শতবর্ষ ও সুবর্ণজয়ন্তীর মোহনায় দাঁড়িয়ে

২০২১ বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ বছর। এ বছর ১৭ মার্চ পর্যন্ত চলবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। আর ২৬ মার্চ থেকে শুরু হবে গৌরবময় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। বছরটা যেন মহাকালের দুই মহান ধারার সংগমস্থল—কালের মোহনা। এই মোহনায় বাঙালি কী সম্ভার নিয়ে পৌঁছেছে?

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে বরাবর ইতিহাসই ছিল নায়ক, নিয়ন্ত্রণ করেছে তার নিয়তি; একবারই তারাই ছিল এর নিয়ন্তা, নির্মাতা। সেই একবারের মাহেন্দ্রবর্ষ ছিল ১৯৭১। সেদিন জনগণই ছিল ইতিহাসের নায়ক; আর তা সম্ভব হয়েছিল তারা এক মহানায়ককে পেয়েছিল বলে। মহানায়কের নির্দেশে-নেতৃত্বে অসংখ্য নায়ক স্বাধীনতার লড়াইকে সফল করে তুলেছিল। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ এই যুগল সম্মিলনের—মহামিলনের ফসল।

তাই একাত্তরের স্লোগান ছিল—জয় বাংলা, মুজিবের চয়িত-উচ্চারিত জাতীয় ধ্বনি। জাতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিধ্বনি ছিল—এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ। নেতা ও জনতা, মুজিব ও বাংলাদেশ যেন একাকার। ইতিহাসের পটে আজ শতবর্ষ ও অর্ধশতবর্ষের তাৎপর্যে এই দুই ধারা আবার মিলিত হবে। এই মিলন–মহামিলন কোন তাৎপর্যপূর্ণ ফসল বয়ে আনবে? সেই আলোচনা শুরু হওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। আর দেরি নয়, আলোচনা শুরু করাই প্রথম কাজ।

স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাগুলো সংবিধানেই মূল নীতির আকারে উৎকীর্ণ। এগুলো ২৩ বছরের লড়াই-সংগ্রামে জাতির ব্যক্ত অসংখ্য উচ্চারণের সারসংক্ষেপ: বাঙালির স্বাধীন দেশে মানুষে মানুষে বিভেদ ও বৈষম্য থাকবে না; শাসনকাজে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। জাতীয় চেতনা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রেখে আন্তর্জাতিক ও বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক নাগরিক তৈরি তার ঘোষিত আকাঙ্ক্ষা। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শে দরিদ্রের কল্যাণ বরাবর প্রাধান্য পেয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে যে সাতই মার্চের ভাষণ বিবেচিত হয়ে থাকে, তাতে স্বাধীনতার সঙ্গে মুক্তির প্রত্যয়ও উচ্চারিত হয়েছিল। তাই স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, নতুন রাষ্ট্রের যাত্রাপথ রচনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। তিনি পরিকল্পনা কমিশনকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলেন এবং পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনাসহ দারিদ্র্য বিমোচনে অনেক কর্মসূচি হাতে নেন। ঘোষণা দেন দ্বিতীয় বিপ্লবের।

পঁচাত্তরে তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরে বাংলাদেশ যেন চলার পথ, নিশানা ও গন্তব্যের খেই হারিয়ে ফেলে। আদর্শিকভাবে দেশের পশ্চাৎ–যাত্রা চলেছে সেই থেকে প্রায় দুই দশক, রাজনৈতিক দিগ্ভ্রান্তিও তখন থেকে শুরু হয়। সবচেয়ে বড় সংকট হলো রাজনীতিতে অস্ত্র ও অর্থের—বিশেষত কালোটাকার আধিপত্য বাড়তে থাকায়। রাজনীতি ও সরকার পরিচালনায় সামরিক আমলাতন্ত্রের প্রভাব বেড়েছে এ সময় থেকে। বেড়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, সামাজিক রক্ষণশীলতা এবং এর প্রতিফল হিসেবে সাম্প্রদায়িকতা। প্রায় পাকিস্তানি আদলে দেশ সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এখান থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ, সংবিধান ঘোষিত মূল নীতির বাস্তবায়ন কঠিনতর হয়েছে।

এরই মধ্যে দুটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে বৈশ্বিক রঙ্গমঞ্চে। প্রথমে অর্থনীতি ও বাণিজ্যব্যবস্থায় মুক্তবাজারের ধারণা ও কাঠামো প্রসারিত হলো এবং তারই ফল হিসেবে ঘটল বিশ্বায়ন। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো প্রযুক্তির বিপ্লব—যাকে অনেকেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আখ্যা দিয়েছেন। এর ফলে যেমন আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিস্তর চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, তেমনি সবার জন্যই অনেক সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে।

এই সূত্রেই একটা বিষয় বলা দরকার। এই বাংলার মানুষ আদিকাল থেকে প্রতিকূল প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেই টিক থেকেছে, এগিয়েছে। সাধারণ মানুষ বরাবর সংগ্রামী, তারা বিরূপ বাস্তবতার আঘাতেও ভেঙে পড়ে না, হাল ছাড়ে না; বরং সব সময় উদ্যমী, পরিশ্রমী। স্বাধীনতার পরের সময়ে নিম্নবর্গের নারী–পুরুষ কৃষিতে প্রযুক্তির যত নতুন সম্ভার এসেছে, তা কাজে লাগিয়ে কৃষি উৎপাদনে বৈচিত্র্য এবং ফলন দুই-ই অবিশ্বাস্য গতিতে বাড়িয়েছে। নতুন সম্ভাবনার খাত তৈরি পোশাকশিল্প নিম্নবর্গের নারী দুহাতে গ্রহণ করেছে, অর্থনীতিতে এনেছে সমৃদ্ধি। নারীর আত্মনির্ভর হওয়ার আগ্রহের প্রকাশ ঘটে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে। তারা পারিবারিক অর্থনীতিকে গতিশীল রেখেছে। চমক দেখিয়েছে অভিবাসী শ্রমজীবীরা। তারাই আজ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার আয়কে রেকর্ড পরিমাণে ধরে রাখতে ভূমিকা রেখেছে।

