রোহিঙ্গাদের জন্য এই আন্তরিকতা লইয়া কী করিব

রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের মনোভাব মোটেও বদলায়নি


এক ঝড়ের রাতে সচিবালয়ের লনের জামগাছটি পতিত হয়। আর তার নিচে চাপা পড়ে একজন মানুষ। মালি-চাপরাশি-ক্লার্ক হয়ে সংবাদটি সুপারিনটেনডেন্ট পর্যন্ত পৌঁছায়। চারপাশে ভিড় জমে যায়। কেউ কেউ জামগাছের সুস্বাদু জাম খাওয়ার স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকে। চাপা পড়া মানুষটি তখনো বেঁচে আছে জেনে তারা বিস্মিত হয়। কেউ কেউ গাছটি সরাতে চাইলেও সুপারিনটেনডেন্ট তাঁর আন্ডার সেক্রেটারির অনুমতি নেওয়ার জন্য ছুটলেন। সরকারি দপ্তরের গাছ বলে কথা। আন্ডার সেক্রেটারি বিষয়টি ডেপুটি সেক্রেটারিকে জানালেন। ডেপুটি সেক্রেটারি গেলেন জয়েন্ট সেক্রেটারির কাছে। জয়েন্ট সেক্রেটারি চিফ সেক্রেটারির কাছে। চিফ সেক্রেটারি মন্ত্রীর কাছে।

একই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে নির্দেশ নেমে এল আন্ডার সেক্রেটারির কাছে। ততক্ষণে মধ্যাহ্ন পেরিয়ে যাচ্ছে বলে কেউ কেউ গাছ কেটে চাপা পড়া মানুষটিকে বের করতে চাইলেও আন্ডার সেক্রেটারি এসে জানালেন এই গাছ কাটা যাবে না। কারণ, বাণিজ্য দপ্তরের চত্বরে গাছের অবস্থান হলেও গাছের মালিকানার সঙ্গে যেহেতু কৃষি দপ্তর ও পরিবেশ দপ্তরের সম্পর্ক আছে, সেহেতু বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। এভাবে বেলা গড়ায় কিন্তু গাছ আর কাটা যায় না। একসময় দেখা যায়, চোখের তারা স্থির হয়ে থাকা চাপা পড়া মানুষটির মুখের ভেতর অনেকগুলো পিঁপড়া ঢুকছে আর বের হচ্ছে।

জনপ্রিয় উর্দু লেখক কৃষণ চন্দর তাঁর ‘জামগাছ’ গল্পে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এভাবেই জামগাছের নিচে পড়ে গিয়ে একজন নিরীহ মানুষের জীবনাবসানের কাহিনি তুলে ধরেছিলেন। কৃষণ চন্দরের জামগাছ কাটতে না পারার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আধুনিক সভ্য ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্রকুলের আচরণে বেশ একটা মিল দেখা যায়।

জামগাছের নিচ থেকে মানুষটিকে বের করা খুব জটিল কাজ না হলেও তা শেষ পর্যন্ত জটিলতম কাজে রূপ নিয়েছিল। আর রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারে জাতিনিধন, নিপীড়ন, গণহত্যা, সুনির্দিষ্ট কিছু গ্রামের নাম মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা, বুলডোজার চালিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেলে যাওয়া বাড়িঘরের অবশিষ্টাংশ গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাগুলো ঘটেছে, যা নিপীড়ক সেনাসদস্যের জবানিতে ফাঁসও হয়েছে। অপরদিকে আরও গণহত্যামূলক কার্যক্রম প্রতিরোধ ও সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত গণহত্যার আলামত সংরক্ষণ করার জন্য ২০২০ সালের শুরুতে আন্তর্জাতিক আদালত নির্দেশ দিয়েছেন এবং ২০২১ সালের শুরুতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার-চীন-বাংলাদেশ বৈঠকেও মিলিত হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান যেন জটিল থেকে জটিলতম বিষয়ে পরিণত হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে এ সমস্যার টেকসই সমাধান কতটুকু চায়, সেটিও এখন প্রশ্নের মুখে। মং জার্নির মতে, চীন-ভারত বা পশ্চিমা দেশ—সবাই এ বিষয়ে দ্বিচারিতার আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মনোযোগ কেবল ত্রাণ কর্মসূচি ও আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখা।

এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক আদালত যখন রোহিঙ্গাদের পক্ষে মিয়ানমারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তখন অনেকেই উল্লসিত হয়েছিল এ সমস্যার সমাধান হতে যাচ্ছে ভেবে। কোনো কোনো নীতিনির্ধারক এমনও বলেছিলেন যে এখন থেকে মিয়ানমার সতর্কতার সঙ্গে আচরণ করবে। কিন্তু রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের মনোভাব মোটেও বদলায়নি। মিয়ানমার যে এ বিষয়ে নিজের অবস্থান থেকে নড়বে না, তা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছিলেন রোহিঙ্গাদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা মানবাধিকারকর্মী মং জার্নি। ২০১৭ ও ২০২১ সালে প্রথম আলোয় তাঁর সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। সেখানে মং জার্নি বলেন, ‘বাংলাদেশকে প্রত্যাবাসনের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। মনে রাখতে হবে, তাদের চূড়ান্ত স্ট্র্যাটেজিক স্কিম হচ্ছে রোহিঙ্গাদের জাতিসত্তা, তার ইতিহাস, পরিচিতি ও আইনগত অবস্থান ধ্বংস করা।’ (জানুয়ারি ১৫, ২০২১)।

রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের অবস্থান শুরু থেকেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। ২০১৭ সালের অক্টোবরে দেশটির স্টেট কাউন্সেলর ব্রুনেইয়ে বলেছিলেন, তাঁর সরকার ‘নিষ্পাপ’ এবং তাঁরা যদি অজান্তে কোনো অন্যায় করে থাকেন, তাহলে প্রচলিত আইনমতে তা শুধরে নেবেন। ২০১৯–এর ডিসেম্বরে একই ব্যক্তি আন্তর্জাতিক আদালতের ভেতরে বসে তাঁর দেশের বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছিলেন এগুলো ‘অসম্পূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর’। তাহলে কেমন করে আশা করা যায়, ২০২১–এর জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে তৃতীয়বারের মতো প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনায় রোহিঙ্গাদের পক্ষে অবস্থান নেবে মিয়ানমার? উপরন্তু, মিয়ানমার সব সময় বলে আসছে এটি তার দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। ১৯ জানুয়ারির ত্রিপক্ষীয় বৈঠকেও তারা এ অবস্থানে অনমনীয় থেকেছে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গঠনমূলক অংশগ্রহণ বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন করে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে এ সমস্যার টেকসই সমাধান কতটুকু চায়, সেটিও এখন প্রশ্নের মুখে। মং জার্নির মতে, চীন-ভারত বা পশ্চিমা দেশ—সবাই এ বিষয়ে দ্বিচারিতার আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মনোযোগ কেবল ত্রাণ কর্মসূচি ও আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখা। অপরদিকে কোনো রাষ্ট্রের ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয়ে আসিয়ান, ওআইসি প্রভৃতি আঞ্চলিক জোট নীতিগতভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে না বলে এসব সংস্থাও রোহিঙ্গা বিষয়ে নীরব। তাহলে বাংলাদেশের পাশে আদৌ কি কেউ আছে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে?
সংবাদমাধ্যমের সূত্রমতে, নতুন ২ লাখ ৩০ হাজার মিলিয়ে ছয় দফায় মিয়ানমারের কাছে ৮ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দিয়েছে বাংলাদেশ, যার মধ্যে মাত্র ৪২ হাজার জনের তালিকা যাচাই করেছে মিয়ানমার। তারপরও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে বলে আশাবাদী। তিনি অবশ্য মিয়ানমারের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। প্রশ্ন আসে, বাংলাদেশই বা এত আন্তরিকতা নিয়ে রোহিঙ্গাদের সমস্যার টেকসই সমাধানে কী করতে পেরেছে? শরণার্থী প্রতিপালনে সেরা দেশ হলেও শরণার্থী প্রত্যাবাসনে আন্তরিকতার চাইতে যে কূটনীতির দক্ষতা ও কৌশল বেশি দরকারি ছিল, সেটি কি বাংলাদেশ সরকার মানতে নারাজ?

সরকারি নথিপত্র ও সরকারি ওয়েবসাইটে তাই রোহিঙ্গারা ‘বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী’, ‘অভিবাসী’, ‘ঝুঁকিগ্রস্ত সম্প্রদায়’ হলেও ঠিক শরণার্থী নয়। প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের ধারাবাহিকভাবে প্রহসনমূলক আচরণ প্রত্যক্ষ করলেও বাংলাদেশ তাই তৃতীয় কোনো দেশে রোহিঙ্গাদের পাঠানোর (resettlement) ব্যাপারে নিষ্ক্রিয়। কূটনীতির অদক্ষতাকে ঢাকতে তাই ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরকেই উত্তম বন্দোবস্ত হিসেবে চালানোর চেষ্টা করা হয়। শরণার্থী প্রতিপালনের চার দশক পার হলেও শরণার্থীবিষয়ক কোনো রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রণয়নের কথাও তাই কারও মনে হয়নি।
রোহিঙ্গা নিধনের ঘটনায় ভূরাজনৈতিক অনুষঙ্গকে যতটা গুরুত্বের সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমলে নেয়, এর পেছনে মিয়ানমার সরকারের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হওয়াকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করতে অনেকেই অস্বস্তি অনুভব করেন। মং জার্নি কিন্তু মিয়ানমার সরকারের মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাবের কথা নির্দ্বিধায় বলেছেন।

কৃষণ চন্দরের জামগাছের নিচে পড়ে মারা যাওয়া মানুষটির মতো রোহিঙ্গারা মারা না গেলেও ১১ লাখ মানুষ নৃগোষ্ঠী পরিচয় সংকট নিয়ে বেঁচে থাকবে। বাংলাদেশ তাদের ব্যাপারে যে আন্তরিকতা দেখাচ্ছে তা না বাংলাদেশের জন্য শুভ, না রোহিঙ্গাদের জন্য কল্যাণকর। আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্তের এক বছর পার হলেও নিজস্ব পরিচয় ও মাতৃভূমি রেখে রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রহীন-পরিচয়হীন। আর কিছুদিন পর কি তারা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা থেকে বাংলাদেশি রোহিঙ্গা পরিচয় ধারণ করবে? রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের আন্তরিকতা তখনই সুফল আনবে, যখন এর সঙ্গে যুক্ত হবে কূটনৈতিক বিচক্ষণতা।

ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ এবং কো-অর্ডিনেটর, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়