শব্দ–সন্ত্রাস ও একটি (অ)কার্যকর আইন

কান নিয়ে বিড়ম্বনা কমবেশি সব মানুষেরই হয়। যা দেখতে চাই না, তা না দেখার জন্য চাইলেই চোখ বন্ধ করে ফেলা যায়। যা বলতে চাই না, তা না বলার জন্য চাইলে মুখও বন্ধ করে রাখা যায়। কিন্তু ইয়ারফোন গুঁজে বা কানে তুলো দিয়েও যা শুনতে চাই না, তা শোনা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া অতটা সহজ নয়। অবশ্য জীবনের কিছু কিছু মুহূর্তে কানে শুনতে না পাওয়াটা যে পরম সৌভাগ্যের, এটা যাঁরা কানে শুনতে পাওয়ার কারণে চরম অসহায় পরিস্থিতিতে পড়েন, তাঁরাই উপলব্ধি করতে পারেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বজুড়ে শুধু বিনোদনের জন্য যে মাত্রার শব্দদূষণের মধ্যে ১২-৩৫ বছর বয়সী কিশোর-তরুণেরা থাকেন, তাতে ১১০ কোটি তরুণ বধির হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন। আর ২০১৮ সালে বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের এক জরিপ অনুযায়ী, মাত্রাতিরিক্ত শব্দ দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি কমিয়ে দিয়েছে।

৯৯৯, থার্টি ফার্স্ট নাইট ও আমাদের সয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি
আবাসিক এলাকায় মাঝরাতে পাশের বিয়েবাড়ি থেকে আসা প্রচণ্ড জোরে বাজানো গানের আওয়াজে নয় মাসের এক অসুস্থ শিশু ঘুমাতে পারছে না। ঘটনাটি বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গলিতে। তার অভিভাবক অগত্যা ৯৯৯–এ ফোন দিলেন। কিছুক্ষণ পর গান থেমে গেল। কিন্তু থার্টি ফাস্ট রজনীতে পটকা আর আতশবাজির শব্দ–সন্ত্রাসে আতঙ্কিত সেই অভিভাবক যখন ৯৯৯–এ আধা ঘণ্টা ধরে ফোন দিলেন, অপর প্রান্ত থেকে কল রিসিভই করা হলো না।

৩১ ডিসেম্বর রজনীতে নির্বিচারে চলল শব্দ-সন্ত্রাস। সেদিন রাত ১২টা থেকে সাড়ে ১২টা কোথাওবা রাত ১টা অবধি দেশের অন্য জায়গার মতো ঢাকা শহরে প্রচণ্ড শব্দের যে বিভীষিকাময় তাণ্ডবলীলা চলেছে, তা কোনো সভ্য দেশের আধুনিক শহরে চলার কথা নয়। সেই ভয়াবহ শব্দের সঙ্গে কোথাও কোথাও উচ্চমাত্রায় বাজানো হচ্ছিল বিদঘুটে স্বরে গাওয়া উদ্ভট সুরের কিছু অ–বাংলা গান। সব মিলে ছিল যেন শব্দের ‘ভূকম্পন’।
কিন্তু আমাদের কী অসাধারণ সহ্যশক্তি! যাঁদের পরিবারের সদস্যরা শব্দ-সন্ত্রাসী এবং যাঁরা এর শিকার—উভয়ই এই বিকৃত উন্মাদনা সয়েছেন সেদিন রাতে। পরবর্তীতে গত শুক্রবার পুরান ঢাকায় সাকরাইন উৎসবেও একই ধরনের পরিস্থিতি আমরা দেখতে পাই।

এই অনাচার নিয়ে রাষ্ট্র এবং নাগরিক—উভয়ের নীরবতা প্রমাণ করেছে, প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর রাতে নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা আরোপের সঙ্গে সমানতালে বেড়ে চলা এসব বিকৃতি আমদের কাছে এখন স্বাভাবিক। কিন্তু কাউকে কাউকে এর চরম মূল্য দিতে হয় বৈকি। যেমনটি ঘটেছে হার্টে ছিদ্র নিয়ে জন্মগ্রহণ করা মাত্র চার মাস বয়সী শিশু তানজিম উমায়েরের ক্ষেত্রে। তার মৃত্যুর আগের রাতে তার হতভাগা বাবা লিখেছিলেন ‘কী বিকট শব্দ! আমার ছোট বাচ্চাটি এমনিতে হার্টের রোগী। আতশবাজির প্রচণ্ড শব্দে বাচ্চাটি আমার ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠে। খুব ভয় পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। খুব আতঙ্কে রাত পার করছি।’

এমন পরিস্থিতিতেও শব্দের কারণে মানুষের মৃত্যু হতে পারে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক জুড়েছেন বিজ্ঞানবিবর্জিত কিছু মানুষ। প্রশ্ন হলো, শিশুর না হয়ে এ মৃত্যুটি যদি হতো কোনো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশীল ব্যক্তির কিংবা কোনো মন্ত্রীর, যিনি হৃদ্‌যন্ত্রের অসুস্থতায় ভুগছিলেন, তাহলেও কি রাষ্ট্র নীরব থাকত? থাকত না। কারণ সেখানে ‘ক্ষমতা’ নামক একটি ব্যাপার রয়েছে। সেদিন রাতের শব্দ-সন্ত্রাসীদের হাতে যাঁরা আতশবাজি তুলে দিয়েছিলেন এবং যাঁরা সেগুলোর বাণিজ্য ও আমদানির সঙ্গে যুক্ত, তাঁরাও কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট।

অথচ, দেশে একটি শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধি (২০০৬) রয়েছে। কিন্তু সেই বিধিমালায় এলাকাভিত্তিক শব্দের মানমাত্রা কত, তা না মানলে শাস্তির বিধান কী, তা কয়জন নাগরিক জানেন, সেটি একটি বিরাট প্রশ্ন। কোনো গবেষণা ছাড়াই বলা যায়, সাধারণ নাগরিক এসব জানেন না। না জানার অন্যতম কারণ হলো, আইনটির কাগুজে রূপ আছে, বাস্তবায়নের দৃষ্টান্ত নেই।

বিধি আছে, তবে…
দুটো পরিতাপের বিষয় এখানে লক্ষণীয়। প্রথমত, আইনটি প্রণয়নে যথেষ্ট কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল, যাঁদের হাতে ক্ষমতা রয়েছে তাঁদের স্বার্থরক্ষায়। বহু বছর আগে কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, আইন প্রণীত হয় শাসকের স্বার্থে শোষিতের ওপর তা প্রয়োগের জন্য। এ ক্ষেত্রে মার্ক্সের কথা শতভাগ প্রাসঙ্গিক। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধির (২০০৬) ২ (ঘ)-তে বলা হচ্ছে, প্রতিরক্ষা, পুলিশ বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের দাপ্তরিক কাজ সম্পাদনকালে এই বিধিমালা প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ ভিআইপি বহনকারী গাড়ির সামনে পেছনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পিলে চমকানো শব্দে চলা গাড়িগুলোকে শব্দদূষণের দায় থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, শব্দদূষণের ক্ষেত্রে সরকারি যানই আমাদের দেশে এগিয়ে।

আমরা এখনো ভাবতে পারি না, হর্ন না দিয়েও গাড়ি চালানো যায়। পৃথিবীর অনেক দেশে প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে জোরে গান বাজানোর শব্দ এলে, যাঁরা তা শুনতে পান এবং বিরক্ত হন, তাঁরা পুলিশে খবর দেন। আমরা এখনো লাউড স্পিকারে পাড়া কাঁপিয়ে ‘মিউজিক’ না বাজালে গায়েহলুদই হয় না বলে মনে করি। তাতে অন্যের ঘুমের বারোটা বাজুক।

তা ছাড়া আবাসিক-অনাবাসিক এলাকানির্বিশেষে জেনারেটর চালানোকেও শব্দদূষণের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। উপরন্তু, এলাকাভিত্তিক শব্দের মানমাত্রার তালিকাজুড়ে কোন এলাকায় রাতে ও দিনে কত ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ অনুমোদিত, তার কিছুই যে বাস্তবে অনুসরণ করা হয় না, তা পরিবেশ অধিদপ্তরের অজানা নয়।

দ্বিতীয়ত, বিধি ১৮ (২) শব্দদূষণ সৃষ্টিকারী ব্যক্তিকে এক মাসের কারাদণ্ড কিংবা পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড প্রদানের যে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, তা কতটুকু বাস্তবসম্মত বা শব্দদূষণ রোধে কার্যকর? হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারকারী পরিবহনগুলোর মালিক-চালক উভয়ের কাছেই এসব জরিমানা নিছক ছেলেমানুষী ব্যাপার মাত্র। শব্দদূষণ মায়ের গর্ভস্থ সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিকেও যেখানে ব্যাহত করতে পারে, সেখানে আমরা একে ‘এ আর এমন কী’ বা ‘অতি সাধারণ’ একটি ব্যাপার হিসেবে ধরে নিয়েছি।

অতিরিক্ত শব্দযুক্ত পরিবেশ (সেটি হতে পারে যানবাহনের, পটকা ও আতশবাজির, জোরে গান বাজানোর, নির্মাণস্থলের মিক্সচার মেশিন, এমনকি জোরে শব্দ করে কথা বলা, ইত্যাদি) একটি শিশুকে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বধির হওয়ার পথে নিয়ে যায়। শিশুরা হয়ে উঠে অমনোযোগী ও বিকারগ্রস্ত। এর প্রভাবে দুশ্চিন্তা, নিদ্রাহীনতা, উচ্চ রক্তচাপ, ফুসফুসজনিত জটিলতা, হৃদ্‌রোগ, মস্তিষ্ক বিকৃতি, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, এমনকি হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হতে পারে।

সব দায় কি রাষ্ট্রের?
শব্দদূষণের অভিযোগের ভিত্তিতে সৌদি আরবের মসজিদের লাউডস্পিকারের শব্দসীমাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশে সে ধরনের কোনো উদ্যোগ নেই। কানাডার রাস্তায় গাড়ির হর্ন দেওয়া মানে কেউ সিগন্যাল দিতে বা গতি কমবেশি করতে ভুল করেছে, তা মনে করিয়ে দেওয়া। আমরা এখনো ভাবতে পারি না, হর্ন না দিয়েও গাড়ি চালানো যায়। পৃথিবীর অনেক দেশে প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে জোরে গান বাজানোর শব্দ এলে, যাঁরা তা শুনতে পান এবং বিরক্ত হন, তাঁরা পুলিশে খবর দেন। আমরা এখনো লাউড স্পিকারে পাড়া কাঁপিয়ে ‘মিউজিক’ না বাজালে গায়েহলুদই হয় না বলে মনে করি। তাতে অন্যের ঘুমের বারোটা বাজুক। সুইজারল্যান্ডের যেসব এলাকায় গাড়ি চলাচলের শব্দ বেশি, সেসব এলাকায় লোকে বাড়ি ভাড়া নিতে চায় না। গাড়ি চলাচলের শব্দ শুধু নয়, রাত একটা সময় গলির ভেতর নির্মাণকাজের জন্য ট্রাকে নির্মাণসামগ্রী তোলা ও নামানো, এমনকি মিক্সচার মেশিন চালিয়ে সারা রাত গলি সরগরম করে ফেললেও কারও কিছু বলার নেই।

এ তালিকা আরও লম্বা করা সম্ভব। আইন কার্যকর করার অন্যতম শর্ত হলো রাষ্ট্রের নাগরিকের দায়িত্ববোধ ও অন্যের অসুবিধা যেন না হয়, নাগরিকের মাঝে সে সচেতনতাবোধ থাকা। আর এটি তৈরি করতে হয় শৈশব থেকে পারিবারিক শিক্ষার মাধ্যমে। যাঁরা ৩১ তারিখে রাতে নিছক আনন্দের জন্য পটকাবাজি করেছিলেন, তাঁদের কি এই পারিবারিক শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল যে কখনো নিজের আনন্দের জন্য অন্যের অসুবিধা সৃষ্টি করতে নেই? পাশাপাশি এ-ও মনে রাখতে হবে যে বিধিমালা প্রয়োগের মধ্যেই তা প্রণয়নের সার্থকতা। কীভাবে তা প্রয়োগ করতে হয়, সেটি রাষ্ট্রের জানার কথা।

ইশরাত জাকিয়া সুলতানা নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক