লতার দেশে আমি

 সকালে হাঁটতে গিয়েছি গুলশান ইয়ুথ ক্লাবে। কাউকে চিনি না, নতুন প্রজন্মের মানুষ আমাদের জায়গা দখল করে নিয়েছেন। দারোয়ান বললেন, আপনাকে আর সাইন করতে হবে না। আপনাকে চিনি। আপনি আব্বাসউদ্দীন। তাঁর ভুল ভাঙালাম না। বেচারা অদ্দুর পর্যন্ত এসেছে, এই-বা কম কী! মাত্র কয়েক দিন আগে ঘুরে এলাম পশ্চিমবঙ্গের মালদহ থেকে। সেখানে ৫৩ শতাংশ মুসলমান, মুর্শিদাবাদে ৬০ শতাংশ মুসলমান। ওরা আমার আব্বাকে ভুলতে পারেনি। প্রতিবছর অনুষ্ঠান করে। বিশেষ করে মাদ্রাসার ছেলেমেয়েরা আব্বাকে ভক্তি করে অন্তর থেকে। তাঁরা বললেন, গান শুনতে চাই না, বক্তৃতা শুনতে চাই না, শুধু আপনাকে দেখতে চাই। কারণ, আপনি আব্বাসউদ্দীনের শেষ চিহ্ন। আপনার কণ্ঠে তাঁরই বিভা। অভিভূত হয়ে দু-চার কথা বললাম। জানালাম ইতিহাসের কথা। মালদহ, মুর্শিদাবাদ দেশবিভাগের সময় পাকিস্তানের ভাগে পড়ার কথা ছিল। সব ঠিকঠাক। পরে খান এ সবুর বললেন, যশোর, খুলনা, বাংলাদেশে থাকতেই হবে। তা না হলে কিছুই মানি না। র‍্যাডক্লিফ সাহেব বাধ্য হয়ে মালদহ, মুর্শিদাবাদকে দিলেন পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। আমরা পেলাম যশোর, খুলনা। মুর্শিদাবাদে মুসলিম ঐতিহ্যের যে চিহ্ন দেখে এসেছি তা অনন্য। সারা পৃথিবী থেকে অনেক মানুষ এসে বাংলার অতীতের এই কর্মকাণ্ড দেখে যাচ্ছেন প্রতিবছর। অথচ আমাদের অনেকের জানাই নেই।

সেখানে অলি-আউলিয়ার অবস্থান ও মাজারগুলো দেখে এসেছি। মুসলমানেরা সেগুলো আঁকড়ে ধরেছেন। প্রতি ওরসে লাখ লাখ মানুষের ঢল। ওদের অবস্থার উন্নতি হয়নি। কৃষিক্ষেত্রে ও সামান্য ব্যবসা-বাণিজ্যে ওরা ভালোই আছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওদের ফেলে দেননি। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে ৩৩ শতাংশ মুসলমান। সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। মমতা ভালোবাসা দেখিয়েছেন মুসলমানদের, মুসলমানেরাও তাঁকে তেমনি ভালোবাসে।

মালদহের অনুষ্ঠানে ভালো লাগল কোচবিহার থেকে আসা শিল্পীদের গান। গানের আগে সুখবিলাস বর্মা, যিনি গত ৩০ বছর আব্বাসউদ্দীনকে বাঁচিয়ে রেখেছেন পশ্চিম বাংলায়, তাঁর কথাগুলো ছিল প্রণিধানযোগ্য। কোচবিহারের অবহেলিত রাজবংশী ও শেখ মুসলমানদের গান এই ভাওয়াইয়া অবলুপ্তির পথে। বাঁচিয়ে রেখেছেন সুখবিলাস বর্মার মতো কয়েকজন উৎসাহী পণ্ডিত। তিনি যখন গাইলেন, ‘গান গান করিয়া সর্বনাশ, তবু না মিটিল মনের হাউস’, আমিও গিয়ে যোগদান করলাম। হলটি যেন আনন্দে ফেটে পড়ল। তাঁরা বললেন, এমন গান কোনো দিন শুনিনি। ভাওয়াইয়া গান সবার গান, সবাই গাইতে পারে। মনটি হওয়া দরকার রাজবংশীর, দরিদ্র মুসলমান শেখের। বলা বাহুল্য, আমার গান শুনে সবার চোখে পানি। আবার কবে আসব জানি না। গাইলাম, ‘কোন দিন আসিবেন বন্ধু, কয়া যাও কয়া যাও রে’। কলকাতায় যে ভাওয়াইয়া ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তার প্রমাণ ‘মনদরিয়া’র শিল্পীদের প্রাণ উচ্ছ্বাস।

কলকাতা থেকে আসা শিল্পী ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী পরপর তিনটি ভাওয়াইয়া গেয়ে শোনান। সচরাচর বলা হয়ে থাকে যে কলকাতার শিল্পীরা ভাওয়াইয়া গাইতে পারে না, যদিও চটকায় সবাই পার পেয়ে যান। ইন্দ্রাণী গাইলেন আব্বাসউদ্দীনের সবচেয়ে পরিচিত তিনটি গান। সবশেষে তিনি গান ‘দেওয়ায় করছে মেঘ মেঘালি’ আমার সঙ্গে। আমি ইতিপূর্বে গেয়েছিলাম ফেরদৌসী রহমান, নাশিদ কামালের সঙ্গে বেশ কয়েকবার। তাঁর পরিবেশনায় বারবার উঁকি দিয়ে গেল কুমারী হেমলতা ঘোষ, যিনি গেয়েছিলেন আব্বার সঙ্গে। তাঁকে সাধুবাদ জানাই।

মালদহে কী পেলাম? ভালো লাগল গ্রামবাসীর মধ্যে শিক্ষার প্রচলন। সবাই বুঝেছেন, শিক্ষা না হলে ওপরে ওঠা যাবে না। মুসলমানেরাও এত দিনে তা বুঝেছে। আমার হোস্ট সাজিরউদ্দিন জানালেন, এখনকার শিক্ষকেরা বেশির ভাগ মুসলমান। কলেজের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন স্কুলের, ভালো শিক্ষকের। তাঁরা জেনেছে নজরুল-আব্বাসউদ্দীনকে বাদ দিয়ে কিছু হবে না। রবীন্দ্রনাথ বড়লোকদের কবি। তাঁকেও বাদ দেওয়া যাবে না। একসঙ্গে চলছে রবীন্দ্রনাথ-আব্বাসউদ্দীন। এ রকম আর কোথাও দেখিনি, আগরতলা ছাড়া। পশ্চিমবঙ্গে, কলকাতায় এখন বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ বেড়ে গেছে। প্রতি মাসে বাংলাদেশের শিল্পীরা আমন্ত্রিত। আমি ছাড়া আর সবাই। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, ওদের বন্যাদি, অদিতি মহসিন ও অন্যরা কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত। হওয়ারই কথা। কারণ, আমাদের রবীন্দ্রসংগীত ওদের মন জয় করেছে। নেই আব্বাসউদ্দীন, নেই আবদুল আলীম। তবে মাঝে মাঝে দেখা যায় ফেরদৌসী রহমান ও নাশিদ কামালকে। জায়গাটা ছিল আমাদের, অথচ আমরা নির্বিকার।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।