শ্রীলঙ্কার দাপুটে নেতাদের এই দশা কেন

প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ও পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের পৈতৃক বাড়িতে বিক্ষোভকারীরা সোমবার দিবাগত রাতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
ছভি: রয়টার্স

ফেসবুকের নিউজফিড শ্রীলঙ্কার ছবিতে ভরে যাচ্ছে। শত ভাগ শিক্ষিত মানুষের দেশটিতে, অপূর্ব সৌন্দর্যের দ্বীপরাষ্ট্রটিতে আগুন জ্বলছে। ক্ষমতাসীন দলের এমপির লাশ পড়ে আছে। ভিডিও চিত্রে দেখা যাচ্ছে, একজন প্রবীণ নেতা ও সংসদ সদস্যকে গণপিটুনি দেওয়ার পর বিবস্ত্র করে ফেলা হয়েছে। ছিন্ন অন্তর্বাসের ভেজা অংশ দেখে বোঝা যাচ্ছে, বেদম পিটুনিতে তিনি কাপড় নষ্ট করে ফেলেছেন।

আরেক ছবিতে দেখা যাচ্ছে, রাতের অন্ধকারের মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলছে কয়েকটি প্রাসাদোপম বাড়ি। সেই ধ্বংসযজ্ঞের পাশেই বিক্ষুব্ধ ও ধৈর্যহারা মানুষ যেন ‘শ্রেণিশত্রু খতমের উন্মাদনায়’ উল্লাস করছে।

১৯৮৯ সালের ২২ ডিসেম্বর রাজধানী বুখারেস্টে কমিউনিস্ট পার্টির সদর দপ্তরের বাইরে বিক্ষুব্ধ জনতা জমায়েত হলে রোমানিয়ার তৎকালীন কমিউনিস্ট স্বৈরশাসক নিকোলাই চসেস্কু ও তাঁর স্ত্রী এলিনা যে কায়দায় হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে গিয়েছিলেন, একইভাবে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যাওয়া মাহিন্দা রাজাপক্ষে জনরোষের ভয়ে হেলিকপ্টারে করে তাঁর পরিবার নিয়ে রাজধানী কলম্বো থেকে উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় শহর ত্রিঙ্কোমালিতে পালিয়ে গেছেন।

এই পরিস্থিতিতে আশির দশকে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জিয়াউল হকের উৎপীড়নের বিরুদ্ধে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের লেখা ‘হাম দেখেঙ্গে’ কবিতার সেই লাইন যেন শ্রীলঙ্কার বাস্তবতায় এসে ধরা দিয়েছে:

‘সব্ তাজ উছালে জায়েঙ্গে
সব্ তখ্ত গিরায়ে জায়েঙ্গে
....
হাম দেখেঙ্গে, হাম দেখেঙ্গে
লাজিম হ্যায় কি হাম ভি দেখেঙ্গে’

(‘সব মুকুট ছুড়ে ফেলা হবে
সব সিংহাসন গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।

.... .
আমরা দেখব, আমরা দেখব
নিশ্চিত জানি, আমরাও দেখব’)

বিক্ষোভের আগুনে পুড়েছে নেতাদের বিলাসবহুল গাড়ি
ছবি: এএফপি


শ্রীলঙ্কায় আজ যা হচ্ছে, তা যে হওয়ারই কথা ছিল, সে কথা অন্তত ছয় মাস আগে থেকে টের পাওয়া যাচ্ছিল। করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে আস্তে আস্তে দেশটির মানুষ বুঝতে পারছিল, অর্থনীতির অবস্থা খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে। সেই খারাপ অবস্থা আরও খারাপ হতে হতে এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোষাগারে বলা যায় কোনো ডলারই আর অবশিষ্ট নেই। কিছুই আমদানি করা যাচ্ছে না। খাদ্য থেকে জ্বালানি—কিছুই নেই। চারদিকে নেই আর নেই। এই ‘নেই’–এর খবর জনগণের কাছে পৌঁছানোর জন্য যে সংবাদপত্র ছাপা হতো, কাগজ আমদানি বন্ধ থাকায় সেই সংবাদপত্রও নেই।

আরও পড়ুন

অথচ এক দশক ধরে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ জেনে এসেছে তাদের দেশ ‘সিঙ্গাপুর’ হতে চলেছে। সে দেশের রাজনীতিকেরা নিতান্ত আপ্তবাক্য হিসেবে এই কথা বলে এসেছেন, ব্যাপারটা মোটেও তা না। রীতিমতো বিশেষজ্ঞ মত ও পরিসংখ্যান দিয়ে এই কথা শ্রীলঙ্কার মানুষের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এক সুখস্বপ্নের ঘোরে ছিল শ্রীলঙ্কার মানুষ। আচমকা স্বপ্ন ভেঙে তারা দেখছে তাদের সামনে অন্ধকার। এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তা তাদের গ্রাস করছে।

প্রধানমন্ত্রীর পদে ছিলেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। তাঁর ছোট ভাই গোতাবায়া রাজাপক্ষে এখনো প্রেসিডেন্ট। তাঁদের পরিবারের মোট সাত সদস্য সরকারের শীর্ষস্থানীয় পদে। অর্থাৎ গণতন্ত্রের নামে একটি পরিবারতন্ত্র সেখানে কায়েম করেছিল রাজাপক্ষে পরিবার।

এক যুগ আগে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের শিশুসন্তানসহ তাঁর পরিবারের সবাইকে মাহিন্দা রাজাপক্ষের নির্দেশে মেরে ফেলা হয়েছিল। সেই সঙ্গে তামিলদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছিল। এরপর থেকেই রাজাপক্ষে পরিবার বিরুদ্ধমত দমনে ছিল অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু এবার আর রাজাপক্ষেরা উন্মত্ত জনতাকে দমন করতে পারলেন না। কারণ, ক্ষুধা ও অভাবকে বন্দুকের মুখে বেশিক্ষণ দমন করে রাখা যায় না।

আজকের এই অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য কোভিডকে দায়ী করেছে সরকার। মহামারিতে দেশটির পর্যটন–বাণিজ্য যা তাদের অন্যতম বৃহৎ বৈদেশিক আয়ের উৎস, তা প্রায় ধসিয়ে দিয়েছে—এটি সত্য। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটিই একমাত্র কারণ নয়। দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাই এর মূল কারণ।

সরকার ‘কলম্বো পোর্ট সিটি’ নামে একটি নতুন শহর তৈরি করছে। সরকারের দিক থেকে বলা হচ্ছিল, এটি হবে নতুন দুবাই। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সেটি সেটি হবে চীনা ছিটমহল। কারণ, বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার। আর এই অর্থের বেশির ভাগই দিচ্ছে চীন। এই রকমের অনেক বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে শ্রীলঙ্কা ঋণ নিয়েছে। বিপুল অর্থ খরচ করা হলেও অনেক প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়নি। এগুলো শ্রীলঙ্কার জন্য ‘শ্বেতহস্তী’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আজকের এই অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য কোভিডকে দায়ী করেছে সরকার। মহামারিতে দেশটির পর্যটন–বাণিজ্য যা তাদের অন্যতম বৃহৎ বৈদেশিক আয়ের উৎস, তা প্রায় ধসিয়ে দিয়েছে—এটি সত্য। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটিই একমাত্র কারণ নয়। দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাই এর মূল কারণ।

দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে দেদার ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন সরকার। এর মধ্যে অন্যতম উৎস হচ্ছে সার্বভৌম বন্ড। ২০০৭ সাল থেকে দেশটির সরকার অর্থ জোগাড়ের জন্য সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করেছে। একটি দেশের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে এ ধরনের সার্বভৌম বন্ড বিক্রি করা হয়। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে এ ধরনের বন্ড বিক্রি করে অর্থের জোগান দেওয়া হয়। শ্রীলঙ্কা সেটাই করেছে। কিন্তু এই অর্থ কীভাবে পরিশোধ করা হবে, তারা তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেনি। চলতি বছর এসব ঋণের কোনো কিস্তি শোধ করতে পারবে না দেশটি।

রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য রাজাপক্ষে পরিবার জনতুষ্টিবাদী যেসব উদ্যোগ নিয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম হলো ভ্যাট এবং ট্যাক্স কমানোর সিদ্ধান্ত। ভ্যাট প্রদানের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশে আনার পর সরকারের রাজস্ব আয় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। এতে সরকার আরও ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এর ওপর মহামারির কারণে পর্যটন ও রেমিট্যান্স খাতে বিপর্যয় নামে। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া দেশে অর্গানিক কৃষি চালুর মতো একটি রোমান্টিক পদক্ষেপ নিলেন। কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ করলেন। শ্রীলঙ্কায় সার আমদানিনিষিদ্ধ করলেন। এতে চালের উৎপাদন ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেল। একসময় চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ শ্রীলঙ্কা চাল আমদানি করতে বাধ্য হলো। চালের দাম হু হু করে বাড়তে থাকল। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার পর মানুষ রাস্তায় নামলে তাদের দমন করা হলো।ধারাবাহিকভাবে পুঞ্জীভূত হওয়া সেই জনক্ষোভ আজ বিস্ফোরিত হয়েছে। ক্ষমতার প্রাসাদে বঞ্চিতরা আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।

আরও পড়ুন

এই ক্ষোভের আগুন দেখে কেউ হয়তো কাজী নজরুলীয় রোমান্টিসিজমে উদ্দীপ্ত হয়ে বলতে পারেন—

‘করুক কলহ—জেগেছে তো তবু—বিজয়-কেতন উড়া!
ল্যাজে তোর যদি লেগেছে আগুন, স্বর্ণলঙ্কা পুড়া!’

কিন্তু সমস্যা হলো, এই সমস্যার কোনো আশু সমাধান নেই। এক গভীর সংকটে পড়ে গেছে ‘স্বর্ণলঙ্কা’।

আমাদের বাংলাদেশের জন্য ভালো খবর দিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি জানিয়েছেন, দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এক বছরের ব্যবধানে ২৩৪ ডলার বেড়েছে। এখন আমাদের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৫ মার্কিন ডলার। তার মানে শ্রীলঙ্কার মতো আমাদের টেনশনের কিছু নেই। তবে সমস্যা হলো, আমাদের ‘মাথার’ দিকে যত আয়, ‘পিছু’র দিকে তত না।

আরেকটি সমস্যা হলো, ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে বলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৭৪ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। পাচার হচ্ছে তো হচ্ছেই। আর মাথাপিছু ঋণের হিসাব তো বাদই দিলাম।

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই–মেইল: [email protected]