লকডাউন এবং আইনের প্রয়োগ

লকডাউনের প্রথম দিনে জরুরি কাজ ছাড়া বাইরে বের হওয়া মানুষকে জরিমানা করে র‌্যাবের ভ্রাম্যমান আদালত। এ সময় গাড়ি থামিয়ে আরোহীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেখা যায়। সোমবার রাজধানীর শাহবাগে।
ছবি: সাজিদ হোসেন

মঙ্গলবারের প্রথম আলোর দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় একটা ছবি ছাপা হয়েছে। ক্যাপশনে আছে, লকডাউনের প্রথম দিনে জরুরি কাজ ছাড়া সড়কে বের হওয়া মানুষকে জরিমানা করছে রাজধানীর শাহবাগে র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। গাড়ি থামিয়ে আরোহীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেট।

লকডাউনসংক্রান্ত যে নির্দেশাবলি সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে, সাধারণ মানুষ সে সম্পর্কে জেনেছে রেডিও, পত্রিকা, টেলিভিশন ইত্যাদি গণমাধ্যম থেকে। তাতে এ বিষয়ে নির্দেশনা বেশ স্পষ্ট। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত জরুরি কাজ ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না। সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত এ রকম কোনো বাধানিষেধ নেই। আমার এই বোঝার মধ্যে কোনো ভুল আছে কি না, কয়েকজনকে আমি তা জিজ্ঞেস করেছি। প্রত্যেকেই বলেছেন নির্দেশনার বক্তব্য তাই।

ছবিটা থেকে স্পষ্ট যে এ ঘটনাটা দিনের বেলায় ঘটছিল। সে ক্ষেত্রে কি এই ভ্রাম্যমাণ আদালত সরকারি নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটাচ্ছেন না? নাগরিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব কি অনধিকার চর্চা করছেন না? আর যদি সরকারের সিদ্ধান্ত থেকে থাকে যে দিনের বেলায়ও জরুরি কাজ ছাড়া বেরোনো যাবে না, তাহলে তা স্পষ্ট করা হোক। এক বছর ধরে মানুষ এমনিতেই দুশ্চিন্তা এবং উদ্বেগে আছে নিজের এবং প্রিয়জনদের নিরাপত্তা নিয়ে। নির্দেশনার অস্পষ্টতায় তাদের মানসিক অশান্তি আর বাড়ানো কেন।

আমার বাসার বারান্দা থেকে গুলশান-বারিধারা সংযোগকারী পুলটা দেখা যায়। সোমবার রাত আটটা পর্যন্ত তার ওপর দিয়ে অবিরাম গাড়ি চলাচল প্রত্যক্ষ করেছি। মঙ্গলবারও তা-ই দেখছি। নির্দেশনা অনুযায়ী এদের জরিমানা করার কথা, দিনের বেলায় যাঁরা শাহবাগ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁদের নয়।

সরকারি নির্দেশনায় আরও বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, যা যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে না। বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে পথেঘাটে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে দেখি মুখোশ ছাড়া বা থুতনিতে মুখোশ লাগিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের নিবৃত্ত করার বা জরিমানা করার কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ল না।

এবারের সীমিত লকডাউন জারি হয়েছে এক সপ্তাহের জন্য। বলা হচ্ছে, পরিস্থিতি বুঝে তা বাড়ানো হতে পারে। পরিস্থিতি ভালো নয়, কাজেই হয়তো লকডাউনের মেয়াদ বাড়বে। গত বছরের লকডাউনে প্রান্তিক মানুষ দুর্দশায় পড়েছিলেন। দুর্দশা লাঘবে সরকারি প্রচেষ্টা খুব একটা সফল হয়নি, রিলিফের চাল-ডাল প্রচলিত নিয়মে অনেকটাই স্থানীয় প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের প্রান্তিক কর্মজীবীরা রোজগারের ব্যবস্থা হারিয়ে এবারও কষ্টে পড়বেন।

পৃথিবীতে এ রকম পরিস্থিতিতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো মানবিক সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে। আমাদের দেশে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি যত দেখা যায়, মানবিক কাজে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অনাগ্রহও ততই স্পষ্ট। বিপুলসংখ্যক মসজিদ আছে শহরের মহল্লাগুলোতে। প্রান্তিক মানুষের জন্য মসজিদকেন্দ্রিক সহায়তা কেন্দ্র চালু করতে পারে না কি ধর্মীয় নেতারা এবং তাদের স্থানীয় পৃষ্ঠপোষকেরা? সবকিছুই সরকারকে করতে হবে এমন তো কথা নেই।

তবে কিছু বিষয় আছে, যা সরকারকেই করতে হবে এবং সেখানে হতাশ হয়ে হাত তুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করলে চলবে না। দৈনিক সংক্রমণ কদিন যাবৎ ছয়-সাত হাজার ছাড়িয়েছে, হাসপাতালগুলোতে জায়গা নেই। দুঃখের নাটকে মাঝেমধ্যে কিছু কৌতুককর ঘটনা থাকে, যাকে কমিক রিলিফ নামে অভিহিত করা হয়। করোনাকালজুড়ে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে তাঁর বিভিন্ন বাক্যালাপে কমিক রিলিফ জুগিয়েছেন। আজ টিভিতে দেখলাম তিনি বলেছেন, রোজ যদি চার-পাঁচ হাজার করে সংক্রমণ বাড়তে থাকে, তাহলে সারা ঢাকা শহরকে হাসপাতাল বানিয়েও সামাল দেওয়া যাবে না! দারুণ কথা!

তবে এখানে যদির কিছু নেই, পাঁচ হাজারের বেশি সংক্রমণ হচ্ছে বেশ কদিন ধরেই। এক মাস ধরে দৈনিক সংক্রমণ পাঁচ হাজার হলে দেড় লাখ রোগী হবে, এরপর কিন্তু সংখ্যাটা আর বাড়বে না। কারণ, এর মাঝে এক থেকে দেড় শতাংশ মারা যাবেন এবং বাকিরা পর্যায়ক্রমে সুস্থ হতে থাকবেন। দৈনিক সংক্রমণ না কমলেও রোগীর সংখ্যা আর বাড়বে না, এটা সহজ হিসাব। আর দেড় লাখ রোগীর মাঝে অধিকাংশই হালকা অসুস্থ হয়ে বাড়িতে চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়ে যাবেন, বড়জোর শতকরা ২০ ভাগ বা মোট ৩০ হাজার রোগীর হাসপাতাল সেবা লাগবে। ১৮ কোটি লোকের দেশে ৩০ হাজার রোগীর জন্য হাসপাতাল সেবা দেওয়ার সামর্থ্য থাকা উচিত পুরো ঢাকা শহরকে হাসপাতাল না বানিয়েও।

বিজ্ঞানীরা শুরু থেকেই বলছেন, দ্বিতীয় এমনকি তৃতীয় ধাক্কা আসবে। তাতে কর্ণপাত না করে আমরা মগ্ন ছিলাম সংক্রমণ এবং মৃত্যু হ্রাসের কৃতিত্বে অবগাহনে। পরিস্থিতি যখন আবার খারাপের দিকে, তখন আইসিইউ, অক্সিজেন ও ন্যাজাল ক্যানোলার অভাব স্বাস্থ্যকর্মীদের দুশ্চিন্তায় ফেলছে। এই অভাব দূর করে সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছিলাম আমরা, যার সঠিক ব্যবহার হয়নি। অর্থহীন বাক্যব্যয় না করে, এখনো এসবেই দ্বিগুণ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন দেশের স্বাস্থ্য নেতৃত্বের।

মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব