লিটনের বাসা ও টু-লেটের ভেংচি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

এক্কেবারে আনকোরা একটা দা নিয়ে ভ্যানের ওপর রাখা ডাবে কোপ বসাচ্ছিল লিটন। কোপ ঠিকমতো বসছিল না। এই কাজে সে নতুন। আনাড়ি হাত এখনো ডাব কাটায় অভ্যস্ত হয়নি। 

‘কী রে লিটন, খবর কী?’—ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করতেই সে কোপ বসাতে বসাতে আসিফ আকবরের ‘এত কষ্ট মেনে নেয়া যায় না’ গানটার প্যারোডি সুরে গেয়ে উঠল, ‘এত কষ্ট ভ্যানে নেয়া যায় না, ভ্যানে নেয়া যায় না।’ আমি বললাম, ‘কারণ কী রে পাগলা?’ সে আবার হেসে দিয়ে গেয়ে উঠল, ‘করোনা আমারে পথে বসায় দেছে, আমি যে এহন বেচি ডাব...’। হাসতে হাসতেই সে বলল, ‘খাড়ান, কাস্টোমার ছাইড়ে নেই, তারপর কথা কই।’ 

এমনিতে অবশ্য লিটন কখন হাসে আর কখন স্বাভাবিক কায়দায় কথা বলে তা বোঝা কঠিন; কারণ, তার সামনের পাটির দাঁত এমন পজিশনে বসানো এবং কথা বলার সময় তার চোখ এমনভাবে বুজে আসে যে সে কথা বললেই মনে হয় হাসছে। এই ছেলের সঙ্গে আমার মেলাদিনের খাতির। দেশের বাড়ি একই জেলায়, আমরা দুজনই ‘আদি গোপালী’। 

লিটনের ‘কাস্টোমার’ বিদায় হওয়ার পর তাকে নিয়ে পাশের দোকানে গেলাম। চায়ে চুমুক দিতে দিতে হাসতে হাসতে অনেক কষ্টের কথা বলল সে। মাসখানিক আগে পর্যন্ত সবুজবাগে পাঁচ ফুট বাই দশ ফুট সাইজের একটা দোকান ছিল তার। অ্যাপার্টমেন্ট টাইপের বড় বাসা না নিতে পারলেও দোকানের খুব কাছে ছোট একটা ভাড়া বাসায় মা, বাবা ও বোনকে নিয়ে থাকত সে। ওইটুকু দোকানে তিন বেলা তিন আইটেমের খাবার বিক্রি করত। ভোর সাতটায় দোকান খুলত। সেদ্ধ আটার রুটি, সঙ্গে ডাল, সবজি ও হালুয়া। তার মা রাতেই সবজি-টবজি সব রান্না করে ফেলতেন। শ খানিক আটার রুটি বেলে রেডি করে রাখতেন। লিটন ভোরে রুটি আর সবজি নিয়ে দোকানে চলে আসত। খদ্দের অর্ডার করলে সে শুধু রুটি সেঁকে তাদের পাতে দিত। দুপুরে ভর্তা–ভাত, মাছ আর ডাল। খুব কম দামে খাওয়ার সুযোগ থাকায় শ্রমজীবীরা এ সময় বেশি ভিড় করত। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত শুধু চটপটি আর ফুচকা। 

ভালোই আয়–রোজগার ছিল। সেই লিটন এখন আক্ষরিক অর্থেই পথে বসে গেছে। তিন মাস দোকান বন্ধ। রোজগারপাতি নাই। ট্যাঁকের টাকা ভেঙে খেতে হয়েছে। ওদিকে দোকান বন্ধ থাকলেও ভাড়া মাফ পায়নি। শেষে আর কুলিয়ে উঠতে পারেনি সে। দোকান ছেড়ে দিয়েছে। সেই দোকান এখন ব্যাংকের বুথ হয়েছে। উপায় না পেয়ে খিলগাঁও বাজার থেকে আড়াই শ টাকা দিয়ে একটা দা আর যাত্রাবাড়ীর আড়ত থেকে শ খানিক ডাব কিনে এনে সেই বুথের সামনে ভ্যান দাঁড় করিয়ে লিটন এখন ডাব বেচছে। থাকার জন্য আগে যে ঘর ভাড়া নিয়েছিল, তা সে ছেড়ে দিয়ে মা–বাবাকে নিয়ে নন্দীপাড়া ছাড়িয়েও প্রায় গ্রাম এলাকায় ইরিধানের খেতের পাশে বাসা ভাড়া নিয়েছে। নতুন যে বাসায় উঠেছে, তার ভাড়া আগের বাসার ভাড়ার চেয়ে অনেক কম। আগের বাসায় যে নাগরিক সুবিধা ছিল, নতুন বাসায় সে তুলনায় প্রায় কিছুই নেই।

লিটন বলছিল, ‘কারে দোষ দেব কন? সবাই তো আমার মতো মাইনকের চিপায় পড়ছে। দ্যাহেন না, খালি টু-লেঠ আর টু-লেঠ। কোরবানির পর এই টু-লেঠ আরও বাড়বে। কোরবানিতি যারা দ্যাশে যাবেনে, তার আদ্দেকই আর ফিরে আসবেনানে। যে আগে দশ হাজার টাহার বাসায় থাকত, সে গেছে পাঁচ হাজার টাহার বাসায়। যার সেই ক্ষমতাও নাই, সে খোদা হাফেজ কইয়ে ঘটিবাটি গুছাইয়ে গিরামে ভাগতিছে।’

আমি বললাম, ‘সরকার এই যে এত প্রণোদনা দিল, নগদ টাকাপয়সা দিল...’ লিটন কথা শেষ করতে দিল না। সে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ধুর! কী সব আগডুম–বাগডুম বুঝান? করোনা-মরোনার কথা কইয়ে অফিসাররা সরকারের ক্যাশের টাহা সব সরায় ফেলতিছে। গরিব মানুষ কিচ্ছু পায় নাই। টিটমেনটের কথা কয়ে হাজার হাজার কুটি টাহা মাইরে দিচ্ছে। ফেসবুকে সব ফিলাশ হয়ে যাচ্ছে দেহেন না! মরতিছে নরমাল পাবলিক।’ 

লিটনের সব কথা শোনার পর মনে হলো, আসলেই তো, যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে তো লিটনদের কষ্ট ‘ভ্যানে’ কেন, ‘ট্রাকেও’ নেওয়ার উপায় নেই। এই লিটনদের মধ্যে শুধু যে দিনমজুর শ্রমজীবী আছে, তা নয়। করোনার অভিঘাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিরাট একটি অংশও এখন ঢাকা ছাড়ার কথা ভাবছে। 

ব্র্যাকের সর্বশেষ একটি গবেষণা বলছে, করোনার অভিঘাতে আয় কমেছে ৯৫ শতাংশ মানুষের। কাজ হারিয়েছেন ৬২ শতাংশ আর কর্মহীন হয়েছেন ২৮ শতাংশ মানুষ। এতে গোটা অর্থনৈতিক অবস্থা টালমাটাল অবস্থায় চলে গেছে। এর মধ্যেও ভার্চ্যুয়াল জুম মিটিং করে সেই মিটিংয়ের খরচ দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা, এমন খবরও সংবাদমাধ্যমে ছাপা হয়েছে। কর্মকর্তারা বাসায় বসে জুম মিটিং করে খাবার খরচের বিল দেখিয়েছেন চার লাখ টাকা। আর খাতা, কলম, প্যাডের খরচ বাবদ নেওয়া হয় ১৪ লাখ টাকা। 

এটি একটি অতিক্ষুদ্র খণ্ডচিত্র। গোটা দেশের এসব খণ্ডচিত্র যদি জোড়া লাগানো হয়, তাহলে যে ছবি দাঁড়াবে, তা ভয়াবহ রূপ নেবে। কিন্তু ভাগ–বাঁটোয়ারা করে নেওয়া এই টাকাগুলোর যদি যথার্থ ব্যবহার হতো, যদি ব্যর্থতাগুলোর যথার্থ ‘পোস্টমর্টেম’ হতো, করোনার এই অর্থনৈতিক অভিঘাতের তীব্রতা নিশ্চিতভাবেই অনেক কমত। লিটনদের হয়তো দোকান ছেড়ে দিয়ে একেবারে পথে বসে ডাব বেচতে হতো না; আর ডাব বিক্রেতাদের হয়তো পথে বসা অবস্থাটুকুও হারিয়ে খালি হাতে ‘দেশে’ ফিরে যেতে হতো না। হয়তো সারি সারি এত ‘টু-লেট’ বত্রিশ দাঁতে বাড়িওয়ালাদের ভেংচাত না। 

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক