রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সুযোগ এখনই নিতে হবে

মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থান রোহিঙ্গাদের জন্য শাপে বর হলেও হতে পারে। কীভাবে তা হতে পারে, সেটি বুঝতে হলে সাম্প্রতিক ঘটনাপঞ্জির দিকে খানিকটা নজরপাত প্রয়োজন।

সেনাশাসকদের যা থাকে না তার নাম ‘বৈধতা’। মিয়ানমারে ২০২০ সালের নভেম্বরের নির্বাচন যেহেতু স্বচ্ছ এবং প্রশ্নমুক্ত হয়েছে বলে সারা বিশ্বের পরিদর্শকেরা রায় দিয়েই ফেলেছেন, সেনাশাসকের উল্টোটা বলা, অর্থাৎ নির্বাচনে সু চির দল জোচ্চুরি করেছে এমন অভিযোগ তুললেও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কোনো রকম কল্কে পাবে না। ফলে সেনাশাসকের বৈধতা পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। এ শূন্যতা পূরণের জন্য প্রথমেই সেনাশাসক প্রতিবেশীর দরজায় কড়া নাড়বে। মিয়ানমারও সেই কাজই করেছে। বাংলাদেশের কাছে কৈফিয়ত দিয়েছে কেন তাদের এ কাজ করা নেহাত জরুরি হয়ে পড়েছিল। সঙ্গে আশ্বাসও ছিল যে তারা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে। অনেককে ফেরত নেবে। সে জন্য তারা বাংলাদেশের সহযোগিতাপ্রত্যাশী।

এ কথা সত্য বাংলাদেশ কেন, কোনো দেশই মিয়ানমারের এসব চাতুরীকে শুরুতেই বিশ্বাস করবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার আগেও সময়ক্ষেপণের চালাকি ছাড়া অন্য কিছু করেনি। তিন বছরের মধ্যে প্রথম ফিরে যাওয়া পরিবারটি নাকি তাদেরই নিয়োজিত গুপ্তচর সদস্য ছিল। বিপদের আশঙ্কা দেখে তাদের নিরাপদে সটকে পড়ানোর ব্যবস্থা করতেই ফিরিয়ে নিয়েছে। বারবার আলাপের পর ১১ লাখ আশ্রিত রোহিঙ্গার মধ্যে মাত্র ৪৬ হাজারকে মিয়ানমারের অধিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ফিরিয়ে নেওয়ার পর নাগরিকত্ব দেওয়া হবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা বা প্রতিশ্রুতি কিন্তু দেয়নি। মিয়ানমার যে কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার তথ্য জানাচ্ছিল, মানবাধিকারকর্মীরা সেগুলোকেও নতুন ধরনের বন্দিশালা অথবা ‘কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ আখ্যা দিচ্ছিল। বলছিল, এসবই লোকদেখানো বা দায় সারানোর চেষ্টা মাত্র। রাখাইনে ফিরে গেলে রোহিঙ্গাদের এসব কাঁটাতার ও দেয়ালের ঘেরাটোপে রাখা হতে পারে আশঙ্কায় তারা প্রত্যাখ্যান করে আসছিল অনিরাপদ ও অসম্মানজনক প্রত্যাবাসন-প্রস্তাবগুলো।

আসলে ‘বৈধতার সনদ’ মিলুক বা না মিলুক, সেনাবাহিনীর জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অনুমোদন মেলাও অন্তত একটি বড় পাওয়া। তারা চায় আর কিছু না হোক প্রতিবেশী যেন নিন্দা না জানায়। বাংলাদেশও সেই কারণেই ‘আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি’, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যেন সমুন্নত থাকে’ ধরনের সতর্ক প্রতিক্রিয়ার বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেনি।  

মাত্র দুই-তিন মাস আগেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর আচরণ ছিল মারমুখী। গত বছরের শেষ দিকে জাতিসংঘের ৭৫তম অধিবেশনেই দেশটি নমনীয় অবস্থান নেওয়া দূরে থাকুক, উল্টো বাংলাদেশকেই কড়া হুমকি-ধমকি দিয়েছে। অভিযোগ করে বলেছে, বাংলাদেশ তাদের সহযোগিতা না করলে পরিণতি ভালো হবে না। বলেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়াকে দিয়ে আইসিসির মাধ্যমে বাংলাদেশের মামলা চালানো ‘ফিউটাইল’ বা নিষ্ফলা চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই হবে না। সেই সেনাশক্তি হঠাৎ করেই মানবিক হয়ে উঠবে, এমন প্রত্যাশা যে বাস্তবসম্মত নয়, তা কে না জানে!

২০২০ সালে একবার বাংলাদেশের সীমানার অভ্যন্তরে দুই কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছিল মিয়ানমারের সমর হেলিকপ্টার। এটি ছিল বাংলাদেশের ‘পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া বাধানোর’ মিয়ানমারের তরিকা। কেউ কেউ মনে করেন, তাঁরা বাংলাদেশের ‘পালস টেস্ট’ বা খেমটি পরখ করে দেখতে এই নাটক করেছে। ভাগ্যিস বাংলাদেশ মিয়ানমারের এই পাতা ফাঁদে পা দেয়নি। ধৈর্য দেখিয়ে চুপ করে থেকেছে। ২০২০–এর নির্বাচনের কিছুদিন আগে সেনাদের মুখপত্রগুলোতে একটি দাবি করা হয় যে বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন মিয়ানমারের অংশ। সেনাদের সামাজিক মাধ্যমে সেই দাবি ব্যাপকভাবে প্রচারিতও হয়। সেবারও বাংলাদেশ কূটনৈতিক ধীমত্তা দেখিয়েছিল। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে মিয়ানমারের গায়ে পড়ে বিরোধ বাধানোর চেষ্টায় জল ঢেলে দিয়েছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশ যে মিয়ানমারেরর সেনাশাসকদের মিষ্টি কথায় আর সহজে পটবে না, সে কথা বলাই বাহুল্য।

২০১৭, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে মিয়ানমার এমনই কূটনৈতিক শক্তি দেখিয়েছে যে জাতিসংঘে বেশির ভাগ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোও বাংলাদেশের পক্ষে-বিপক্ষে না দাঁড়িয়ে রোহিঙ্গা বিষয়ে নীরব ও নিস্পৃহ থেকেছিল। কারণ, অর্থনৈতিক স্বার্থ। ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সালের তথাকথিত দো-আঁশলা সেনাশাসিত গণতন্ত্রকে ধনী দেশগুলো বৈধতা দিয়েছিল নিজেদের স্বার্থে। মিয়ানমারের অনুত্তোলিত খনিজ সম্পদ, অসামান্য বনজ সম্পদ ও অনাহরিত সামুদ্রিক সম্পদে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে তারা। অস্ত্র বিক্রয় এবং সামরিক প্রশিক্ষণসেবা বিক্রয় করত অনেক দেশ। এসব কারণে সেনারা অসংখ্য বাণিজ্যিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্বের আসন দখল করে নেওয়ায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর একটি বণিক চরিত্র তৈরি হয়েছে। তারা যতটা না সেনাবাহিনী, তার চেয়ে বেশি ব্যবসায়ী।

এবারের আকস্মিক সেনা অভ্যুত্থান তাই মিয়ানমারে পুঁজি লগ্নিকারী অনেক দেশকে রীতিমতো অর্থনৈতিক এবং নৈতিক বিপাকে ফেলেছে। সু চি তাঁর স্টেট কাউন্সিলর নামের বিচিত্র পদটিতে থাকলে দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষায় সবচেয়ে বেশি সুবিধা হতো।

৬০টির বেশি বহুজাতিক কোম্পানি সেনা পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে রেখেছে। এবারের আকস্মিক সেনা অভ্যুত্থান তাই মিয়ানমারে পুঁজি লগ্নিকারী অনেক দেশকে রীতিমতো অর্থনৈতিক এবং নৈতিক বিপাকে ফেলেছে। সু চি তাঁর স্টেট কাউন্সিলর নামের বিচিত্র পদটিতে থাকলে দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষায় সবচেয়ে বেশি সুবিধা হতো। যেহেতু কাগজে-কলমে গণতন্ত্র থাকত, লগ্নিকারীরা অনায়াসে ব্যবসা বাড়াতে পারত। এখন প্রতিটি দেশেই জনগণের কাছ থেকে তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তীব্র বাধা আসবে, যাতে স্বৈরাচারশাসিত দেশে নতুন বিনিয়োগ না হয়, পুরোনো বিনিয়োগ ফিরিয়ে আনা হয় ইত্যাদি। এবার জান্তার পক্ষ নেওয়া দেশগুলোর জন্য তাই বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।

নিজেদের বিনিয়োগ সুরক্ষার স্বার্থেই তাই দেশগুলো সেনাশাসকদের আর আশকারা দিতে চাইবে না। বরং চাপে রাখার কৌশল নিতে পারে। রোহিঙ্গা গণহত্যার দায় সেনাশাসকদের জন্য বড় দুর্বলতা। আন্তর্জাতিক মহল এ প্রসঙ্গ তুললে সেনাশাসকেরা একেবারেই কোণঠাসা হয়ে পড়বেন। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সহায়তা ও বিনিয়োগ বন্ধ ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এমনটি করতে পারে, মিয়ানমারের সেনাশাসকেরা হয়তো তা ভাবেননি। না ভাবার কারণ ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে পশ্চিমের রমরমা ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ক্রয়-বিক্রয় তার মধ্যে অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্র এ বাণিজ্যেও অবরোধ টেনেছে। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের ওপর একই রকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার একধরনের নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি হয়েছে।

ইইউ জাতিসংঘে মিয়ানমারে সেনাদের বিরুদ্ধে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ ধরনের একটি নমনীয় নিন্দা প্রস্তাব আনার পক্ষে ছিল। সামরিক অভ্যুত্থানকে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ‘অবৈধ ও অগ্রহণযোগ্য’ বলতে গাঁইগুঁই করছিল। এখন ইইউভুক্ত দেশগুলো আর নমনীয় থাকতে পারছে না। সিদ্ধান্ত পাল্টাচ্ছে। অবরোধ আরোপের বিষয়ও ভাবছে। যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেবার এমপি রুশনারা আলী দীর্ঘদিন ধরে জনমত সংগ্রহ করে আসছিলেন, যাতে যুক্তরাজ্যও গাম্বিয়ার সহযোগী হতে পারে। গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিপক্ষে গণহত্যা-অপরাধের মামলা চালাচ্ছে। কানাডা এবং নেদারল্যান্ডস এ প্রক্রিয়ায় সহযোগী হওয়ায় এবং যুক্তরাজ্যেরও অংশগ্রহণের সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় মিয়ানমারের শাসকেরা আগের মতো স্বস্তিতে মোটেই নেই।

অর্থাৎ মিয়ানমারকে অর্থনৈতিকভাবে মহা বেকায়দায় পড়তে হতে পারে। মিয়ানমারের সঙ্গে সিঙ্গাপুরেরও বাণিজ্য সম্পর্ক বিলিয়ন ডলারের। সিঙ্গাপুরও এবার কড়া ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। একই পথে চলছে জাপানও। এর কোনোটিই হতে পারে ভাবেননি মিয়ানমারের সেনাশাসকেরা। মিয়ানমারের সেলুলার টেলিফোন খাতে কম্বোডিয়ার বড় বিনিয়োগটি অলাভজনক হয়ে পড়তে গেলে কম্বোডিয়ার সমর্থনও কমতে পারে। ফেসবুক সেনাদের জন্য সব দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। সেনা কর্তৃপক্ষ কৌশলগতভাবে অনেকটাই ফেসবুকনির্ভর হয়ে উঠেছিল। ফেসবুকের মাধ্যমে ভ্রাতৃঘাতী উসকানি দিয়ে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী ও সশস্ত্র আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘাত টিকিয়ে রেখে নিজেদের বাণিজ্য বেসাতির সুরক্ষা করত। রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে ঘৃণা তৈরিতেও সেনারা ফেসবুককে ইচ্ছেমতো অপব্যবহার করেছিল।

এবার সাধারণ মানুষ ও ছাত্র-জনতার সেনাবিরোধী গণজোয়ার আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ও বেগবান। দেশের ভেতর গণ-আন্দোলন দমাতে সেনা-পুলিশের নির্মমতা এবং সাফল্যের অভিজ্ঞতা অনেক। কিন্তু এবারের আন্দোলনের তেজ-তীব্রতা এবং ভাষার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের পক্ষেও আলাপ তৈরি হচ্ছে। আন্দোলনকারীদের ভয় উবে যাচ্ছে দ্রুতই। চীনের দূতাবাসের সামনে গিয়ে তারা ঘৃণা ও তিরস্কারে ভরপুর ব্যানার টানাচ্ছে নির্ভয়ে। তরুণ-তরুণীরা সিসি ক্যামেরার নিচে দাঁড়িয়ে মেলে ধরছে প্রতিবাদী ফেস্টুন। প্ল্যাকার্ডে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনার দাবি জ্বলজ্বল করছে। অনেক প্ল্যাকার্ডে লেখা হচ্ছে ‘আমরা ভুল বুঝতে পারছি, রোহিঙ্গারা আমাদের ক্ষমা করো’। তরুণ-তরুণীরা ব্লগ-ভ্লগ ছাড়া বুলেটিনেও লিখে চলেছে যে রোহিঙ্গা নিবর্তন দ্বারা তাদের মাতৃভূমিকে একটি নিষ্ঠুর দানবরাষ্ট্ররূপে বিশ্বময় পরিচিত করানোর কারণে সেনাদের ক্ষমা করা সম্ভব নয়, এবং বিচারের আওতায় আনার পক্ষেই তাদের দাবি।

এই সময়ে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক সমাজের চাপ সৃষ্টির কূটনীতিতে নামার ভাবনা ভাবতে পারে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গাদের একটি আপৎকালীন ‘সেফ জোন’-এ বা ‘নিরাপদ এলাকায়’ পাঠানোর কৌশলসমৃদ্ধ কূটনীতি শুরু করতে পারে। অভ্যুত্থানটিকে বরং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের একটি সম্ভাবনাময় পর্বে পরিণত করে কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে পারে।

হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান। সদস্য, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়