লাকিংমে চাকমা আমাদেরই মেয়ে

প্রতীকী ছবি

কক্সবাজার সদর হাসপাতালে এখনো পড়ে আছে মেয়েটির লাশ। লাশটি সৎকারের অধিকার প্রশ্নে চলছে লড়াই। এই মেয়ে জীবিত অবস্থায় অপহরণ এবং বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছিল। ১৪ বছর বয়সী এই শিশু লাকিংমে চাকমা মৃত্যুর আগে জন্ম দিয়েছিল আরেকটি শিশুর। লাকিংমে চাকমা অপহরণ ও বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছিল। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হলে হয়তো শেষ পর্যন্ত মেয়েটিকে মরতে হতো না।

পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে আমরা জানতে পারি যে এই বছরের ৫ জানুয়ারি লাকিংমেকে অপহরণ করা হয়। কক্সবাজারের টেকনাফে শীলখালীর চাকমাপাড়ায় বসবাসরত মেয়েটির বাবা এ অভিযোগ করেছেন। মেয়েটি স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। তিনি বিষয়টি ওই দিনই স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মোহাম্মদ হাফেজকে জানান। কিন্তু ইউপি সদস্য কোনো ব্যবস্থা নেননি। শুধু তাই নয়, অভিযোগ আছে, এক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বয়সের একটি মিথ্যা সনদও দিয়েছেন।

মেয়েকে বাড়িতে না পেয়ে এবং অপহরণের কথা শুনে প্রথম মেয়েটির বাবা টেকনাফ মডেল থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু সেখানে মামলা নেওয়া হয়নি। কেন নেওয়া হয়নি, এর কোনো জবাব কখনো মিলবে কি? বাংলাদেশে থানাগুলো কখন কার মামলা গ্রহণ করবে আর কারটা করবে না, সে বিষয়ে কি কোনো দিকনির্দেশনা আছে?

পরে মেয়েটির বাবা কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে কক্সবাজার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব দেন (সূত্র: প্রথম আলো: ১৯ ডিসেম্বর)। তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই কক্সবাজার ইউনিটের পরিদর্শক তাঁর প্রতিবেদনে চতুর্দশী মেয়েটি নিজে চলে গেছে বলেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন। কারণ হিসেবে তিনি যুক্তি দিয়েছেন, যারা এ অপহরণের সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাঁরা মেয়েটির আত্মীয়। কিন্তু সাধারণ যুক্তি বলে বাড়িতে থাকা লোকদেরই মূল ঘটনা জানার কথা।

তাদের দেওয়া তথ্যকেই আমলে নেওয়া উচিত। অন্য কেউ অপহরণের ঘটনা দেখেনি বা শোনেনি তাই এটা অপহরণ হবে না, এটা কোনো যুক্তির কথা হতে পারে না।

এই এগারো মাস মেয়ের কোনো খোঁজ পাননি বাবা লালা অং চাকমা। নিখোঁজ মেয়ের প্রথম খোঁজ পান এই মাসেই। তখন তাঁর মেয়েটি আর জীবিত নেই। মেয়ের লাশ নিজের কাছে আনতে গেলে জানতে পারেন তাঁর মেয়ে শুধু অপহৃতই হয়নি, মেয়েটি বাল্যবিবাহের শিকারও হয়েছিল। মেয়েটির অপহরণ ও বাল্যবিবাহ কোনোটিরই বিচার হয়নি, এমনকি সেগুলোকে কেউ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবেও বিবেচনা করেনি। বাবা উল্টো শুনেছেন মেয়ের মৃত্যুসংবাদ। কিন্তু এখন মেয়ের মৃতদেহের সৎকার নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। টানাহেঁচড়ায় লাকিংমে এখনো আছেন হাসপাতালের মর্গেই।

লাকিংমে চাকমার অপহরণ, বাল্যবিবাহ এবং পরে তার মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। তাতেও পরিস্থিতির কোনো হেরফের হয়নি। কোনো ঘরানার নারী সংগঠনের পক্ষ থেকেই কোনো প্রতিবাদের কথা শোনা যায়নি। কেউ লাকিংমের বাবাকে সহযোগিতার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়নি।

আমরা কার জন্য বিচার চাইব আর কার জন্য চাইব না, সেটিও কেমন যেন ঠিক হয়ে থাকে। এর ফাঁকেই পড়ে থাকে লাকিংমের মতো প্রান্তিক মেয়েরা, যাদের জীবন কোনোভাবেই কারও কাছে মূল্যবান হয় না। না রাষ্ট্র, না সমাজ, না আন্দোলনকর্মী, কারও কাছেই তারা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই জীবিত থাকতে যেমন অপহরণের শিকার হয়, তেমনি মরে গিয়েও দিনের পর দিন পড়ে থাকতে হয় হাসপাতালের মর্গে। অথচ এর বিপরীতে আমাদের দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে লাকিংমে চাকমা আমাদেরই মেয়ে।

তার অপহরণ, বাল্যবিবাহ এবং মিথ্যা জন্মসনদ সরবরাহকারীদের যেমন আইনের আওতায় আনতে হবে, তেমনি তার মরদেহের যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে আমাদেরই।

জোবাইদা নাসরীন শিক্ষক

নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

zobaidanasreen@gmail. com