রোহিঙ্গাদের কথা অরোহিঙ্গারাই বলে যাবে?

২০১৭ সালের এই দিনে রোহিঙ্গারা গণহত্যা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আসতে শুরু করে
ছবি: প্রথম আলো


উরুগুয়ের স্মৃতিতর্পণ দিবসটি উৎসবসর্বস্ব। দিনরাত মুখর থাকে পুরোনো দিনের গানে। সিনেমা হলে পুরোনো ছবি চলে। বয়স্করা মেলেন তাঁদের পুরোনো দিনের সখা-সখীদের সঙ্গে। তরুণেরা বাল্যকালের খেলার সাথি, স্কুলবন্ধুদের খুঁজে বের করেন। এসব কারণে উরুগুয়েবাসী দুনিয়াসেরা ‘নস্টালজিক জাতি’র পরিচিতি দিয়েছে। বলা হয়, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ ধরনের স্মৃতিতর্পণ উরুগুইয়ানদের স্বভাব। বাইরের দুনিয়া এভাবে তাদের নিয়ে হাস্যপরিহাস করলেও সমাজবিজ্ঞানী-নৃবিজ্ঞানীরা দিনটিকে অসামান্য দরকারি বলে ভাবেন।

এদিন উরুগুয়ের মঞ্চগুলোয় ‘মুরগাসংগীত’ নামের জমজমাট গীতিনাট্য মঞ্চস্থ হয়। ‘মুরগাসংগীত’ অনেকটা প্রহসন-নাট্য এবং সারিগান-পালাগান-দোহারের মিশ্রণ। তবে চোখধাঁধানো পোশাকি এবং চটুল ও তির্যক কথামালায় ভরপুর। সংলাপে উঠে আসে ঘুষ-দুর্নীতি-অপশাসন-অসংগতি-অব্যবস্থার কথাও। বলা হয় কোন সময়টি ভালো ছিল, কেন ভালো ছিল। আমজনতাই ‘মুরগাসংগীত’ পরিবেশন করে। তারা ইতিহাসবেত্তা সমাজবিজ্ঞানী অথবা সুপণ্ডিত না হয়েও অতীত ও বর্তমানকে বিনি সুতোর মালায় গেঁথে ফেলে।

উরুগুয়েবাসীর স্মৃতিকাতরতাও এমনি এমনি হয়নি। ১৯৭৩ সালে সামরিক শাসকের উৎপীড়নে অনেক উরুগুয়েবাসী ইউরোপ-আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। কিন্তু তাঁদের হৃদয়ে স্বদেশের মায়া। ভাবনায় প্রিয়জনের স্মৃতিমাখা অতীতের ঘোর। দাদি-নানিদের মুখে অতীতের গল্প ছিল উরুগুয়ের একটি ঐতিহ্য। পরবাসী ভিন্নমতাবলম্বীরা সেটিকে ছুড়ে ফেলেনি, বরং তাঁদের সন্তানদের মধ্যে বহুগুণে ছড়িয়ে দিয়েছে। মধ্য-সত্তরে নিজেরাই, বিশেষত তরুণেরা গেরিলা কায়দায় ‘মুরগা’কে জনপ্রিয় করে তোলেন। তাতে অতীতের সৌকর্যগাথা এবং তখনকার সময়ের দুঃশাসনের ফিরিস্তি থাকত। এভাবে তাঁরা সামাজিক ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখলেন গানে ও কথায়। ১৯৭৮ সালে একজন ডিসকো মালিকের পরিকল্পনায় দিনটির শুরু। ১৯৭৯ সাল থেকে প্রতিবছর টিভি, রেডিও, মঞ্চ, সিনেমা, সংস্কৃতিকেন্দ্রগুলোও ‘স্বর্ণালি অতীত’কে উপজীব্য করতে নামল।

রোহিঙ্গাদের ‘সামষ্টিক স্মৃতি’ কী বা সংরক্ষণেরও কেন বিকল্প নেই ইত্যাদি আলোচনায় যাওয়ার প্রয়োজনেই উরুগুয়ের একটি বিচিত্র দিবসের আলাপ দিয়ে লেখাটি শুরু করছি। উরুগুয়েতে একটি ‘নস্টালজিয়া ডে’ বা ‘স্মৃতিতর্পণ দিবস’ (যদিও রাতে উদ্‌যাপন হয়) আছে। শুধু ‘আছে’ নয়, এটি জাতীয় দিবস। সরকারি ছুটির দিন। এই দিনে অতীত স্মৃতি ঘেঁটে বহুভাবে আনন্দ–উল্লাস করা যায়। দুঃখ-কষ্টের স্মৃতিতে হাউমাউ করে প্রাণখুলে কান্নাও করা যায়। স্বাধীনতা দিবসের আগের দিনটিই (২৪ আগস্ট) ‘নস্টালজিয়া ডে’। স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন হওয়ায় উরুগুয়েবাসী দুই দিন ছুটি পায়। আমেরিকা-কানাডায় বা ইউরোপে স্থায়ী হওয়া উরুগুয়েবাসী দিনটির জমজমাট উদ্‌যাপনে নামে।

দুঃখজনকভাবে ২৪ ও ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের জন্য আমৃত্যু বিভীষিকার স্মৃতিময় দুটি দিন। ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের সেনা-পুলিশ ও উগ্রবাদী বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া, ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ এবং গণহত্যা-ধর্ষণ-রাহাজানি শুরু করে। আহত, অর্ধমৃত, ভীতিগ্রস্ত, দিগ্ভ্রান্ত রোহিঙ্গারা ২৫ তারিখে পালাতে শুরু করে। এই দুঃসহ স্মৃতি তাদের আমৃত্যু তাড়া করবে। কিন্তু তাদেরও গণহত্যাপূর্ব অনেক গল্প, স্মৃতিগাথাও আছে। দাদি-নানি পূর্বসূরিদের মুখে শোনা শত শত বছর আগের আনন্দের-ভালোবাসার-হাসি–কৌতুকের স্মৃতি।

চীন, জাপান, রাশিয়া, ভারত এবং আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর অবস্থান ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ ধরনের। অর্থনৈতিক স্বার্থই তাদের আসল মাথাব্যথা।

দিনটির কারণে গল্প বলার ঐতিহ্য টিকে রইল। দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বা শিশুশ্রেণিতে পড়া বাল্যবন্ধুর নামটি ভুলল না কেউ। ফেসবুক আসার বহু আগেই উরুগুয়ে হয়ে উঠল জৈবিক ফেসবুক। সবকিছু ছাড়িয়ে দিনটি হয়ে উঠল বছরজুড়ে দাদি-নানিদের কাছ থেকে অতীতের গল্পগুলো টুকে নেওয়ার দিন। গল্পে গল্পে সমাজ ও ইতিহাস তুলে ধরা অতীত-বর্তমানের মেলবন্ধন ঘটাল। ফলে আশির দশক থেকে দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় সব কটি দেশে ‘ওরাল হিস্ট্রি’ বা ‘গল্পকথায় ইতিহাস’ নতুনভাবে জনপ্রিয়তা পেল। এখন নিম্নবর্গের ও প্রান্তিক মানুষেরাই ইতিহাসবেত্তা। তাদের কথা, বক্তব্য ও সামষ্টিক স্মৃতিই সামাজিক পাঠাগার। সমাজবিজ্ঞানীদের ভাষায় ‘সাংস্কৃতিক সম্পদ’। তাদের প্রতিনিধিত্ব তারা নিজেরাই করে। অন্যকে দিয়ে নিজেদের কথা বলাতে হয় না। আত্মবিশ্বাস হারাতে হয় না। অন্যের চাপিয়ে দেওয়া জ্ঞানের চাপে পিষ্ট ও অবদমিত থাকতে হয় না। তার প্রমাণ মেলে উরুগুইয়ানদের দেশপ্রেমে। সামরিক শাসনের অবসানের পর ধনী দেশগুলোয় অভিবাসনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে স্বদেশে ফেরেন সিংহভাগ উরুগুইয়ান। এখনো তাঁদের অভিবাসনমুখিতা ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম।

দুই.
আমরা কি কখনোই জানতে চেয়েছি রোহিঙ্গাদের গণহত্যার আগের স্মৃতিগুলো কেমন? রোহিঙ্গারা নিজেরা আসলে কী চায়? তারা অন্তরের সুগভীর কথাগুলো কি বলতে পেরেছে? তাদের মধ্যে পাওলো ফ্রেইরির ‘পেডাগজি অব দ্য অপ্রেসড’ বা ‘অবদমিতের পাণ্ডিত্য’–এর অস্তিত্ব কি আদৌ আছে? মিয়ানমারে তাদের ‘ভাষা’ ছিল না। ‘প্রতিনিধিত্ব’ও ছিল না। বাংলাদেশেও নেই। রোহিঙ্গাদের হয়ে ঠিক-বেঠিক সব কথা আমরা অরোহিঙ্গারাই বলি। আমরা কি আসলেই তাদের কথাগুলোই বলছি? নিম্নবর্গে বাস হলেও তাদের সেই বর্গে ফেলার উপায় নেই। কারণ তারা বহিরাগত, আশ্রিত এবং আমাদের সামাজিক কাঠামোর নয়। ‘নেতৃত্ব’ রাজনীতির ধারণা—এ রকম বিবেচনার কারণে তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দূরে থাক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নেতৃত্বই গড়ে ওঠেনি।

কথা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ‘সামষ্টিক স্মৃতি সংরক্ষণ’ এবং নিজেদের কথা বলতে পারার কেন বিকল্প নেই? কারণ, সমস্যাটির সমাধানের ক্ষেত্রে তাদের ভাষ্য, চাওয়া-পাওয়া, স্মৃতিকাতরতা, এবং স্বাধিকার ও স্বদেশভাবনার প্রকাশ দরকার। ‘সামষ্টিক স্মৃতি’ একটি ‘সাংস্কৃতিক সম্পদ’। উদ্যোগের অভাবে স্পষ্টই রোহিঙ্গারা সেটি হারাতে বসেছে। ভুলতে বসেছে স্বজাত্যবোধ, স্বাধিকারের ইচ্ছা, আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের তাগিদ, ফেরার তাড়না। পরনির্ভরশীল দয়াদাক্ষিণ্যের জীবযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে তারা হয়তো বাংলাদেশেই স্থায়ী আসন গেড়ে বসতে চাইবে। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার মধ্যে সাত রাজ্যের সমস্যা লুকোনো। নিরাপত্তাহীনতা, উগ্রবাদ, মানব, মাদক ও অস্ত্র পাচার, আঞ্চলিকতাবাদ, ভৌগোলিক ও পরিবেশ বিপর্যয়, অর্থনৈতিক সমস্যা—সবই লুকানো।

২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বিতাড়নের তৃতীয় বছরে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ ২৪ আগস্ট একটি বিশেষজ্ঞ সম্মেলনের আয়োজন করে। উদ্দেশ্য, সমস্যাটির একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথনির্দেশ পাওয়া। সম্মেলনে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার দুই বর্তমান রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশের বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিবদ্বয় ও মালয়েশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীও এই পথনির্দেশনা দেন যে সমস্যাটির ধরন আঞ্চলিক নয়, আন্তর্জাতিক। ফলে, দ্বিপক্ষীয়, বহুপক্ষীয়, আন্তর্জাতিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমস্যাটি সমাধানের জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই।

চীন, জাপান, রাশিয়া, ভারত এবং আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর অবস্থান ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ ধরনের। অর্থনৈতিক স্বার্থই তাদের আসল মাথাব্যথা। মিয়ানমারে অর্থনৈতিক বিনিয়োগের লাভালাভ-সম্ভাবনা যেহেতু ব্যাপক, মানবিকতার পক্ষে দেশগুলোর আদর্শিক অবস্থান শূন্য। মিয়ানমারে চীনের লগ্নি বিলিয়ন ডলারের। বিশেষ শিল্পাঞ্চল গঠন, গভীর সমুদ্রবন্দর, রাখাইন পর্যন্ত তেল-গ্যাস ও রেললাইন স্থাপন, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)—চীনের এসব দক্ষযজ্ঞের আর্থিক লাভ সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসের মতো।

অর্থনৈতিক আধিপত্য দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের রাজনৈতিক কর্তৃত্বও প্রতিষ্ঠা করবে। উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি ভারতের শক্তিও খর্ব করা যাবে। ভারতও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কারণে মিয়ানমারকে অসন্তুষ্ট করবে না; বরং সব রকমের ছাড় দেবে। একই বাস্তবতা রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের বেলায়ও। অর্থাৎ সমস্যাটির সমাধানে যুগ যুগ সময় লাগবে। এই সুযোগে মিয়ানমার ‘রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি বহিরাগত’ তত্ত্বটিই প্রতিষ্ঠিত করে ছাড়বে।

এ অবস্থার বিপরীত প্রস্তুতি হিসেবে রোহিঙ্গাদের ‘সামষ্টিক স্মৃতি’ সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক রোহিঙ্গা এথনোগ্রাফি দরকার। নৃবিজ্ঞানীদের ওর‍্যাল হিস্ট্রি সংকলনগুলো দীর্ঘসূত্রী সমাধানের প্রক্রিয়ায় অত্যাবশ্যক তথ্যসহায়তা-সূত্র হয়ে উঠবে নিশ্চিত। সবচেয়ে বড় কথা, রোহিঙ্গাদের স্বদেশমুখী মানসিক শক্তি, উদ্দীপনা ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্যই ‘সামষ্টিক স্মৃতি সংরক্ষণ’ অত্যাবশ্যক।

হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।