রোহিঙ্গা গণহত্যাকে স্মরণ নয়, স্বীকৃতি দিন

২০১৭ সালে গণহত্যার শিকার হয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে
ফাইল ছবি

আমি গণহত্যার স্মৃতিচারণা করতে চাই না, চাই জীবনের উৎসব সাজাতে। বিমূর্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নয়, আমি রোহিঙ্গা ভাই ও বোনদের সঙ্গে তাঁদের একটি সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে চাই। এই অস্বীকৃত গণহত্যা আমার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা করতে চাই তা করা অসম্ভব করে দিয়েছে। রোহিঙ্গারা যে কেবল রোহিঙ্গা বলেই খুন হয়েছে তা বোঝার জন্য আমাদের বিবেকের আইনের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন নেই। সাধারণ বোধবুদ্ধি দিয়েই বোঝা যায়, এটা গণহত্যা। তবে এই অন্যায়ের আইনি প্রতিকার শুরু করার জন্য গণহত্যার আন্তর্জাতিক ও আইনি স্বীকৃতি থাকা প্রয়োজন।

অন্তত সাম্প্রতিক অতীতের কথা বলা যায়, ২০১৭ সাল থেকে যার শুরু। তখন থেকে রোহিঙ্গাদের হত্যা বা জমিজমা ও বসতবাড়ি ধ্বংস করে তাদের স্বভূমি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, যে ভূমিতে জাতি রাষ্ট্রচিন্তার উদ্ভবের বহু আগে থেকেই তাদের বসবাস, তাদের ঘোরাফেরা। জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এই গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এখন পর্যন্ত তার স্বীকৃতি দিতে পারেনি। তারা নানা অজুহাত দিয়েই চলেছে। পুঁজির বিনিয়োগের সম্পর্কও আছে এর সঙ্গে।

লোভ আর কুসংস্কার এখানে হাত মিলিয়েছে। তার সৃষ্টি নৃগোষ্ঠিক জাতীয়তাবাদ। সারা বিশ্বে আজ এই এক সমস্যা। নৃগোষ্ঠীক জাতীয়তাবাদ ধ্বংস করছে তাদেরই, যাদের কপট ভদ্রতায় বলা হয় ‘অবৈধ অভিবাসী’। এ যেন নাগরিকত্বের এক নতুন সংজ্ঞা! লোভ ও হিংস্র নৃগোষ্ঠিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যৌনতা। গণহত্যা, ভূমি দখল ও লোভের সঙ্গে দুর্ধর্ষভাবে দ্রষ্টব্য করা হয়েছে নৃশংস ধর্ষণ ও নপুংসকরণ। রোহিঙ্গা পীড়নে এটি একটি প্রাথমিক অস্ত্র।

ধর্ষণ যে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, জাতিসংঘও তা স্বীকার করেছে। প্রমাণ হিসেবে বিপুল ভিডিও সংগ্রহ রয়েছে, কিন্তু সেগুলো নিছক সুড়সুড়ি দিতে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে মনে হয়। এর চেয়ে বরং রোহিঙ্গা ভাইবোনেদের ক্ষুব্ধ বক্তব্য কানে তোলা যাক। তারা নিজেদের বর্তমান জীবনকে বলছে মানবেতর, অমানুষিক। নাসির উদ্দিনের ৫০০+ ঘণ্টার ভিডিও এর সাক্ষী দেবে। কাজেই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পথের শেষ নয়, পথের শুরু। স্বীকৃতি মিললে রোহিঙ্গাদের পক্ষে নিজেদের ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার রাজনৈতিক সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। মানুষ হওয়ার দরজা তখনই খোলে, যখন শিশুরা গণতন্ত্রের প্রবৃত্তি—অর্থাৎ প্রতিবেশীর সম্বন্ধে সচেতনতা—এই স্বাভাবিকতায় প্রশিক্ষিত হয়।

আমি নাগরিকত্বের অসম্ভব স্বপ্ন দেখি। রোহিঙ্গাদের ভোট বিক্রি হতে পারে না। কেবল এই অসম্ভব স্বপ্নের কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমার আরজি, গণহত্যা শুধুই স্মরণ না করে তাকে সর্বজনীন আইনসম্মত স্বীকৃতি দেওয়ার আন্দোলন করুন। একই সঙ্গে বাণিজ্যিক স্বার্থ ফিরিয়ে নিন। গণহত্যার স্বীকৃতির পরের পরিস্থিতি, রোহিঙ্গাদের আরও স্থিতিশীল জীবন—এ কথাগুলো আমাদের ভাবতে পারতে হবে। আমি মানবিক বিদ্যার শিক্ষক, সেই বিদ্যাকে বিদ্যালয়ের বাইরে নিয়ে গিয়ে অপরাশক্তির তালিম দেওয়া আমার কাজ, এ দুরূহ কাজ অন্তত সামান্য স্থিতি ছাড়া করা যায় না।

গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পথের শেষ নয়, পথের শুরু। স্বীকৃতি মিললে রোহিঙ্গাদের পক্ষে নিজেদের ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার রাজনৈতিক সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। মানুষ হওয়ার দরজা তখনই খোলে, যখন শিশুরা গণতন্ত্রের প্রবৃত্তি—অর্থাৎ প্রতিবেশীর সম্বন্ধে সচেতনতা—এই স্বাভাবিকতায় প্রশিক্ষিত হয়।

এই অঞ্চলের দেশগুলো এই স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসেনি। ভারতীয় হিসেবে আমি আমাদের মনপ্রাণের শ্রেষ্ঠ অংশের কাছে আবেদন রাখতে চাই—এই ভাইবোনদের জন্য এগিয়ে আসুন। ১৯৮০-এর দশকের শেষভাগ থেকে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আমি কোনো না কোনোভাবে যুক্ত। আমি এক ব্যক্তি, যে কবিতার জন্য জীবন দিয়েছে। সেই হিসেবে ভাবি, যে ১৭ শতকের রাখাইন কবি আলাওলের নাম এখানে করতে হবে। আমার কাছে রক্তের শুদ্ধতাবিষয়ক কোয়ান্টাম তত্ত্ব নেই, তাই বলতে পারব না, তিনি প্রকৃত রাখাইন কি না। আমি শুধু জানি, আলাওল ‘রোহ্যাঙ্গ’দের উদ্দেশে কবিতা লিখেছেন। আর জানি যে ছেলেমানুষ থাকতে আমার মায়ের সূত্রে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়—আরাকানের পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে, ৩০০ বছরের ব্যবধান ঘুচিয়ে, সে ভূমির ধ্রুপদি কবি বলে।

তিনি যে নারীদের কথা লিখেছেন, তারা ধর্ষণের শিকার হতে নারাজ—যে মানুষের কথা বলেছেন, তারা খুন হতে নারাজ। তাঁর নামে ডাকি আপনাদের, মনে করাই, যে গণহত্যা, ধর্ষণ ও লোভের ভয়ংকর মিতালিকে শুধু স্মরণ করলে চলবে না। গণহত্যার আইনি স্বীকৃতির জন্য জোরে জোরে সবাই মিলে জয়ধ্বনি করে ঐতিহাসিক ভবিষ্যতের গুণকীর্তন করি, যা কেবল স্মৃতিই পারে। সংগ্রামের অঙ্গনে দাঁড়িয়ে আমি আপনাদের সবাইকে সবল আলিঙ্গনে টেনে আনি একসঙ্গে। শেষ করি রোহিঙ্গাদের দিনযাপনের আত্মগ্লানির কথাটি দিয়ে: অমানুষিক।

মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে, সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে, তবু কোলে দাও নাই স্থান, মৃত্যু মাঝে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

অস্বীকৃতির বঞ্চনায় আমরা মৃত্যুতে বিলীন হয়ে গণহত্যার স্মারক হয়ে যাব।

ইংরেজি থেকে অনূদিত

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক ভারতীয় শিল্পকলা তাত্ত্বিক ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক