রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাপানের বিভ্রান্তি

মিয়ানমারের উচিত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়া
মিয়ানমারের উচিত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়া

জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নরম সুরে মিয়ানমারকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ দেখিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না এবং মিয়ানমারের উচিত হবে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়া। অন্যদিকে মিয়ানমারের সরকার ও দেশটির কার্যত নেত্রী অং সান সু চি জাপানের সে রকম নরম মনোভাবে আপ্লুত হয়ে অঙ্গীকার করছেন যে রোহিঙ্গাদের জামাই আদরে ফিরিয়ে আনা হবে। তবে কীভাবে সেটা তাঁরা করবেন এবং হতভাগ্য সেই জনগোষ্ঠীর ওপর নতুন করে নিপীড়ন শুরু হওয়া প্রতিহত করার জন্য কী পদক্ষেপ তাঁরা নেবেন, তার কোনো উল্লেখ অবশ্য কোথাও করা হয়নি।

সর্বোপরি, সমস্যা তৈরি হওয়ার পেছনের যে মূল কারণ, অর্থাৎ ভিন্ন জাতিসত্তা হিসেবে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব মিয়ানমার মেনে নেবে কি না, সে বিষয়েও অং সান সু চি ছিলেন একেবারে নিশ্চুপ। জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী নেত্রীর মুখের কথায় খুশি হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে শরণার্থী পুনর্বাসনে সহায়তা করার জন্য ৩০ লাখ মার্কিন ডলারের থোক এগিয়ে দিয়ে বলেছেন যে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক অগ্রগতিতে জাপানকে দেশটি সব সময় সঙ্গে পাবে। এটাকে বোধ হয় বলতে হয় সমস্যার চমৎকার সমাধান।

মিয়ানমারের নেতৃত্ব অবশ্য খুশিতে গদগদ হয়ে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য তাৎক্ষণিকভাবে রাখাইন অঞ্চলের কিছু শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন এবং প্রথম বিদেশি নেতা হিসেবে সে রকম একটি শিবির ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি সেতু তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন। জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলা হয়েছে, সেই সেতু পার হয়ে অচিরেই শরণার্থীরা ফিরে আসবে। বাইরে থেকে তাকিয়ে দেখলে এটাকে খুবই উল্লেখযোগ্য এক অগ্রগতি বলে মনে হতে পারে। তবে ঘটনাপরম্পরা বিচার-বিশ্লেষণ করলে অনেকগুলো যে ফাঁক সহজেই চোখে পড়বে, জাপানের দৃষ্টি মনে হয় তার সবটাই এড়িয়ে গেছে। ফলে বলা যায় যে উচ্চপর্যায়ের সফর সত্ত্বেও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে শুরু থেকে ভুগতে থাকা বিভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে জাপান বের হয়ে আসতে পারেনি।

সংকট তৈরি করার জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে কি না এবং সমস্যার মূলে যে বিষয়টি, অর্থাৎ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দেশের ভিন্ন জাতিসত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পূর্ণাঙ্গ নাগরিক অধিকার এদের দেওয়া হবে কি না, গুরুত্বপূর্ণ সেই সব বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে কোনো রকম আলোচনা হয়নি। ফলে ধরে নেওয়া যায়, অগ্রগতি যেটুকু হয়েছে তার সবটাই লোকদেখানো।

এর বাইরে আরও আছে শরণার্থী প্রত্যাবাসন তদারকির দিকটি। মিয়ানমার শুরু থেকে বিদেশের কোনো রকম হস্তক্ষেপ সেই প্রক্রিয়ায় দেখতে চাইছে না। এর কারণ অবশ্য সহজেই অনুমেয়। বিদেশের বিভিন্ন নাগরিক অধিকার গ্রুপ কিংবা শান্তিরক্ষা কর্মীরা শরণার্থী প্রত্যাবাসনের দেখভাল করতে থাকলে থলের বিড়াল বের হয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে এবং সে রকম অবস্থায় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটানোর জন্য মিয়ানমারের বিশেষ কিছু মহলের বিচারের আহ্বান আরও জোরালো হয়ে উঠবে। সেই বিশেষ মহলের মধ্যে যে দেশের সামরিক বাহিনীই কেবল সম্পৃক্ত নেই, সেই সত্য এখন অনেকেরই জানা। ত্রাসের আগুন শুরুতে সামরিক বাহিনী জ্বালায়নি, বরং সেটা জ্বালিয়েছে দেশের ধর্মীয় আর রাজনৈতিক নেতৃত্ব। সামরিক বাহিনী পরে এদের দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে এগিয়ে যায়। ফলে বিচারের বাইরে এরা কোনো অবস্থাতেই থেকে যেতে পারে না। সে রকম কিছু হলে তা হবে মানবাধিকার লঙ্ঘনেরই আরও একটি নগ্ন দৃষ্টান্ত।

আর তাই জাপান এবং সমস্যা সমাধানে আগ্রহ দেখানো বিভিন্ন দেশের সেই দিকগুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়া উচিত হবে না। জাপান হয়তো মনে করে থাকতে পারে টাকার বস্তা দিয়ে সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে সব পক্ষকে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। তবে কথা হচ্ছে, সীমিত পরিমাণের যে অর্থ শরণার্থী পুনর্বাসনের জন্য দেওয়া হচ্ছে, তা কীভাবে খরচ করা হবে তারও কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। মিয়ানমার সরকারের হাতে সেই দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হলে হতদরিদ্র মানুষের জন্য বরাদ্দ অর্থের একটি বড় অংশ যে ওপর থেকেই লোপাট হয়ে যাবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। দেশটির সামরিক বাহিনীর অতীতের রেকর্ড কিন্তু সে রকম প্রমাণই তুলে ধরে। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের বিপরীতে মিয়ানমার জাপানের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতাদের কাছে অনেক বেশি কাঙ্ক্ষিত এক গন্তব্য। দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই মিয়ানমারকে জাপানের এতটা পছন্দ। জাপানের নীতিনির্ধারকদের ধারণা, মিয়ানমারের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করা হলে দেশটি চীনের দিকে আরও বেশি করে ঝুঁকে পড়বে এবং জাপান সেখানে নিজস্ব অবস্থান হারাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের বেলায় সেই দুই সম্ভাবনার কোনোটাই সে রকম তীব্র নয় বলে জাপানি নেতৃত্বের ধারণা।

অন্যদিকে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা নামের একটি রহস্যজনক গ্রুপের অস্তিত্বও জাপানকে বিচলিত করছে। তবে আরসার পেছনে ঠিক কারা আছে, তা পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত এটাকে সন্ত্রাসবাদের নব উত্থান হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, আরসা হচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে তৈরি হওয়া একটি দল, ঘটনা ভিন্ন খাতে পরিচালিত করে বিভ্রান্তির পোক্ত দেয়াল তুলে দেওয়া যাদের লক্ষ্য। আরসার ঝটিকা হামলা এবং এর ঠিক পরপর কালক্ষেপণ না করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ভয়াবহ রকমের হত্যা ও জ্বালাও-পোড়াও অভিযানে লিপ্ত হওয়া সে রকমই ইঙ্গিত দেয়। তবে বিষয়টি আরও গভীরে খতিয়ে দেখার প্রয়োজন অবশ্যই আছে। অন্যদিকে জাপানের সংবাদমাধ্যম মনে হয় সে রকম বিশ্লেষণের পেছনে সময় খরচ করতে রাজি নয়। এদের অনেকেই আজকাল বাংলাদেশের দক্ষিণে যাচ্ছে আরসার অস্তিত্ব প্রমাণ করার লক্ষ্য নিয়ে, ঠিক যেমনটা দেখা গেছে বামঘেঁষা পত্রিকা হিসেবে পরিচিত মাইনিচি শিম্বুন-এ কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে।

মাইনিচির দিল্লি ব্যুরোর জুন কানেকো ঠিক সেই উদ্দেশ্য নিয়েই শরণার্থীদের আগমনের এলাকা সফর করেছেন। সেখানে তিনি স্বঘোষিত এক আরসা যোদ্ধার দেখাও পেয়েছেন, যিনি জাপানি সাংবাদিককে বলেছেন যে আড়াই বছর ধরে তিনি আরসার সঙ্গে জড়িত আছেন। গত আগস্ট মাসে পুলিশের কয়েকটি চৌকিতে হামলা চালানোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, অনেক আরসা জঙ্গি পালিয়ে আছেন এবং পরবর্তী হামলা চালানোর নির্দেশ পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। অস্ত্র কোথায় জানতে চাওয়া হলে যোদ্ধা বলেন যে মিয়ানমারের ভেতরে গোপন এক স্থানে তাঁরা তাঁদের অস্ত্র জমা রেখেছেন। তবে এই সাক্ষাৎকারের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। শরণার্থীদের মধ্যে অনেকেই বাড়তি কিছু অর্থ প্রাপ্তির আশায় উদ্গ্রীব। হতে পারে জাপানি সেই সাংবাদিকের বাংলাদেশি পয়েন্ট ম্যান টাকার টোপ ফেলে এসব কথা সেই ব্যক্তিকে দিয়ে বলিয়ে নিয়ে থাকবেন এবং অন্যদিকে জাপানি সাংবাদিক আরসার অস্তিত্বের সন্ধান পেয়ে নিজের মিশন সফল হওয়ার অনুভূতি নিয়ে দিল্লি ফিরে গিয়ে তাঁর সেই প্রতিবেদন দাখিল করে থাকবেন।

আরসার অস্তিত্বের মতো খুবই সংবেদনশীল কিছু বিষয়ে যে আরও বিস্তারিত খোঁজখবর নেওয়ার দরকার আছে, সেই সাংবাদিকের কাছে তা মনে হয়নি। গ্রহণযোগ্য রিপোর্ট সেটা হতে পারত মাইনিচির সাংবাদিক যদি আরসা যোদ্ধার বর্ণনা করা মিয়ানমারের গ্রামে গিয়ে আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ করতেন। মনে হয়, সেই সাহস তিনি পাননি এবং বাংলাদেশের তুলনামূলক উন্মুক্ত পরিবেশের সুযোগ গ্রহণ করে দেশটিতে আরসার অস্তিত্বের কথা বিশ্বজুড়ে জানিয়ে দিয়েছেন।

মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক