লুঙ্গির বদনামে কী এসে যায়!

বন্দুক কাঁধে নাম না জানা এক মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে লুঙ্গি পরিহিত সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল
ছবি : সংগৃহীত

লুঙ্গি জিনিসটার আরাম যত, বদনামও তত। আছে বেদনারও ইতিহাস। শেরেবাংলা ফজলুল হক একবার কৃষক সভা করছেন। বরিশালের ভাষায় কৃষকের দুঃখের বর্ণনা দিচ্ছেন। একেকটা উদাহরণ দিচ্ছেন, আর সমবেত জনতা ডুকরে উঠছে। কয়েকজন বৃদ্ধ কৃষক সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন আর একটু পরপর চোখের পানি মুছতে লুঙ্গির খোঁটা ওপরে তুলছিলেন। এতে তাঁদের মধ্যপ্রদেশ উন্মুক্ত হয়ে পড়ছিল। তাই দেখে শেরেবাংলা বক্তৃতা ভুলে মাইকে চিৎকার করে বললেন, ‘মিয়ারা বইয়া কান্দেন, বইয়া কান্দেন।’

লুঙ্গি আর ধানচাষ দুজনে দুজনার। পূর্বদেশীয় কম্বোডিয়া-ভিয়েতনাম-থাইল্যান্ড-মিয়ানমার হয়ে ধান যেদিন বাংলার ভেজা জমিতে নিবাস গাড়ল, যেদিন থেকে পূর্বদেশীয় হাতিয়ার কোদাল বাংলার কৃষকের হাতে উঠে এল, সেদিন থেকে লুঙ্গি ছাড়া কৃষিকাজের আর উপায় ছিল না। বঙ্গবন্ধু বাড়িতে লুঙ্গি পরতেন, ভাসানী পরতেন সর্বত্র। লুঙ্গি নিষিদ্ধ করে দেখুন, বাংলাদেশ ও ভারতের বিরাট অঞ্চল, আসিয়ানভুক্ত পুরো পূর্ব এশিয়া লুঙ্গি ড্যান্সে মেতে উঠবে। লুঙ্গির কিছু হলে আসিয়ান, সার্ক আর আফ্রিকান ইউনিয়ন একযোগে ফের ডিকলোনাইজেশন সংগ্রাম শুরু করবে। আবার ফিরে আসবে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের মঞ্চে লুঙ্গি পরা অং সান কিংবা মাওলানা ভাসানীর মতো উপনিবেশবিরোধী নেতারা। ওই সব দেশে লুঙ্গি শ্রেণিহীন জাতীয়তাবাদের প্রতীক, ধনী-গরিব, নর-নারী, নায়ক-নায়িকা সবাই পরে। উপনিবেশবাদীদের উচিত তাই দেশীয় মানুষের জানপরান লুঙ্গি ধরে টানাটানি কম করা।

তবু লুঙ্গিতে টান লেগেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিতর্কিত নাগরিক আইনবিরোধী সমাবেশের জমায়েতের দিকে দেখিয়ে বলেছেন, কারা আন্দোলন করছে, তা পোশাক দেখেই চেনা যায়। আসামের মুসলমান কৃষকেরা লুঙ্গি পরে থাকে। তাদেরই বাংলাদেশি বলে তাড়ানোর জন্য নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসির বিধান করেছে সে দেশের সরকার।

তবু লুঙ্গিতে টান লেগেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিতর্কিত নাগরিক আইনবিরোধী সমাবেশের জমায়েতের দিকে দেখিয়ে বলেছেন, কারা আন্দোলন করছে, তা পোশাক দেখেই চেনা যায়। আসামের মুসলমান কৃষকেরা লুঙ্গি পরে থাকে। তাদেরই বাংলাদেশি বলে তাড়ানোর জন্য নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসির বিধান করেছে সে দেশের সরকার। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা কিছুদিন আগে বলেছিলেন, লুঙ্গি পরা বাংলাদেশিরা পশ্চিমবঙ্গে এসে সন্ত্রাস করছে। অবশ্য নির্বাচনী সংঘাতের পরে দেখা গেল, বেশির ভাগ লাশের পরনেই ছিল লুঙ্গি আর তারা পশ্চিমবঙ্গেরই আদি বাসিন্দা। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের সময় গান তৈরি হয়েছিল, ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিবার চায়।’ সম্প্রতি ভারতে লুঙ্গি বিতর্ক আর তার পরপর বিশিষ্ট প্রবাসী বাংলাদেশি লেখক তসলিমা নাসরিন লুঙ্গি নিয়ে স্পর্শকাতর কটাক্ষ করেছেন। তারপরে ফেসবুকে প্রতিবাদ হয়েছে: ওরা আমার লুঙ্গি-পরা কাইরা নিবার চায়। প্রায় একই ধরনের কবিতার আন্দোলন চলছে আসামে। এটাকে বলা হচ্ছে মিঞা কবিতা। আসামের বাঙালি মুসলিমদের মিঞা বলে গালি দেয় বিজেপিপন্থীরা। কবিতা লেখার দায়ে বেশ কজন মিঞা কবি পলাতক। সেই মিঞাদের একজন কবি চান মিঞা লিখেছেন,
আবার ডিটেনশন ক্যাম্পে বসে মনে পড়ল
হায়রে, এই বিল্ডিংটা তো আমিই বানিয়েছিলাম
এখন আমার কিছু নাই
মাত্র আছে এক জোড়া পুরোনো লুঙ্গি, আধপাকা দাড়ি
আর দাদার নাম থাকা ছেষট্টি’র ভোটার লিস্টের এফিডেভিট কপি।

লুঙ্গি এখন একদিকে সাম্প্রদায়িক ঘৃণার লক্ষ্য, অন্যদিকে প্রতিবাদের প্রতীক, আত্মপরিচয় উদ্‌যাপনের সাংস্কৃতিক নিশান। অথচ পূর্ব বাংলার হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে পুরুষেরা লুঙ্গি পরে। যেমন একদা তারা ধুতিও পরত। ধুতি-লুঙ্গি তখনো জল-পানির মতো সম্প্রদায়গত হয়ে পড়েনি। এখনো দুই বাংলার অনেক হিন্দু বাড়িতে লুঙ্গির চল আছে। সে অর্থে লুঙ্গি, গামছা আর বদনার মতো ধর্মনিরপেক্ষ আর কিছু হয় না। শহরে বদনা বিরল হলেও, বাংলা সিনেমার চৌধুরী সাহেবেরা লুঙ্গিপরা যুবকের কাছে মেয়ের বিয়ে দিতে না চাইলেও; লুঙ্গি আছে বহাল তবিয়তেই। তবে আত্মপরিচয় সংকটে ভোগা বাঙালিদের মধ্যে লুঙ্গি নিয়ে ইজ্জতের মামলা দেখা যায়। রাজধানীর অভিজাত ঢাকা ক্লাবে লুঙ্গি পরে যাওয়া যায় না, দেশি সাহেবদের ইংরেজি সাহিত্যের আসরেও লুঙ্গি নিষিদ্ধ। লুঙ্গি নিয়ে বিব্রত হতে হয় গুলশান-বনানীর অভিজাত এলাকায়।

লুঙ্গি নারীরও পোশাক। তারপরও বিতর্কপ্রিয় বিশিষ্ট নারীবাদী তসলিমা নাসরিনের লুঙ্গিতে বেজায় আপত্তি। নায়িকা পরীমনি তাঁর জন্মদিনে লুঙ্গি ড্যান্স দিলে অবশ্য কোনো সমস্যা দেখা যায়নি। তামিল, সিংহলি, মালয়ী, ইন্দোনেশীয়, বার্মিজ, ভিয়েতনামি, কম্বোডিয়াসহ অনেক জাতির নারীদের দেশীয় পোশাক লুঙ্গি। লুঙ্গি সর্বলিঙ্গীয় পোশাক। লুঙ্গি উভচরও বটে। গ্রীষ্ম-বর্ষা আর কাদাপানির দেশে লুঙ্গি বিনা গতি নাই। কাদাপানির মাপ বুঝে যত ইচ্ছা তত ওপরে তোলা যায়। দরকার পড়লে নেংটি মেরে খাল-বিলে সাঁতরানো কিংবা মাছ ধরা যায়। আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া কিংবা নরসিংদীর যৌথ জীবনের অমূল্য রেওয়াজ হিসেবে যে গ্রামীণ মারামারি চালু আছে, প্যান্টের সেলাইয়ের ক্ষমতা নেই ও রকম সাবলীল সংঘাত সামাল দেয়। লুঙ্গিবস্ত্র ছাড়া চরের লড়াইয়ে শামিল হতে পারবেন, তবে জিততে পারবেন না।

আর্দ্র জলবায়ুতে লুঙ্গির বহুমুখী ব্যবহার দেখা যায়। গামছা না থাকলে লুঙ্গি ধুয়ে গা মোছা যায়। মেজবান যদি মেহমানকে শীতের কাঁথা নাও দেয়, লুঙ্গি মাথা পর্যন্ত তুলে শীত নিবারণ করা যায়। বাজারে গেছেন, থলে নেননি। লুঙ্গির কোছায় করে নিয়ে আসুন।

লুঙ্গির বিপরীত জিনিস সম্ভবত মানুষের কপাল। কারও কপাল খুললে পৌষ মাস, লুঙ্গি খুলে গেলে সর্বনাশ। ভাগ্যের গিঁট খুলতে হয়, লুঙ্গি গিঁট ভালো করে দিতে জানতে হয়। না জানলে ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে, লুঙ্গি যে মোর যায় রে উড়ে’ দশা হতে পারে। দোষ লুঙ্গির নাকি গিঁট দিতে না জানার, তা তদন্ত করে দেখা দরকার। তবে ঘনবসতির এই দেশে ঘুমের মধ্যে বেশি নড়াচড়া না করা ভালো। বেশি নড়াচড়া করলে লুঙ্গি তো লুঙ্গি, মন্ত্রিত্বও চলে যায়, সে তো আমরা দেখলামই।

যাহা লুঙ্গি তাহাই তবন তাহাই থামি। লুঙ্গির জনপ্রিয়তা পশ্চিমবঙ্গেও বাড়ছে। বাংলাদেশি মধ্যবিত্তের বাড়িতে অন্তত একটা করে বই, আর অন্তত একটা লুঙ্গি থাকবেই। যে যা-ই বলুক, দিনে অন্তত কয়েক ঘণ্টা লুঙ্গি পরে আরামসে বই পড়ুন। নিজেও পড়ুন, অতিথি চাইলেও পড়তে দিন। লুঙ্গি ও বই দুটোই।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]