লকডাউন আত্মঘাতী, গণটিকা কর্মসূচিই সমাধান

লকডাউন বা বিধি নিষেধ অকার্যকর হয়ে পড়েছে
ছবি: প্রথম আলো

মহামারি নিয়ন্ত্রণে লকডাউন একটি পুরোনো ও কার্যকর কৌশল হলেও এর কার্যকারিতা নির্ভর করে স্থান, কাল ও পাত্রের ওপর। বাংলাদেশ প্রথম থেকেই লকডাউন তত্ত্বের সফল প্রয়োগ ঘটানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কখনো সাধারণ ছুটির মোড়কে, আবার কখনো সর্বাত্মক কিংবা কড়া মেজাজে বারবার লকডাউন ঘোষণা আজ হরতালের মতো ফিকে হয়ে গেছে। বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশে লকডাউন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যে কতটা কঠিন, তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং মাঠ প্রশাসন হয়তো ভালোভাবে আঁচ করতে পেরেছে। আমাদের বাড়িঘরের বিন্যাস, পরিবারের সদস্য অনুযায়ী ঘরের কাঠামো, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি কোনোটাই লকডাউন সফল করার অনুকূলে নয়।

তা ছাড়া কমিউনিটিতে সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর লকডাউন যে তেমন কোনো কার্যকর পন্থা নয়, তা তো নীতিনির্ধারণী মহলের অজানা থাকার কথা না। তাহলে কেন বারবার লকডাউন দেওয়া হচ্ছে, সেটিই বড় প্রশ্ন। আবার কখনো অনেক দেরি করে কিংবা কখনো মাঝখানে বিরতি দিয়ে লকডাউন ঘোষণা করে আমরা কি এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করছি না যে করোনা আমাদের আজ্ঞাবহ?

যাঁরা লকডাউনের পরামর্শ দেন, তাঁরা হয়তো বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় লকডাউন সফল করা সম্ভব নয়—এ বিষয় তলিয়ে দেখার চেষ্টা করেন না। জনগণ উদ্বুদ্ধ না হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং মাঠ প্রশাসনের নিরন্তর প্রচেষ্টায় মহাসড়কে কিছুটা সাফল্য অর্জন করতে পারলেও সারা দেশের লাখ লাখ অলিগলিতে তা কোনোক্রমেই সফল করা সম্ভব নয়। আর দীর্ঘদিন ধরে লকডাউন থাকলে সাধারণ মানুষের উদ্বুদ্ধ হওয়ার সামর্থ্য কোথায়?

আবার আসন্ন লকডাউনে তৈরি পোশাকশিল্পসহ সবকিছু বন্ধ রাখার জন্য ভিন দেশের চাপের গুঞ্জনও শুনতে পাচ্ছি। লকডাউন না দিলে তো এসব বিষয়ের ওপর কোনো চাপ থাকবে না। যে রাষ্ট্রীয় শক্তি দিয়ে লকডাউন পালনের চেষ্টা করা হচ্ছে, সেই শক্তি দিয়ে যদি জনগণকে মাস্ক ব্যবহার ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় উদ্বুদ্ধ কিংবা বাধ্য করা হয়, তাহলে হয়তো সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে লকডাউনের তুলনায় অনেক ভালো ফল আসবে। অন্যদিকে, অর্থনীতিকে ধ্বংসের হাত থেকেও বাঁচানো যাবে। তাই খেটে খাওয়া মানুষকে তথা জাতিকে রক্ষা করতে লকডাউনের মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে আসুন।

তবে টিকাই যে সংক্রমণ দমনের টেকসই পন্থা, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। আর টিকার প্রচলন শুরুর পর প্রতিদিন নিত্যনতুন বিষয়ও হাজির হচ্ছে। যেমন, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশ নির্দিষ্ট টিকা গ্রহণ ছাড়া প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মস্থলে ফিরতে দিচ্ছে না। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো টিকা গ্রহণের সনদ ব্যতিরেকে বহির্বিশ্বগামী বিমানে চড়া নিষিদ্ধ হবে। তবে আশার কথা, গণটিকা কর্মসূচি পুনরায় চালু হয়েছে। সরকারের অব্যাহত চেষ্টা এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের আন্তরিক সহযোগিতায় দেশে টিকা আসতে শুরু করেছে। মানুষের মধ্যেও টিকা গ্রহণের আগ্রহ অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ডেলটা ভেরিয়েন্ট গ্রামগঞ্জে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় করোনা–সম্পর্কিত ভুল ধারণা এবং মিথ ভাঙতে শুরু করেছে, যা টিকা নেওয়ার আগ্রহকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে।

অন্যদিকে, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ টিকা উৎপাদনকারী দেশের জনগণের একটি বড় অংশকে টিকা প্রদান করায় সেসব দেশে টিকার চাহিদা কমতে শুরু করেছে। একই সঙ্গে টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগতভাবে উৎপাদন বাড়াচ্ছে। তা ছাড়া আরও বেশ কিছু টিকা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের শেষ ধাপে রয়েছে। তাই ভবিষ্যতে টিকা আমদানিতে তেমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমাদের আর্থিক সামর্থ্য থাকলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে পর্যাপ্তসংখ্যক টিকা আমদানি করা সম্ভব। উল্লেখ্য, আমাদের কোভিড ব্যবস্থাপনা অনেকটা বিদেশি ঋণনির্ভর। আর ঋণের সুদের বোঝা যে কত বড়, তা আমরা এ বছরের জাতীয় বাজেটে সুদ বাবদ প্রদেয় অর্থের অঙ্ক থেকে জেনেছি।

দ্রুত বেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হলে একদিকে যেমন বিপুলসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক নিযুক্ত করা প্রয়োজন, যাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, এমনকি কমিউনিটি ক্লিনিকে বসে মানুষকে টিকা নিবন্ধনে সহযোগিতা করবেন। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের এ কাজে নিযুক্ত করলে একদিকে তাঁদের কোভিডকালে একঘেয়েমিপনা কমবে, অন্যদিকে কিছু অর্থ সংস্থানের মাধ্যমে পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবেন। সেই সঙ্গে জনসেবায় আত্মনিয়োগেরও প্রশিক্ষণ পাবেন। একই সঙ্গে টিকাদানকেন্দ্র উপজেলা থেকে পর্যায়ক্রমে ইউনিয়ন এবং কমিউনিটি পর্যায়ে বিস্তৃত করতে হবে।

চেষ্টা করলে ইপিআইয়ের মতো কোভিড টিকাদানেও বাংলাদেশ রোল মডেল হয়ে উঠতে পারে। আর জাতি হিসেবে টিকে থাকতে এই চেষ্টা আমাদের করতেই হবে। তাই এখন আর কোনো লকডাউন নয়, বরং আমাদের টিকা আমদানি, নিবন্ধন ও প্রদানের সক্ষমতা সৃষ্টির ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়