লিলি চৌধুরী: কান্না-হাসির নব্বই বছর

বিয়ের পর লিলি চৌধুরী ও মুনীর চৌধুরী
বিয়ের পর লিলি চৌধুরী ও মুনীর চৌধুরী

শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী লিলি চৌধুরী একসময় বেতার, মঞ্চ ও টেলিভিশনে ব্যস্ত অভিনেত্রী ছিলেন। আজ (৩১ আগস্ট) তাঁর ৯০ তম জন্মবার্ষিকী। গত মঙ্গলবার তাঁর কথা শুনতেই বনানীর বাসায় যাওয়া। 

ছোট ছেলে আসিফ মুনীর দরজা খুলে দিলেন। বারান্দায় বসে ছিলেন বড় ছেলে আহমেদ মুনীর। ড্রয়িংরুমের দেয়ালে চোখে পড়ল মেজ ছেলে আশফাক মুনীরের ছবি। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন।

লিলি চৌধুরী বসার ঘরে এসে একটু বিরাম নিলেন। সাতচল্লিশ, বায়ান্ন, একাত্তরের মতো ঐতিহাসিক সময়ের সাক্ষী তিনি। আসিফ মুনীর বললেন, অনেক কিছুই তাঁর মনে নেই। আবার কিছু কিছু স্মৃতি স্পষ্ট মনে আছে। তাঁর দেখাটা ঘর থেকে।

জীবন নিয়ে লিলি চৌধুরীর উচ্ছ্বাস নেই, ‘জীবনটা সুখেরও ছিল, দুঃখেরও। দুঃখেরই বেশি। খেয়েপরে কিছু আনন্দও হয়তো করেছি। কিন্তু সেগুলো খুব একটা মনে পড়ে না। দুটো বড় ধাক্কা খেয়েছি। সবচেয়ে মূল্যবান মানুষটাকে হারিয়েছি একাত্তরে। আর এই আগস্ট মাসে, ২০১১ সালে, মিশুক (আশফাক মুনীর) চলে গেল।’

লিলি চৌধুরী চলে গেলেন শৈশবে। টাঙ্গাইলের জাঙ্গালিয়া গ্রামে নানাবাড়িতে জন্ম লিলি মির্জার। বাবা নূর মোহাম্মদ মির্জা, মা আশরাফুন্নেসা। বাবার বদলির চাকরি ছিল। সেই সুবাদে ক্লাস থ্রিতেই শুরু হয় হোস্টেল জীবন। ভর্তি হন কলকাতায় বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে। প্রথম অভিনয় সেভেনে, রবীন্দ্রনাথের নাটকে।

এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাময়িকভাবে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। লিলি চলে যান মা-বাবার কাছে, দিল্লিতে। ইন্দ্রপ্রস্থ গার্লস হাইস্কুলে ভর্তি হন। স্কুলে একমাত্র মুসলিম মেয়ে তিনি, ‘এ জন্য কোনো রকম ধর্মীয় ভেদভাবের সম্মুখীন হতে হয়নি। একবার হিন্দুধর্মীয় একটি উৎসবের নাটকে ওরা আমাকে “ভারতমাতা” সাজিয়েছিল।’

দুই বছর পর আবার কলকাতায়। সাখাওয়াত স্কুল থেকেই লিলি এন্ট্রান্স পাস করলেন। ভর্তি হলেন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। দুই বছর হোস্টেলের নাটকগুলোতে নিয়মিত অভিনয় করেছেন। এর মধ্যেই দেশভাগ হলো। এ সময় কয়েক দিন অসুস্থ ছিলেন লিলি। হাসপাতালে প্রথম শুনলেন ‘রায়ট’ শব্দটা। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা চলছিল কলকাতাজুড়ে, ‘হাসপাতালের বারান্দায় বা জানালা দিয়ে দেখতাম, রাতে ঠেলাগাড়ি ভর্তি মানুষ ফেলে যেত। সকালে ডাক্তার-নার্স ছুটে গিয়ে দেখতেন, কেউ বেঁচে আছে কি না। কখনো হয়তো দু-একজনকে পাওয়া যেত।’ হাসপাতাল ভরে গেল মানুষে। যাঁদের শারীরিক অবস্থা একটু ভালো, তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হলো। লিলিও ছাড় পেলেন।

১৯৪৮-এর মাঝামাঝি নূর মোহাম্মদ মির্জা কর্মস্থল হিসেবে বেছে নিলেন ঢাকাকে। লোকমুখে ঢাকার রক্ষণশীল পরিবেশের কথা শুনে ঘাবড়ে যান। এদিকে কখনোই আসা হয়নি। মেয়েদের ওপর নেমে এল কঠোর অনুশাসন। তবে কয়েক মাস পর সেসব রইল না।

এর মধ্যেই মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হলো লিলি মির্জার। বড় বোন নূরজাহান মির্জা ও মুনীর চৌধুরীর ছোট বোন নাদেরা বেগম একসঙ্গে পড়তেন ব্রেবোর্নে। লিলি মজা করে বললেন, প্রথম দেখায় মুনীর চৌধুরীকে একটুও ভালো লাগেনি, ‘কালো-রোগা-ছিপছিপে দেখতে। কপালে ফোড়া, তাতে একটু চুনমাখা। কিন্তু কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।’

এদিকে মুনীরেরও ভালো লাগল লিলিকে। দুজনের ভাব হতে বেশি দিন লাগেনি। তখন লিলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। আর মুনীর বামপন্থী রাজনীতি করেন। প্রায় প্রতিদিন দেখা হতো তাঁদের। ১৯৪৯ সালের মার্চে পাকিস্তান সরকার মুনীর চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে। মুনীর-লিলি কেউই এই বিচ্ছেদ-যন্ত্রণা সইতে পারছিলেন না। তখন দুজন দুজনের উদ্দেশে ডায়েরি লেখা শুরু করলেন। ২০১৫ সালে ডায়েরিগুলো প্রথমা প্রকাশন থেকে দিনপঞ্জি-মনপঞ্জি-ডাকঘর নামে প্রকাশিত হয়েছে।

সেবার মুনীর ছাড়া পান পাঁচ মাস পর। ১৯৪৯-এর ৩০ সেপ্টেম্বর বিয়ে করেন তাঁরা। ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আবার গ্রেপ্তার হন মুনীর চৌধুরী। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, লিলি জানেন না। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ এল। লিলি বলেন, ‘তখন চিন্তা-কোথায় খুঁজব স্বামীকে, কোথায় যাব, ভাষণের (আহমেদ মুনীর) বয়স তিন মাস। প্রিম্যাচিউর বেবি, অনেক অসুস্থ থাকত। এগিয়ে এলেন আব্বা (শ্বশুর)।’

মুনীর চৌধুরী মুক্তি পেলেন ১৯৫৪ সালে। এই কারাবাসে কবর নাটকটি রচিত হলো। লিলির মনে পড়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের কথা। চারদিকে গোলাগুলি, যেন জানালা দিয়ে গুলি চলে আসবে। মুনীর কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তাড়াতাড়ি বিছানার তোশক নামিয়ে লিলি সবাইকে মাটিতে শুইয়ে দেন। রাতটা নির্ঘুম কেটেছিল।

একাত্তরে অনেকে তাঁদের ভারতে চলে যাওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু কখনো পরিকল্পনা হয়নি। মুনীর চৌধুরীও যেতে চাননি। ১৪ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে যায়, ‘গাড়িতে তোলার আগে পিঠে বন্দুক ঠেকায়। ওর পিঠটা কেঁপে ওঠে। পিঠে-কোমরে ব্যথা ছিল। অনেক ভয় পেয়েছিল নিশ্চয়ই। এই শেষ দেখা।’

একাত্তরের পরে কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে লিলি চৌধুরীকে। বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করেছেন, পাশাপাশি অভিনয়। বিয়ের পর মুনীরই রেডিওতে অডিশন দিতে পাঠিয়েছিলেন লিলি চৌধুরীকে। পরে বেতার, মঞ্চ ও টেলিভিশনে নিয়মিত নাটক করেছেন। তাঁর কণ্ঠ, স্পষ্ট সংলাপ উচ্চারণ, সুন্দর বাচনভঙ্গি সবার মনোযোগ পায়। তিনি বলেন, তখনকার দিনে অভিনেত্রী ছিল হাতে গোনা। ছেলেরাই মেয়ে সাজত। শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে হিসেবে নাটকে আসায় সবাই উৎসাহ দিয়েছিলেন। তাঁর দেখাদেখি অন্য মেয়েরাও অভিনয়ে আসে।

আশির দশকের প্রথম দিকে চোখে অপারেশন হয়। একটা পর্যায়ে অভিনয় ছেড়ে দেন লিলি চৌধুরী। তবে এখনো সক্রিয় তিনি। গল্পের বই, জীবনী পড়েন। নিয়মিত শোনেন রবীন্দ্রনাথ, পঞ্চকবির গান। কখনো টিভি দেখা, ঘরের মধ্যে একটু পায়চারি। আর ভালোবাসেন পরিবারের সঙ্গে গল্প করতে।

প্রণব ভৌমিক প্রথম আলোর প্রতিবেদক