুলো এই সংকট সমাধানে যথেষ্ট উদ্যোগ নিচ্ছে না। (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২৩ আগস্ট ২০২০)। তিনি রোহিঙ্গাদের নিজের দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক কমিশন গঠনের দাবিও জানিয়েছেন। তিনি আসিয়ান রিজিওনাল ফোরামের ২৭তম বৈঠকে বলেছেন, এই সমস্যা দ্রুত সমাধান না করলে এখানে চরমপন্থীদের উত্থানের আশঙ্কা রয়েছে। (দ্য ইনডিপেনডেন্ট, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০)।

এটা পরিষ্কার যে গত তিন বছর রোহিঙ্গাদের এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিজের দেশের ভিটামাটিতে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সব দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কোনো চিন্তাভাবনাও করছে বলে মনে হয় না। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের (আইসিজে) মামলাও দেশটিকে খুব একটা বিচলিত করছে না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এই মামলা নিয়ে মিয়ানমার নিরুদ্বেগ থাকতে পারছে। কারণ, এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ ও এশিয়ার প্রধান দুই শক্তির মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে মিয়ানমার বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে। এ মাসের (অক্টোবর ২০২০) প্রথম সপ্তাহে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা এবং সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নারাভান মিয়ানমার সফর করেছেন এবং দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি এসেছে।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের এই সফরের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সফরকালে যে বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে তা হচ্ছে, মিয়ানমারে ভারতের কালাদান প্রকল্প, আগামী বছর রাখাইনের রাজধানী সিত্তেতে উন্নত বন্দর চালু করা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন এবং বিপুল অর্থ লগ্নি, যার মধ্যে রয়েছে ছয় বিলিয়ন ডলারের ইয়াঙ্গুন-সংলগ্ন এলাকায় তেল শোধনাগার তৈরি। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের জ্বালানি খাতের বিনিয়োগের প্রায় ৭০ ভাগই হয়েছে চীনের অর্থায়নে। রাখাইন অঞ্চলে কৃষি সম্প্রসারণ, প্রশিক্ষণ ও বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া চীন সীমান্তসংলগ্ন কাচিন রাজ্যের প্রধান শহর মাইটকিইনাতে সফটওয়্যার উন্নয়ন ও ট্রেনিং সেন্টারের ভার্চ্যুয়াল উদ্বোধন করা হয়েছে। ওই অঞ্চল ও শহর চীন সীমান্তসংলগ্ন এবং সেখানে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে।

ভারত-মিয়ানমার সহযোগিতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত লেডো রোডের উন্নয়ন। এই রাস্তা ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ তৈরি করবে। রাস্তাটি আসামের লেডো থেকে চীনের কুনমিং পর্যন্ত ছিল। আরও রয়েছে মিয়ানমারের চিন রাজ্য ও মিজোরামের সীমান্ত হাট প্রকল্প। ভারতের দুই কর্তাব্যক্তির এই সফর ও কর্মকাণ্ড মিয়ানমারে চীনের প্রভাব কমানোর প্রচেষ্টাই অংশ। স্মরণযোগ্য যে ভারত চীনবিরোধী যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক জোটের অন্যতম সদস্য। এই জোটের বাকি দুই সদস্য হচ্ছে জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত এ অঞ্চলে, বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে চীনবিরোধী অন্যতম শক্তি। ভারতের পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এদের প্রধান লক্ষ্য বেল্ট রোড উদ্যোগের মাধ্যমে চীন যে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, তা খর্ব করা এবং দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের প্রতিপক্ষ দাঁড় করানো।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের প্রসঙ্গ ও আলোচনায় এই ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও হিসাব-নিকাশকে অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। ভারত আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী এবং সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে পরিচিত। কাজেই বাংলাদেশের এ সংকটে ভারত অত্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, এমনই আশা বাংলাদেশের। কিন্তু আলোচিত সফরে রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান ও স্টেট কাউন্সেলরের সঙ্গে তেমন কোনো আলোচনা হয়েছে বলে জানা যায়নি। অবশ্য সফরের আগে ভারতের পক্ষ থেকে এমন একটি ধারণা পাওয়া গিয়েছিল। মিয়ানমারকে ভারতের প্রয়োজন পূর্ব ভারতের স্থিতিশীলতা, যোগাযোগ ও চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতার জন্য। অন্যদিকে চীন-মিয়ানমার সম্পর্কের ইতিহাস এবং বর্তমানের প্রেক্ষাপটে চীনের কাছে মিয়ানমারের গুরুত্বের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে চীনের কাছ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের তেমন কিছু পাবে বলে মনে হয় না।

রোহিঙ্গা উপস্থিতি এরই মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তসীমান্ত সমস্যায় জটিলতা তৈরি করছে। বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমার যে সেনাসমাবেশ করেছে, তা এ অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়াতে যথেষ্ট। অপরদিকে মিয়ানমার দাবি করেছে, বাংলাদেশও সেনাসমাবেশ করেছে এবং একে মিয়ানমারের সেনাসমাবেশের কারণ দেখানোর চেষ্টা করেছে। মিয়ানমারের ভাষ্য, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, আসন্ন নির্বাচন এবং আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে চলমান সংঘর্ষের কারণে এই সেনাসমাবেশ। মিয়ানমারের তরফে এই অভিযোগও রয়েছে যে বাংলাদেশ আরাকান আর্মি ও কথিত আরসাকে সহায়তা করছে। উল্লেখ্য, এই প্রথম আরাকান আর্মি আরাকানে রোহিঙ্গাবিরোধিতা থেকে অনেকটা সরে এসেছে। বিষয়টি অবশ্যই মিয়ানমারকে উদ্বিগ্ন করেছে।

বিভিন্ন তথ্য ও সূত্রে জানা যাচ্ছে, রাখাইন অঞ্চলে ‘থ্রি ব্রাদার্স’ নামে উত্তর জোটের অংশ হিসেবে আরাকান আর্মি ছাড়া আরও দুটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন যুক্ত হয়েছে, যাদের সঙ্গে কথিত রোহিঙ্গা সংগঠন আরসা এবং নতুন আরেকটি কথিত রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপ আরাকান রোহিঙ্গা আর্মির (এআরএ) সহযোগিতার সম্ভাবনা নিয়ে মিয়ানমারের মধ্যে উৎকণ্ঠা রয়েছে। অনেকে মনে করেন, এসব ভীতি থেকেই মিয়ানমার সীমান্তে তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ এই সেনাসমাবেশের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে জাতিসংঘের দৃষ্টিগোচর করেছে। কাজেই বিষয়টি দ্বিপক্ষীয় থাকেনি। সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য যা করা প্রয়োজন, তা করার অধিকার বাংলাদেশের রয়েছে। তবে ১৯৯১-এর পর দুই দেশের সেনাবাহিনী প্রথমবারের মতো সীমান্তে এই মাত্রার তৎপরতায় জড়িয়েছে।

রোহিঙ্গা সমস্যা যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য কতটা ঝুঁকি বাড়িয়েছে, তার প্রমাণ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিরতা, অহরহ গোলাগুলি এবং অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি। একই সঙ্গে কক্সবাজার এখন অনেকটাই মাদকের পাইকারি বাজারে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় পুলিশ থেকে জনপ্রতিনিধিরাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ হত্যার ঘটনায় বিষয়গুলো আমাদের সামনে পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে। এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হলে ভূকৌশলগত, অর্থনৈতিক ও ভূরাজনীতির বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ক্রমে বৃহত্তর অস্থিরতার মধ্যে পড়তে পারে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের, বিশেষ করে আঞ্চলিক ও ইন্দো-প্যাসিফিক ভূরাজনৈতিক ঘূর্ণির মধ্যে বাংলাদেশ পড়তে পারে, যা বাংলাদেশের অগ্রগতি, উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য সহায়ক হবে না।

বাংলাদেশের সবচেয়ে জরুরি চাওয়া রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান, যা দ্বিপক্ষীয় কূটনীতিতে সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের সামনে প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে এ সমস্যার সমাধান হবে? এর উত্তরে বলা যায়, বাংলাদেশের সম্ভবত আরও আগ্রাসী কূটনীতির প্রয়োজন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ সমস্যা সমাধানের উপায় এবং আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণের উপায় বাংলাদেশকেই খুঁজতে হবে। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তসীমান্ত সমস্যায় নিমজ্জিত হতে হবে।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

[email protected]