সামাজিক অন্যান্য সূচকেও বাংলাদেশের অগ্রগতি পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এমনকি এই করোনাকালে অনেক দুর্নীতি ও বেশ কিছু অদক্ষতার ঘটনা সত্ত্বেও বাংলাদেশ উন্নত দেশের বিবেচনায়ও মহামারি মোকাবিলায় সাফল্যের ক্ষেত্রে সামনের কাতারেই রয়েছে। সাম্প্রতিক দুটি জরিপে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভুটান ছাড়া সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে এবং লিঙ্গবৈষম্য নিরসনেও অগ্রবর্তী অবস্থানে আছে।

বিশেষভাবে বলতে হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কথা। তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে এবং প্রায় তিন বছর ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে প্রত্যয়ী মানবিক নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। উন্নয়নকাজে দুর্নীতি পিছু না ছাড়লেও যে প্রেক্ষাপটে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন শেষ হতে যাচ্ছে এবং মেট্রোরেলসহ বড় বড় প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে, তা–ও নেতৃত্বের দৃঢ়তা ও সাহসের দুর্লভ উদাহরণ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তিনি পেছন সারির দেশের পেছন সারির নেতা নন, বরং ক্রমে উন্নয়নশীল দেশের নির্ভরযোগ্য বলিষ্ঠ মুখপাত্রে পরিণত হচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তন তহবিলের ব্যবহার বা অপব্যবহার নিয়ে আলোচনা নিশ্চয়ই হবে, কিন্তু বিশ্বমঞ্চে এই ইস্যুর সার্বিক গুরুত্ব তিনি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।

তবে যে বিষয়টি আফসোসের সঙ্গেই বলতে হবে তা হলো সমাজ-রূপান্তর বা সংস্কার এবং চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়নি, বরং অবস্থা নানা কারণে উদ্বেগজনক। এর জন্য শিক্ষা, রাজনীতি এবং শিল্পী–সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের কার্যকারিতার অভাবই মূলত দায়ী। অন্তরের উত্তরণ ঘটেনি আবার বাইরে থেকে ভোগবাদিতা এবং ধর্মের উগ্রপন্থী ব্যাখ্যার প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। সমাজে সনাতন প্রথা ও ধর্মের আচারসর্বস্বতার অচলায়তন এবং পুরোনো সংস্কার ও ধ্যানধারণা কাটিয়ে উঠতে না পারার ফলে যুক্তিনির্ভর মানসিক স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব প্রকট হয়েছে। এসব কারণে ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি বা ইতিহাসচর্চায় ব্যক্তির স্বাধীনতা বজায় থাকছে না। আর তাতে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের যথাযথ বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে এবং সুবিধাভোগী শ্রেণির দাপটে সামন্তব্যবস্থা ও সংস্কৃতির মজ্জাগত অভ্যাস থেকে সমাজকে মুক্ত করা যাচ্ছে না।

আমাদের জাতির অন্তর্গত দুর্বলতা কিছুতেই কাটছে না। ফলে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর কালেও বলা যাবে না যে স্বাধীনতার সুফল ‘স্বাধীনতা’ প্রপঞ্চের প্রকৃত তাৎপর্যে সব নাগরিকের জন্য সত্য হয়ে উঠেছে। একইভাবে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এখনো টেকসই নয়—ব্যাংকব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত ও দুর্বল, কৃষির উন্নয়ন হলেও কৃষকের উপার্জন ও জীবনমান সুরক্ষিত নয়, বৈদেশিক মুদ্রার বড় দুটি খাত তৈরি পোশাক রপ্তানি ও অভিবাসী শ্রমিকের রেমিট্যান্স দুটিই পরনির্ভর, যেকোনো সময় এর ভালো–মন্দের হেরফের ঘটতে পারে। এ ছাড়া নারীর অগ্রগতির বিরুদ্ধে গোঁড়া ও উগ্রপন্থী শক্তিগুলোর অবস্থান তাদের প্রকৃত স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন বাধাগ্রস্ত করছে; এর ফলে বিজ্ঞানমনস্ক আলোকনের শিক্ষাও অধরাই থেকে যাচ্ছে। একই কারণে প্রচলিত ক্ষমতাকাঠামো টিকে থাকায় নাগরিকের অধিকার বা আইনের শাসন প্রত্যাশা ও প্রত্যয় থেকে বাস্তবায়নে এত ধীরগতি, তেমনি ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘুর অধিকার ও অবস্থার আইনসিদ্ধ স্থিতি বজায় থাকে না, প্রায়ই ভেঙে পড়ে।

এই বাস্তবতা সমাজের বৈষম্যের চিত্রই তুলে ধরে। খেদের সঙ্গেই বলতে হয়, মুজিব বর্ষ শেষ হতে চললেও তাঁর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রকৃত তাৎপর্যে বাস্তবে মূর্ত হয়ে উঠছে না। আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালেও অনেক উন্নয়ন ও অগ্রগতির মধ্যেও অগণিত শহীদের স্বপ্ন পূরণের গন্তব্যস্থল হতে পারেনি দেশ। ভরসা এই যে এগোচ্ছি আমরা, নেত্রীও রয়েছেন উত্তরোত্তর কঠিন হয়ে ওঠা এই বাস্তবতায় জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ে।

আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক