লাল তালিকার হুঁশিয়ারি

লাল রং যুদ্ধ আর বিপ্লবের প্রতীক, ভালোবাসারও প্রতীক। লাল বৈচিত্র্যপূর্ণ অর্থ তৈরি করে অন্য শব্দের সঙ্গে মিশেও। যেমন লাল বই। ব্রিটেনে লাল বই আদালতের নিয়মাবলির, অস্ট্রেলিয়ায় গাড়ির দামসংক্রান্ত, আবার চীনে ছোট লাল বই মানে চেয়ারম্যান মাও সে তুংয়ের বাণীসংকলন।

লাল রং বা লাল বই বহু অর্থ বহন করলেও লাল তালিকা মানেই বর্জিত বা নিষিদ্ধ কিছু। বিভিন্ন দেশের পরিবেশ আইনে লাল তালিকা মানে সবচেয়ে দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পকারখানা। করোনাকালের এই সময়ে লাল তালিকা মানে ভ্রমণ তালিকায় নিষিদ্ধ দেশ। এমন তালিকা নিয়ে বাদানুবাদও রয়েছে। যেমন বাংলাদেশের মন্ত্রীরা মনে করেন, ইউরোপে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের জন্য নিষিদ্ধ দেশের যে লাল তালিকা করেছে, সেখানে বাংলাদেশকে রাখা অযৌক্তিক।

লাল তালিকা প্রাণবৈচিত্র্য বিষয়ে উদ্বিগ্ন মানুষের জন্য বহন করে বিশেষ একটি অর্থ। লাল তালিকা মানে বিপন্ন প্রাণী, উদ্ভিদ ও কীটপতঙ্গের তালিকা। প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্য বিষয়ে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান আইইউসিএন এমন তালিকা প্রস্তুত করার কাজের সূচনা করে ১৯৬৮ সাল থেকে। তবে এ বিষয়ে মানুষের মনোযোগ সত্যিকার অর্থে নিবদ্ধ হয় ১৯৯২ সালের রিও সামিট বা ধরিত্রী সম্মেলন থেকে। এই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আদি চুক্তির পাশাপাশি প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি (কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি) গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্র এই চুক্তির সদস্য।

প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯২ সালের চুক্তি ছাড়াও কিছু বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় চুক্তি রয়েছে, আছে তালিকাভুক্ত বিপন্ন প্রজাতির ওপর কঠোর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাসংক্রান্ত বিভিন্ন আইন। তবে প্রাণবৈচিত্র্য ঠিক কী অবস্থায় রয়েছে, তা বোঝার জন্য আইইউসিএন রেড লিস্টের বিকল্প নেই।

মাত্র কয়েক দিন আগে প্রকাশিত সর্বশেষ এই রেড লিস্ট নিয়ে সারা পৃথিবীর পরিবেশসচেতন মানুষের মধ্যে নানা ধরনের আলোচনা চলছে। ফ্রান্সে আইইউসিএনের কংগ্রেসে বিপন্ন প্রাণী ও তার আবাসস্থল (হ্যাবিটেট) রক্ষার কর্মকৌশল উন্নততর করার জন্য কাজ করছেন বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞরা।

পৃথিবীর উন্নত বহু দেশ নিজ দেশের বিপন্ন প্রাণীর ওপর নিয়মিত গবেষণা করে তাদের রক্ষার কর্মসূচি নিচ্ছে। তারা এবং যাদের এমন উদ্যোগ নেই, দুই পক্ষের জন্য লাল তালিকা মূল্যবান দলিল। কারণ, প্রকৃতি রাজনৈতিক মানচিত্রে বিভাজিত নয়, এক দেশের প্রাণবৈচিত্র্য অন্য দেশের (বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের) ওপর তাই নির্ভরশীল। আইইউসিএন রেড লিস্ট একটি সার্বিক চিত্র প্রদান করে এ সম্পর্কে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই চিত্র যতই উদ্বেগজনক হোক, অবস্থার তেমন উন্নতি হচ্ছে না অনেক অঞ্চলে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো অতি জনবহুল দেশগুলোতে।

বাংলাদেশে প্রাণবৈচিত্র্যের অবস্থা আসলে অনেক ভয়াবহ। সেটি বোঝার জন্য আমাদের চারপাশে যেসব দূষণ, বন উজাড়, পরিবেশবিনাশী উন্নয়ন প্রকল্প আর জীবাশ্ম জ্বালানির যথেচ্ছ ব্যবহার দেখি, তা–ই যথেষ্ট।

২.

আইইউসিএনের লাল তালিকায় প্রতিবারের মতো এবারও স্থান পাওয়া প্রজাতির সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে সংকটাপন্ন ও অস্তিত্ববিপন্ন প্রাণীর সংখ্যা। যেমন এবারের তালিকায় স্থান পাওয়া ১ লাখ ৩৮ হাজার প্রজাতির মধ্যে ৯০২ প্রজাতি সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, অন্যদিকে ৩৮ হাজার ৫০০ প্রজাতির অস্তিত্ব রয়েছে হুমকির মুখে। এর মধ্যে কোনো কোনো প্রজাতির অবস্থা মারাত্মক পর্যায়ে। যেমন তালিকাভুক্ত উভচর প্রাণীর ৪১ শতাংশের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে।

লাল তালিকা তারপরও প্রাণবৈচিত্র্য বিপন্ন হওয়ার পুরো চিত্র তুলে ধরতে পারেনি। আইইউসিএন নিজে বলেছে যে তারা মূলত ভূমিতে, বিশেষ করে নির্দিষ্ট ধরনের ইকোসিস্টেমের প্রজাতির ওপর গবেষণায় জোর দিয়েছে। অন্যদিকে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের ক্ষেত্রে এটি অনেকটা অসম্পূর্ণ। আইইউসিএনের ভাষ্যমতে, তারা বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকির এই স্টাডি করেছে পৃথিবীর মাত্র ৬ শতাংশ প্রজাতির ওপর। তারপরও এটি যে চিত্র তুলে ধরেছে, তাতে স্পষ্ট যে প্রাণবৈচিত্র্যের সংকট দিন দিন বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে।

এর আগে গ্লোবাল ট্রি স্পেশালিস্ট গ্রুপের গত মাসের একটি প্রতিবেদনে (স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ড ট্রিস) বলা হয়েছিল, চাষাবাদ, বসতি ও উন্নয়নের জন্য বন উজাড় করা, বনজ দ্রব্য ভোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাদের তালিকায় থাকা পৃথিবীর প্রায় ৬০ হাজার বৃক্ষ প্রজাতির মধ্যে ৩০ শতাংশের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। এর মধ্যে ১৪২টি প্রজাতি চিরতরে বিলুপ্ত হয়েছে এবং ৪৪২ প্রজাতির গাছের সংখ্যা এখন ৫০–এর কম।

এসব তালিকায় এবং অন্য বিভিন্ন গবেষণায় প্রাণবৈচিত্র্য বিপন্ন হওয়ার জন্য মানুষের কর্মকাণ্ডকে দায়ী করা হয়েছে। অন্যদিকে খুব কম ক্ষেত্রে হলেও বিভিন্ন সংরক্ষণব্যবস্থা গ্রহণ করার সুফলের উদাহরণও রয়েছে। যেমন ২০১১ সালে আইইউসিএনের লাল তালিকায় বিশ্বব্যাপী খাদ্য হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাছ টুনার অস্তিত্ব প্রায় বিপন্ন ধরা হয়েছিল। কিন্তু গত এক দশকে এটি ধরার কোটা বাস্তবায়ন, অবৈধ মৎস্য শিকারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা, মাছ ধরার প্রক্রিয়া উন্নীতকরণ, টুনার আবাসস্থলে দূষণরোধসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে অধিকাংশ টুনা প্রজাতির সংখ্যা এখন নিরাপদ স্তরে পৌঁছেছে।

