শরণার্থী নিয়ে বিড়ম্বনায় মেরকেল

অ্যাঙ্গেলা মেরকেল
অ্যাঙ্গেলা মেরকেল

স্বল্প কথা বলা রাজনীতিক অ্যাঙ্গেলা মেরকেলকে তাঁর শরণার্থীবিষয়ক রাজনীতি নিয়ে হঠাৎ করেই এমনভাবে নাকাল হতে হবে, তা তিনি কস্মিনকালেও ভাবেননি। মাত্র চার মাস আগেই ঘটেছিল সেই অভূতপূর্ব ঘটনা। ট্রেনযোগে হাজার হাজার শরণার্থী হাঙ্গেরি থেকে মিউনিখ হয়ে জার্মানির নানা শহরে যাচ্ছে। শরণার্থীদের অভিনন্দন জানাতে নানা সাহায্যসামগ্রী নিয়ে মিউনিখ, স্টুটগার্ড, ফ্রাঙ্কফুর্ট, কেসেল, ডর্টমুন্ড, বার্লিন, হ্যানোভার আরও উত্তরে হামবুর্গে অপেক্ষা করছে শত শত মানুষ। ট্রেন থেকে নেমে আসছে সিরিয়া, ইরাক ও অন্যান্য দেশের গৃহযুদ্ধে সব হারানো নিঃস্ব আপন ভূমিতে পরাজিত শরণার্থীরা। শত শত সাধারণ জার্মান দুই দিকে সারিবদ্ধভাবে রঙিন বেলুন আর জার্মানিতে স্বাগত লেখা ফেস্টুন হাতে হাততালি আর উল্লাস প্রকাশ করছে। বর্ণ, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতির বাঁধ ভেঙে দিয়ে আপাতত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে যুদ্ধপীড়িত অঞ্চল থেকে দুর্গম দীর্ঘ পথ অতিক্রম করা মানুষের প্রতি মমত্ববোধ ও অভ্যর্থনা জানানোর এমন দৃশ্য ছিল বিরল।
আর চার মাস পরেই নতুন বছরের রাতে কিছু অভিবাসী ও শরণার্থীর উচ্ছৃঙ্খল আচরণ এখন তাদের জার্মানিতে আশ্রয় দেওয়া না-দেওয়ার প্রশ্নে জার্মানির জনগণকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে। বর্ষবরণের রাতের উৎসবে নারীদের প্রতি বর্বরোচিত যৌন নিপীড়নের খবর এখন জার্মানি ছাপিয়ে সর্বত্র। হামবুর্গ, স্টুটগার্ড, কোলনসহ আরও কিছু শহরে ওই রাতে যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য প্রাথমিক তদন্তে দেখা যাচ্ছে যে ঘটনায় দায়ী মূলত উত্তর আফ্রিকা, আলজেরিয়া, মরক্কো ও সিরীয় কিছু শরণার্থী। ঘটনার সময় আরব দেশগুলো থেকে আসা হাজার খানেক মানুষের দল সংঘবদ্ধভাবে কোলনের প্রধান রেলওয়ে স্টেশন ও গির্জা এলাকায় উপস্থিত মেয়েদের নানাভাবে নিপীড়ন করে, সঙ্গে থাকা টাকাপয়সা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় এবং মেয়েদের গায়ে আতশবাজি ছুড়ে মারে। ওই রাতের ঘটনায় শুধু কোলন শহরেই পুলিশের কাছে ৫১৬টি মামলা লিপিবদ্ধ হয়েছে।
অভিবাসী বা শরণার্থীবিষয়ক আইনকানুন জার্মানিতে সব সময় কড়া, নিয়মের বাইরে যাওয়ার জাতি জার্মানরা নয়। তারপরও সেই নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই পরপর দুবার নির্বাচিত জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল শরণার্থীবিষয়ক ডাবলিন চুক্তির শর্ত ভেঙে শরণার্থীদের নিজ দেশে আশ্রয় দিয়েছেন। উল্লেখ্য, শরণার্থীবিষয়ক ডাবলিন চুক্তির শর্ত অনুযায়ী যেকোনো শরণার্থী তাঁর দেশ ত্যাগের পর ইউরোপের প্রথম যে দেশটিতে পৌঁছাবেন, সেখানেই তাঁকে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা বা নাম-পরিচয় রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। তৃতীয় আরেক ইউরোপীয় দেশে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ থাকবে না। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে আসা বিপন্ন মানুষের বিপদের সময় অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের এই মানবিকতা জার্মানিতে তো বটেই, বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে।
অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের নিজ দল খ্রিষ্টান গণতান্ত্রিক দলের অভিবাসীবিরোধী রাজনীতির জন্য সর্বদাই সুবিদিত আর ক্ষমতাসীন জোটের ব্যাভেরিয়া রাজ্যকেন্দ্রিক আরেক ছোট শরিক দল খ্রিষ্টান গণতান্ত্রিক ইউনিয়নের অভিবাসী রাজনীতি বিষয়ে আরও কট্টর। নিজ দল, জোটের শরিক দলসহ ইউরোপের সাম্প্রতিক ক্ষমতাসীন কিছু কট্টর রক্ষণশীল দেশের সমালোচনা ও চোখ রাঙানির তোয়াক্কা না করে অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ২০১৫ সালে জার্মানিতে প্রায় ১০ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছেন। শরণার্থীদের গ্রহণ করার প্রশ্নে তাঁর প্রায় একক সিদ্ধান্ত হলেও তিনি জার্মানির জনগণ ও নিজ দলের সমর্থকদের তাঁর সিদ্ধান্তের গ্রহণযোগ্যতা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ইউরোপমুখী শরণার্থীদের আপাতত ঢল সামলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুরস্কের সঙ্গে গত অক্টোবরে শরণার্থীদের পুনর্বাসনে আর্থিক সহায়তা ও দেশটির ইউরোপীয় ইউনিয়নে সদস্যপদ লাভের শর্তসমূহ শিথিল, সেই দেশের নাগরিকদের ইউরোপে আসার ভিসা সহজ করে দেওয়ার শর্তে সিরিয়া ও ইরাক থেকে আসা শরণার্থীদের ইউরোপে আগমন রোধ ও শরণার্থীদের তুরস্কের সঙ্গে সিরিয়ার ৯১১ কিলোমিটার সীমান্ত অঞ্চলে পুনর্বাসনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
জার্মানির ইসলামবিরোধী পেগিডা মুভমেন্ট বলে পরিচিতরা অনেক আগে থেকেই জার্মানিতে মুসলিম দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের পুনর্বাসনের বিরোধিতা করে আসছে এবং বিভিন্ন শহরে নিয়মিত জমায়েতের আয়োজন করছে, কোলনের এই ঘটনাকে তাদের আন্দোলনের একটি জোরালো অস্ত্র বলে মনে করা হচ্ছে। পেগিডার মুখপাত্ররা বলছেন, ওই যৌন হয়রানির ঘটনা প্রমাণ করে যে মেরকেলের উদার অভিবাসী নীতি দেশকে বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
যদিও ইউরোপে মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাসটা বেশ পুরোনো। ইউরোপীয় দেশগুলোর ঔপনিবেশিক রাজনীতি তথা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অতিথি শ্রমিক হিসেবে বহু আগে থেকেই ইউরোপে মুসলমানদের আগমন ঘটেছে। অবশ্য সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, তুরস্কের ইউরোপীয় অংশ এবং বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া, মন্টিনিগ্রো, বসনিয়া হার্জেগোভিনা ও কসোভোতে অনেক আগে থেকেই মুসলমান জাতিগোষ্ঠী রয়েছে।

>মুসলমান শরণার্থীদের গ্রহণের ব্যাপারে অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের উদারনীতি এখন তাঁর নিজ দল ও জার্মানির জনগণের কাছে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে

ইউরোপে প্রায় ৮৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মুসলমান নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ছয় কোটি। তবে দেশভাগে বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের বসবাসের তারতম্য আছে। নানা ধর্মবিন্যাসে ইউরোপের ৭০ শতাংশ মানুষ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। ইউরোপে বসবাসরত বেশির ভাগ মুসলমান ইউরোপীয় সেক্যুলার চিন্তাচেতনায় প্রভাবিত। তবে এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ইউরোপে বসবাসরত মুসলমান পরিবারগুলোর নতুন প্রজন্মের বেশির ভাগ সন্তান উচ্চশিক্ষা নিতে অনাগ্রহী এবং ৫০ শতাংশের বেশি পরিবার কর্মসংস্থানের চেষ্টা না করে বসবাসরত দেশগুলোর সামাজিক ভাতা নিয়ে চলতে অধিক আগ্রহী। এ ছাড়া লন্ডনসহ বিভিন্ন বড় শহরে দেশীয় টেলিভিশনের চ্যানেলগুলোর সময় পিক আওয়ারে ভাড়া নিয়ে অনেকে ধর্মের নামে নানা অজুহাতে প্রবাসীদের কাছে চাঁদা আদায় করতে সচেষ্ট থাকে। ইউরোপে বসবাসরত কিছু কট্টরপন্থী ইসলামি সংগঠনের সহিংস কার্যকলাপ এবং ইউরোপের দেশগুলো থেকে কয়েক হাজার তরুণ-তরুণীর জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের লড়াইয়ে যোগ দিতে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার ঘটনা মহাদেশটিতে ইসলামবিরোধী আন্দোলনকারীদের পুঁজি হয়ে উঠেছে। ইতিপূর্বে প্যারিসের সন্ত্রাসী ঘটনা আর কোলনে ব্যাপকভাবে নারী নির্যাতনের ঘটনা মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের সংকট হিসেবে দেখা হচ্ছে।
মুসলমান শরণার্থীদের গ্রহণের ব্যাপারে অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের উদারনীতি এখন তাঁর নিজ দল ও জার্মানির জনগণের কাছে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তবে অ্যাঙ্গেলা মেরকেল বলেছেন, যেসব অভিবাসী অপরাধ করবে, তাদের যাতে সহজেই এবং খুব দ্রুত নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো যায়, সে বিষয়ে তাঁরা আইন সংশোধন করার কথা ভাবছেন। তিনি বলেছেন, শরিক দলগুলোর সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে আলোচনা করবেন এবং এ বিষয়ে চূড়ান্ত আইনের জন্য পার্লামেন্টের অনুমোদন প্রয়োজন।
ইউরোপের অনেক দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের ধনবান ইসলামি দেশগুলো যখন সিরিয়া বা ইরাকের গৃহহারা নিঃস্ব যুদ্ধপীড়িত মানুষের প্রতি কোনো রকম মমত্ব বোধ বা ইসলামি উম্মাহর কোনো দৃশ্যত নিদর্শন ও সংহতি প্রদর্শন করেননি, তখন অজানা-অচেনা, ভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের অসহায় শরণার্থীদের প্রতি মানবিকতা ও মমত্ববোধের যে দৃষ্টান্ত জার্মানির জনগণ দেখিয়েছিল, নববর্ষের রাতের সেই লজ্জাজনক ঘটনা তাতে শুধু কালিমাই লেপন করেছে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি।
sharaf. [email protected]