লাদাখে চীনের উদ্দেশ্য পূরণ হবে না

গত জুনে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় দুই দেশের সেনাদের মধ্য সংঘর্ষ হয়
ছবি: রয়টার্স

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই সম্প্রতি বলেছেন, চীনা জাতির ‘জিনে’ আগ্রাসন ও বিস্তারবাদ নেই। হতবাক করার মতো বিষয় হলো কথাটি তিনি একেবারে নির্লিপ্তভাবে বলেছেন। এ কথা বলার সময় তাঁর মুখ–চোখ কোঁচকায়নি। আগ্রাসন ও বিস্তারবাদ মানুষের জিনে থাকে না এ কথা সত্যি। তবে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের শাসনকালকে তাঁর পূর্বসূরি মাও সে তুংয়ের সম্প্রসারণবাদের উত্তরাধিকার বলা যেতে পারে। তারও অনেক আগে যখন চীনা সম্রাটেরা তাঁদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে হানা দিতেন এবং পরে তাদের বশীভূত করে কর আদায় করতেন, সেই অতীতকেও চিন পিংয়ের শাসন মনে করিয়ে দিচ্ছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সি চিন পিংয়ের উদ্দেশ্য পূরণে কোভিড–১৯ আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। মহামারিতে জেরবার হয়ে সারা বিশ্ব যখন কী করে এ মহাবিপদ থেকে বাঁচা যায় সেই উপায় খুঁজছিল, ঠিক সে সময় সি চিন পিং তাঁর পিপলস লিবারেশন আর্মিকে (পিএলএ) চীনের সীমান্ত লাগোয়া ভারতের লাদাখের ভূখণ্ড দখল করে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সেখানে ভারী সেনা উপস্থিতি ঘটিয়েছেন।

তবে সি চিন পিং এটিকে যত চালাকিপূর্ণ পরিকল্পনা বলে ভেবেছিলেন, আদতে তেমনটি নয়। চীনের এই আগ্রাসী তৎপরতার কারণে ইন্দো-প্যাসিফিক
শক্তিগুলো তার বিপক্ষে গেছে। এদের মধ্যে চীনের প্রধান প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রও আছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, প্রযুক্তিগতসহ নানা দিক থেকে অবরোধ আরোপ করেছে। চীনের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল পাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে চাপে পড়েছেন সি চিন পিং।

তবে চীন এখনো হিমালয়সংলগ্ন সীমান্তে তার বিস্তারবাদী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে এবং আত্মপক্ষ সমর্থনে সি চিন পিং এটিকে সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা বলে দাবি করছেন। ভারতও পাল্টা ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত আছে। গত জুনে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় পিএলএ ভারতীয় জওয়ানদের ওপর হামলা চালানোর পর শুধু ভারতীয় সেনারা নিহত হননি। অজ্ঞাতসংখ্যক পিএলএ সদস্যও নিহত হয়েছেন। গত চার দশকে জাতিসংঘ শান্তি মিশনের বাইরে এই প্রথম কোনো লড়াইয়ে চীনা সেনা নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় সি চিন পিং নিজের দেশবাসীর সামনে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। কারণ, ভারত তার নিহত সেনাদের বীরের মর্যাদায় শেষকৃত্যানুষ্ঠান করলেও চীনের পক্ষ থেকে তাদের সেনা নিহতের কথা স্বীকার পর্যন্ত করা হয়নি।

চীন মনে করেছিল সহজেই ভারতের সীমানায় ঢুকে পড়া যাবে। কিন্তু ভারত এখন তার সীমান্তে পর্যাপ্ত সেনা ও রসদ মোতায়েন করেছে। আসন্ন শীতেও যাতে সেখানে পাহারা দেওয়া যায় সে জন্য ইতিমধ্যেই সেখানে বিভিন্ন স্থাপনা বসানো হয়েছে। চীনের জন্য সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ হলো তার সেনা অবস্থান সার্বক্ষণিক নজরে রাখতে প্যাংগং হ্রদের দক্ষিণে থাকা পাহাড়চূড়ায় ইতিমধ্যে ভারতীয় সেনারা ঘাঁটি গেড়েছে। চীনের সেনাদের মতো ভারতীয় সেনারা সীমানা লঙ্ঘন না করলেও তারা একেবারে চীনের নাকের ওপর স্থায়ী সামরিক শিবির বসিয়েছে।

সি চিন পিং সর্বশেষ যে আধিপত্যবাদী অভিযানে নেমেছেন, সেটিকে হাইব্রিড ওয়ারফেয়ার বলা যায়। দক্ষিণ চীন সাগরে তিনি একটা গুলি না ছুড়েও সেখানকার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছেন। কিন্তু একইভাবে হিমালয়সংলগ্ন সীমানায় তার দখলদারি প্রতিষ্ঠা সহজ হবে না

ওদিকে তিব্বতকেও ভারত এ বার্তা দিচ্ছে, চীন তিব্বতের মালিকানা যত জোরালোভাবে দাবি করে আসছে, আদতে সেই দাবির পক্ষে আন্তর্জাতিকভাবে ততটা জোরালো সমর্থন নেই। তিব্বতিরা চীনকে নৃশংস আগ্রাসনবাদী দেশ হিসেবে জানে। তিব্বত দখলের জেরেই চীন ভারতের হিমালয়সংলগ্ন অরুণাচল প্রদেশের অংশ দাবি করে থাকে। চীন যদি তিব্বত দখল করে থাকে তাহলে কীভাবে তারা তিব্বত–সংলগ্ন ভারতের ভূখণ্ড দাবি করে?

সি চিন পিং সর্বশেষ যে আধিপত্যবাদী অভিযানে নেমেছেন, সেটিকে হাইব্রিড ওয়ারফেয়ার বলা যায়। দক্ষিণ চীন সাগরে তিনি একটা গুলি না ছুড়েও সেখানকার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছেন। কিন্তু একইভাবে হিমালয়সংলগ্ন সীমানায় তার দখলদারি প্রতিষ্ঠা সহজ হবে না। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনী চীনের, কিন্তু ভারতের সেনাশক্তিও কম নয়। এ ছাড়া পার্বত্য এলাকায় লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা চীনের চেয়ে ভারতীয় সেনাদের বেশি। ফলে সি চিন পিংয়ের লাদাখ দখলের স্বপ্ন এত সহজে পূরণ হবে না।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

ব্রহ্ম চেলানি: দিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের অধ্যাপক