লড়াকু অর্থনীতিবিদ আবু মাহমুদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আবু মাহমুদ ছিলেন মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদ। আজ ১ জানুয়ারি তাঁর শততম জন্মবার্ষিকী।

তাঁর জন্ম ১৯২০ সালের ১ জানুয়ারি নোয়াখালীর রামগঞ্জে। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৩৬ সালে ম্যাট্রিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৩৮ সালে আইএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৪ সালে অর্থনীতিতে অনার্সসহ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে রকফেলার ফেলো হিসেবে পিএইচডি করতে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে যান। ১৯৬২ সালে হার্ভার্ড থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এই অর্থনীতিবিদ।

আবু মাহমুদ যখন হার্ভার্ড থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন, তখন আইয়ুব খানের সামরিক স্বৈরশাসনে পূর্ব বাংলা নিষ্পেষিত। পাকিস্তান অবজারভার, পূর্বদেশ ও সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে তার পূর্ব বাংলার বঞ্চনা আর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ নিয়ে গবেষণা-প্রবন্ধ। ফলে গভর্নর মোনায়েম খান ও তাঁর ক্রীড়নক উপাচার্য ওসমান গণির রোষানলে পড়েন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই অর্থনীতিবিদ।

অধ্যাপক এম এন হুদা দীর্ঘ ছুটিতে গেলে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক হিসেবে আবু মাহমুদেরই অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান হওয়ার কথা। কিন্তু মোনায়েম খানের বশংবদ উপাচার্য তাঁকে চেয়ারম্যান করতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁকে ডিঙিয়ে ড. আনিসুর রহমানকে চেয়ারম্যান করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু আনিসুর রহমান সেই প্রস্তাব গ্রহণ না করলে তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এ বিষয়ে আনিসুর রহমান তার জীবনকথা পথে যা পেয়েছির প্রথম খণ্ডে লিখেছেন, ‘ড মাহমুদ হুদা স্যারের পরে সবচেয়ে সিনিয়র, কিন্তু মার্ক্সবাদী মাহমুদ স্যারকে নতুন ভিসির একবারে পছন্দ নয়। তিনি আমাকে ডেকে হেডের পদটি গ্রহণ করতে বলেন। মাহমুদ স্যার আমার শিক্ষক ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএর থিসিস গ্রুপের ছাত্র হিসেবে তাঁর গাইডেন্সেই থিসিস করি এবং সেই সুবাদে সার্বিকভাবে এমএর জন্য পড়াশোনাতেও তাঁর কাছে সস্নেহ গাইডেন্স পাই। ভিসিকে আমি বলি যে মাহমুদ স্যার আমার সিনিয়র এবং আমার শিক্ষক, তিনি থাকতে আমি হেডের পদ নিতে পারি না।’

এরপর আবু মাহমুদকে ডিঙিয়ে কে টি হোসেনকে বিভাগীয় প্রধান করা হলে তিনি হাইকোর্টে মামলা করেন। পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বিচারপতি সৈয়দ মুর্শেদ আবু মাহমুদের পক্ষে রায় দেন। ১৯৬৬ সালে আইউব-মোনায়েমের লেলিয়ে দেওয়া এনএসএফের পান্ডারা অধ্যাপক আবু মাহমুদের ওপর হামলা করলে তিনি গুরুতর আহত হন। পরের দিন দৈনিক ইত্তেফাকে সেই হামলার খবর ও তাঁর রক্তাক্ত ছবি ছাপা হয়। হামলার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা বিবৃতি দেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তদানীন্তন ছাত্রনেতা মাহবুব উল্লাহ, আহমেদ কামাল, মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, আফম মাহবুবুল হকসহ অনেক সাধারণ ছাত্র সে সময় ফুলার রোডে তাঁর বাসভবন পালা করে পাহারা দিতেন।

সরকার কিংবদন্তিতুল্য এই অধ্যাপককে ১৯৬৭ সালে দেশত্যাগে বাধ্য করে। এরপর তিনি যোগ দেন ব্যাংককে ইউএনএসকাপে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের উদ্যোগে দীর্ঘ দশ বছরের নির্বাসন শেষে ১৯৭৭ সালে আবু আহমেদ ফের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। তিনি আমাদের অনার্স ও মাস্টার্স ক্লাসে পড়াতেন মার্ক্সবাদ ও উন্নয়ন অর্থনীতি। পুঁজিপতিদের শোষণ, শ্রমিক কৃষকদের ঠকিয়ে পুঁজি গঠন সম্পর্কে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা দিতেন।
আমাদের ক্লাসে তিনি মার্ক টোয়েনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলতেন, ‘ধনীরা ডাকাতি করলে বলা হয় ব্যবসা। আর শ্রমিক কৃষক ন্যায্য মজুরি আর কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্যের দাবি তুললে বলা হয় বিশৃঙ্খলা।’ তিনি যেমন আমাদের শিক্ষক ছিলেন, তেমনি আমাদের অনেক শিক্ষকেরও শিক্ষক ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছিল তার সরব উপস্থিতি। তার লাল রঙের ছোট্ট গাড়ি ঠাসা থাকত হরেকরকম বই আর গবেষণার কাগজে। বহু ছাত্র শিক্ষক তার কথা শোনার জন্য উন্মুখ থাকতেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্ল্যাগশিপ প্রফেসর। তাঁর কাছে আমরা সামরিক শাসন, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস পেয়েছি।

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চ শিক্ষা নেওয়া আবু মাহমুদ মার্ক্সীয় দর্শনে আস্থাশীল ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ২০০ বছর আগের মার্ক্সীয় দর্শন এখনো প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। সাম্যবাদী সমাজ আমাদের জন্য কত জরুরি কার্ল মার্ক্সের বিশ্লেষণকে নিরিখে আবু মাহমুদ চল্লিশ বছর আগে তার ৫৬৮ পৃষ্ঠার মার্ক্সীয় বিশ্ববীক্ষা গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে সে কথা বলেছেন। তিনি মনে করতেন সাম্যবাদী সমাজ ও রাষ্ট্র মুক্তবাজার থেকে অনেক ভালো।

মার্ক্সীয় বিশ্ববীক্ষায় তিনি পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদদের যুক্তি খণ্ডন করা হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘তাদের সমস্ত যুক্তি দারিদ্র্যক্লিষ্ট, অনাহার-অর্ধাহারে জর্জরিত ও রোগ-শোকে ম্রিয়মাণ একটি দেশের নাগরিক হিসেবে আমার মনে ন্যূনতম সান্ত্বনার প্রলেপ দিতে ব্যর্থ হয়। প্রকৃতপক্ষে ওই সময় আমি বুঝতে সক্ষম হই যে, সমাজে ধনী-দরিদ্র, শোষক-শোষিত, মালিক—শ্রমিক এ সকল সম্পর্ক অন্যান্য সম্পর্কের তুলনায় নির্ধারকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।’

আবু মাহমুদ সহজ-সরল কথায় অর্থনীতির জটিল তত্ত্ব পড়িয়েছেন। পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পাঠ ও গবেষণা পদ্ধতি হাতে-কলমে শিখিয়েছেন’ ৪০ থেকে’ ৮০ দশকের শেষদিক পর্যন্ত। পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ-নিপীড়নে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক বঞ্চনার কথা তুলে ধরেছিলেন, যা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবির পটভূমি সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছিল। তাঁর কাছে জাতি হিসেবে আমাদের ঋণ কখনো শোধ হওয়ার নয়।

এই শিক্ষাগুরু জীবনভর ছিলেন লড়াকু। তিনি তার ছাত্র-ছাত্রীদের শিখিয়েছেন লড়াই করতে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ও অর্থনৈতিক মুক্তির পথের কথা ভেবেছেন। ৩২ বছর আগে ১৯৮৮ সালে তিনি অনন্তলোকে যাত্রা করেন। তার শততম জন্মবার্ষিকীতে জানাই শ্রদ্ধা।

কামরুল ইসলাম চৌধুরী জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। অর্থনীতি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক বিশ্লেষক। [email protected]