অনেক ক্ষেত্রে আবার সংরক্ষণের বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা কাজে দেয়নি। যেমন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে ভূপৃষ্ঠে সবচেয়ে ভারী লিজার্ড হিসেবে পরিচিতি কমোডো ড্রাগনের বিপন্ন হয়েছে গত কয়েক দশকে।

উন্নত বিশ্বের আগ্রহ ও আন্তরিকতা রয়েছে এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়ার, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের। কিন্তু এর বড় অভাব দেখা যায় কম উন্নত, জনবহুল ও সুশাসনের অভাব রয়েছে, এমন দেশগুলোতে। ফলে সার্বিক অবস্থার অবনতি ঠেকানো যাচ্ছে না কোনোভাবে।

প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় বাংলাদেশে আইন, নীতি ও কর্মকৌশলের অভাব নেই। কিন্তু এসবের বাস্তবায়ন যে কতটা খেলো পর্যায়ে রয়েছে, তা আমরা শুধু বুড়িগঙ্গা নদী আর সুন্দরবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইকোসিস্টেমের দিকে তাকালে বুঝতে পারি।

৩.

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশ বন বিভাগের একটি প্রকল্পের অধীনে আইইউসিএন বাংলাদেশ অফিস ২০০০ সালে বাংলাদেশে বিপন্ন প্রাণীদের একটি লাল তালিকা প্রস্তুত করে। ২০১৬ সালে এটি আপডেট করা হয় ১ হাজার ৬১৯ প্রজাতির ওপর সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে। আপডেট তালিকায় বিপন্ন প্রাণীর সংখ্যা বেড়েছে। যেমন ২০০২ সালে তালিকায় ২৬৬ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৫৪টিকে হুমকির মুখে বলা হয়। ২০১৫ সালের হালনাগাদ লাল তালিকায় ২৫৩টিকে স্টাডি করা হয়, এর মধ্যে হুমকির মুখে রয়েছে ৬৪ প্রজাতি।

আইইউসিএন বাংলাদেশের প্রতিবেদনটি অসম্পূর্ণ ও নানাভাবে সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশে প্রাণবৈচিত্র্যের অবস্থা আসলে অনেক ভয়াবহ। সেটি বোঝার জন্য আমাদের চারপাশে যেসব দূষণ, বন উজাড়, পরিবেশবিনাশী উন্নয়ন প্রকল্প আর জীবাশ্ম জ্বালানির যথেচ্ছ ব্যবহার দেখি, তা–ই যথেষ্ট। মাঠে–ঘাটে, নদীতে-বাজারে আমাদের কয়েক দশকের সাধারণ অবলোকন–অভিজ্ঞতা থেকেও তা অনেকটা বোঝা যায়।

প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় বাংলাদেশে তাই বলে আইন, নীতি ও কর্মকৌশলের অভাব নেই। গত এক দশকে প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার জন্য বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বায়োডাইভারসিটি অ্যাক্ট, বায়োসেফটি রুলস, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন, প্রটেক্টেড এরিয়া রুলস এবং ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া রুলস, ন্যাশনাল বায়োসেফটি স্ট্র্যাটেজি ও অ্যাকশন প্ল্যান। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে, বন, জ্বালানি সম্পদ, নদী ও জলাভূমিসংক্রান্ত বিভিন্ন আইন ও নীতিও হয়েছে। কিন্তু এসবের বাস্তবায়ন যে কতটা খেলো পর্যায়ে রয়েছে, তা আমরা শুধু বুড়িগঙ্গা নদী আর সুন্দরবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইকোসিস্টেমের দিকে তাকালে বুঝতে পারি।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মানুষের ভোগলিপ্সা ও আত্মকেন্দ্রিকতা, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, জিডিপি বাড়ানোর নিরন্তর প্রতিযোগিতা আর কুশাসনের কুফল হিসেবে বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে প্রাণবৈচিত্র্য দিন দিন আরও হুমকির মুখে পড়ছে। বাড়ছে লাল তালিকার স্ফীতি। এসব অব্যাহতভাবে চললে মানুষের অবস্থাও একদিন হতে পারে লাল তালিকার বিপন্ন প্রাণীর মতো।

আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক