শক্তিশালী জাতিসংঘ মানবজাতির জন্য জরুরি

জাতিসংঘ
ছবি: রয়টার্স

জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্যরাষ্ট্রের সামনে অভিন্ন হুমকি এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত জরুরি ভিত্তিতে নতুন হাতিয়ার তৈরি, উপযুক্ত পরিকল্পনা এবং উদ্যোগ গ্রহণ করা। ২৪ অক্টোবর ছিল জাতিসংঘের ৭৫ বছর পূর্তি। এ উপলক্ষকে কেন্দ্র করে এমন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেওয়া উচিত, যাতে সামনের দশকগুলোর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সব থেকে প্রাণসংহারী কোভিড-১৯–এর আঘাতের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব সংস্থাটির প্রাতিষ্ঠানিক নবায়ন এবং পুনরুদ্ধার অবশ্যম্ভাবী।

যে হুমকিগুলো বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে দ্রুত পরিবর্তনশীল জলবায়ু পরিবর্তন, সহিংস সংঘাত এবং ভঙ্গুর রাষ্ট্রসমূহে ব্যাপকভিত্তিক মানুষের স্থানচ্যুত হওয়া। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন সাইবার আক্রমণের চ্যালেঞ্জ। যে বিষয়টি বেশি লক্ষণীয় তা হলো এসব সংকটের নিরসন কোনো একটি দেশের পক্ষে এককভাবে করা সম্ভব নয়। তাই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই সহযোগিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থানে। এর ফলে ৭৫ বছর আগে যে আন্তর্জাতিক অর্ডার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তার মূল কাঠামোকেই হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান জাতিসংঘের কাঠামো এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিরাট হুমকি। এ অবস্থায় যদি এসব মেরামত না করে তার ক্ষয় চলতে থাকে, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়তে পারে, যা সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি ট্র্যাজেডি ডেকে আনবে।

সম্প্রতি জাতিসংঘের সভাপতির কাছে পেশ করা হয়েছে ‘যে ভবিষ্যৎ আমরা দেখতে চাই, যে জাতিসংঘ আমাদের প্রয়োজন’ শীর্ষক রোডম্যাপ। আমরা তা সমর্থন করি। জাতিসংঘে আমাদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করা এবং অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, জাতিসংঘের বাইরের (নাগরিক সমাজ) অংশীজনেরা জটিল বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যার সমাধানে ইতিবাচক উপায় বাতলে দিতে পারেন। ওই রোডম্যাপকে বাস্তবে রূপ দিতে বিশ্বের দেশে দেশে ব্যক্তি, সংগঠন ও নাগরিক সমাজ ভূমিকা রাখতে পারে। তাদের এগিয়ে আসা উচিত।

জাতিসংঘের মহাসচিব ইতিমধ্যেই বৈশ্বিক সংলাপ শুরু করেছেন। যাতে সারা বিশ্ব থেকে জরিপ, ভোটাভুটি, সংলাপ ইতিমধ্যেই বাস্তবায়িত হয়েছে। এসব সংলাপ স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে আমাদের এ জাতিসংঘ বিগত দশকগুলোতে অনগ্রসর মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে, মৌলিক মানবাধিকারের সুরক্ষা দিয়েছে। টেকসই উন্নয়ন এগিয়ে নিয়েছে এবং একটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে রুখে দিয়েছে।

জাতিসংঘের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ঘোষণাপত্রের আলোকে বিশ্ব নাগরিক সমাজের সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রগুলোকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে। এর মাধ্যমে সরকারগুলো নয়া উদ্যম ও চেতনায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নবায়ন ঘটাতে পারে। দুটি পরিপূরক লক্ষ্য থাকবে: প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিশালীকরণ এবং কোভিড থেকে উত্তরণ।

আমরা বিশেষ করে ওই ঘোষণাপত্রের ১২ দফা অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। এর মূল চেতনা থাকবে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্ব নিশ্চিত করা। আমরা একই সঙ্গে সম্প্রতি স্টিমসন সেন্টারের দেওয়া প্রতিবেদন ‘ইনক্লুসিভ গ্লোবাল গভর্ন্যান্স’–এর ভিত্তিতে একটি বিশ্ব সম্মেলনের আয়োজনের গুরুত্ব অনুভব করি। এটা ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে, যা বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থাকে উন্নত করতে সহায়ক হবে।

২০২৩ সালে বিশ্বনেতাদের ওই শীর্ষ সম্মেলন সামনে রেখে দুটি জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন প্রত্যাশিত। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের প্রেক্ষাপটে যেমন লন্ডন ও পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আর সেটা অবশ্যই সংকট উত্তরণের পথ দেখিয়েছিল। তেমন দুটো শীর্ষ সম্মেলন হতে হবে ২০২১ সালের মধ্যে। এ দুটি শীর্ষ সম্মেলনে সমন্বিত ম্যাক্রো অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত নীতি প্রণয়ন করা হবে, যার অন্যতম লক্ষ্য থাকবে অতিমারি থেকে উত্তরণ। বৃহত্তম অর্থনীতিগুলোর নেতাদের আলোচনায় যেসব সিদ্ধান্ত ও কৌশল নেওয়া হবে, তার প্রতি সমর্থন চাওয়া হবে ১৯৩টি সদস্যরাষ্ট্রের। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ অন্য বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে তার সমর্থনে।

২০১৫ সালে যখন আমাদের ‘গ্লোবাল সিকিউরিটি জাস্টিস এবং গভর্ন্যান্স’বিষয়ক কমিশন ‘বৈশ্বিক শাসনের সংকট মোকাবিলা’ শীর্ষক রিপোর্ট পেশ করেছিল, তখন তাতে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। এ উগ্র জাতীয়তাবাদকে আবার উসকে দিয়েছে অভিবাসন ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। এর সঙ্গে সেই নেতাদের ভূমিকা আরও ক্ষতি বয়ে এনেছে, যাঁরা অন্যদের খাটো করেছেন, ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে বিভক্তিকে তীব্রতা দিয়েছেন। সেই থেকে পাঁচ বছর কেটেছে। প্রমাণিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী নাগরিক সমাজের ধারণা ও রাজনৈতিক চাপ দ্বারা তাড়িত ও সমর্থিত বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় জরুরি হয়ে পড়েছে।

সহযোগিতার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে আমরা নতুন প্রজন্মের জন্য ‘যে ভবিষ্যৎ চাই’, সেটা নিশ্চিত করতে পারি।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

মেডেলিন অলব্রাইট: যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী

ইব্রাহিম গাম্বারি: নাইজেরিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী