শরণার্থী সংকটে নিরাশার এক বছর

বাংলাদেশে মোট আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি
বাংলাদেশে মোট আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি

গত বছরের ২৫ আগস্টের রাতটা কেমন ছিল, সেটা যদি কুতুপালং কিংবা কক্সবাজারের অন্যান্য শিবিরে আশ্রয় নেওয়া প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাহলে সম্ভবত তারা সবাই বলবে, আমরা ওই দুঃস্বপ্ন স্মরণ করতে চাই না। এর দুদিন আগে, ২৩ আগস্ট, মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির কাছে আরাকান রাজ্যে স্থায়ী শান্তি আনার লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান তাঁর সুপারিশমালা পেশ করেন। তার ৪৮ ঘণ্টা না পেরোতেই, আগে শোনা যায়নি এমন এক গেরিলা গোষ্ঠী ‘আরসা’র আবির্ভাব ঘটল। চরম নিষ্ঠুরতা এবং দুর্নীতির জন্য খ্যাত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জন্য তৈরি হয়ে গেল ধর্মীয় সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূলের অজুহাত। সিরিয়ার মতো মিয়ানমারেও তাঁর শান্তির উদ্যোগ এবং পরিকল্পনার করুণ অপমৃত্যু প্রত্যক্ষ করেই গেল সপ্তাহে কফি আনান পরপারে লোকান্তরিত হয়েছেন। কূটনীতিক কফি আনানের দূতিয়ালি ব্যর্থ হওয়ার দায় অবশ্য তাঁর একার নয়, পুরো বিশ্বের-আমাদের সবার।

কূটনৈতিক মহলে এমন একটি কথা চালু আছে যে সংকট দীর্ঘায়িত করতে হলে জাতিসংঘকে যুক্ত করুন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যের পরস্পরবিরোধী স্বার্থের টানাপোড়েনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমন অচলাবস্থা তৈরি হয় যে জাতিসংঘ কার্যত অসহায় দর্শকে পরিণত হয়। মানবিক সেবা ছাড়া তাদের আর দেওয়ার কিছুই থাকে না। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ফিলিস্তিন সংকট-এসব ক্ষেত্রে বিশ্ববাসীর অভিজ্ঞতা সে রকমই।

জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার বিদায়ী প্রধান জেইদ রাদ আল হুসেইন গেল সপ্তাহেই নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের হাতে অত্যধিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকায় বিশ্ব সংস্থাটিতে কী ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে, তা স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারা এবং সিরিয়া প্রশ্নে সমঝোতা না হওয়ার দৃষ্টান্ত দিয়েই তিনি এ কথা বলেছেন। মিয়ানমারেও এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। নিরাপত্তা পরিষদে অন্তত চার দফা আলোচনা হলেও কোনো নিষেধাজ্ঞা কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। অথচ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত বছরের সেপ্টেম্বরেই বলেছেন, মিয়ানমারে যা চলছে তা জাতিগত নির্মূলের পর্যায়ে পড়তে পারে।

জাতিসংঘ অবশ্য মানবিক সহায়তায় পিছিয়ে নেই। নিরাপত্তা পরিষদ ২৮ আগস্ট বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া উদ্বাস্তুদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনবে ব্রিটিশ অভিনেত্রী কেট ব্লানচেটের কাছ থেকে। উদ্বাস্তুদের জরুরি সেবা-শিক্ষা, চিকিৎসা, অস্থায়ী আবাস, খাদ্য-সহায়তায় আরও অর্থায়নের জন্য হয়তো আবারও আবেদন শোনা যাবে। কিন্তু উদ্বাস্তুদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-এ দুই বিষয়েই আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। এই সংকটের বোঝা সবচেয়ে বেশি বহন করতে হচ্ছে যাদের, সেই বাংলাদেশও রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ঢল শুরুর সময় থেকেই প্রতিবেশীর প্রতি একটু বেশিই নমনীয়তা দেখিয়ে চলেছে। শুরুতে প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য একটি নিরাপদ অঞ্চল বা সেফ জোন প্রতিষ্ঠার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তর যে সে বিষয়ে যথেষ্ট তৎপর ছিল, তার কোনো আলামত মেলেনি। বরং সব সময়ই কিছুটা সিদ্ধান্তহীনতা, সংশয় এবং দূরদৃষ্টির অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। আরাকানের পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখার ব্যবস্থা করতেই পার হয়েছে এক বছর। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও প্রত্যাবাসন শুরুর কাগুজে আশ্বাসে তারা ভরসা রেখেছে।

মিয়ানমার অবশ্য তার লক্ষ্য থেকে একটুও বিচ্যুত হয়নি। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাগরিক অধিকার হরণের প্রক্রিয়া পরিচালনার মাধ্যমে তাদের দেশান্তরি করার যে ধারা কয়েক দশক ধরে দেশটির সামরিক বাহিনী এবং উগ্রপন্থী বৌদ্ধধর্মীয় গোষ্ঠী চালিয়ে আসছে, তা এখনো অব্যাহত আছে। সীমান্তের শূন্যরেখায় আটকে থাকা শত শত নারী-শিশুকেও ফিরিয়ে নিতে তারা আগ্রহী নয়। কফি আনান কমিশন নাগরিকত্বের প্রশ্ন মীমাংসা, অবাধে চলাচলের স্বাধীনতা ও পূর্ণ নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতিসহ যে ৮৮ দফা সুপারিশ পেশ করেছিল, সামরিক বাহিনী তা গ্রহণে প্রকাশ্যেই অস্বীকৃতি জানিয়েছে। আর বেসামরিক নেত্রী অং সান সু চি সেসব সুপারিশের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো অঙ্গীকার করা থেকে বিরত থাকতে সময়ক্ষেপণের কৌশল নিয়েছেন। আনান কমিশনের সুপারিশ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তিনি একের পর এক আরও দুটো কমিশন গঠন করেছেন। এর মধ্যে একটি কমিশনের যুগ্ম-প্রধান যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান নেতা বিল রিচার্ডসন ওই কমিশনকে মিয়ানমারের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা অভিহিত করে সরে দাঁড়ান। চলতি মাসের মাঝামাঝি সু চি ফিলিপাইনের কূটনীতিক রোজারিও মানালোর নেতৃত্বে তৃতীয় আরেকটি কমিশন করেছেন।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তরফে যখনই চাপ তৈরি হয়েছে, তখনই দ্বিপক্ষীয় আলোচনা কিংবা এ ধরনের কমিশন গঠনের কৌশল নিয়েছে মিয়ানমার। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি এবং পদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির প্রতিক্রিয়ায় গঠিত হয় দ্বিতীয় কমিশন। আর সর্বসম্প্রতি তৃতীয় কমিশনটি গঠিত হওয়ার পটভূমিতে আছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়টিতে শুনানি অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা। মিয়ানমার রোম সনদের স্বাক্ষরকারী না হলেও তাদের সীমান্তের ভেতরের অপরাধের শিকার জনগোষ্ঠীর ক্ষতের ভার বাংলাদেশকে বইতে হচ্ছে বলে আইসিসি ওই অপরাধের বিচারের এখতিয়ার রাখে কি না, তা নিয়ে শুনানির উদ্যোগ নিয়েছে। এ বিষয়ে আইসিসির আহ্বানের জবাবে বাংলাদেশ বিচারের পক্ষেই মতামত দিয়েছে। মিয়ানমার মতামত জানানোর জন্য আইসিসির অনুরোধ গ্রহণ করেনি। তবে, দেশটির সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, থাইনিংগা ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ কথিত রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন আরসার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার দাবি জানিয়ে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে শুনানিতে পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন করেছিল। আদালত অবশ্য সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন।

বিশ্বে বর্তমানে যত উদ্বাস্তু আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আশ্রয়দানকারীর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম (সূত্র: গ্লোবাল ট্রেন্ডস ২০১৭, ইউএনএইচসিআর)। তবে, স্বল্পতম সময়ে সর্বাধিক উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান সবার ওপরে। ২০১৭-এর সংকট শুরুর আগেই গত বছর এবং তার আগের কয়েক দশকে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের নিয়ে বাংলাদেশে মোট আশ্রয় গ্রহণকারীর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। এই বাড়তি জনগোষ্ঠীর চাপ গ্রহণের মতো আর্থিক, ভৌগোলিক ও পরিবেশগত সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। কিন্তু মানবিক কারণে এই চাপ আমরা বহন করে চলেছি এবং সে জন্য বিশ্ববাসীর সমীহ এবং প্রশংসাও পেয়েছি।

বৈশ্বিক বাস্তবতায় এটি এক অনন্য উদাহরণ। উন্নত দেশগুলোর প্রায় সবাই উদ্বাস্তুপ্রবাহ ঠেকাতে সম্ভাব্য সব ব্যবস্থাই নিচ্ছে। অভিবাসন এবং উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি ওই সব গণতন্ত্রে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শপথ গ্রহণের পর প্রথম যে আদেশে সই করেছিলেন, তা হচ্ছে সংঘাত ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে থাকা মুসলিম দেশগুলোর নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা বিষয়ে। ব্রিটেনের ইউরোপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পেছনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে কিছুটা ছাড় দেওয়ার বিষয় যেমন আছে, তেমনই আছে অভিবাসন প্রসঙ্গ। উদ্বাস্তুদের পছন্দের তালিকায় সব সময়ই ব্রিটেনের অবস্থান ওপরের দিকে এবং সেই কারণে ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে উদ্বাস্তুপ্রবাহ বন্ধে গত কয়েক দশকে বহুবার নানা ধরনের অপ্রিয় ঘটনার জন্ম হয়েছে। হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া ও ইতালিতে বিদেশি বিদ্বেষ চরমে পৌঁছেছে এবং কট্টর ডানপন্থী বর্ণবাদীরা সরকারে জায়গা করে নিচ্ছে। ইউরোপের সবচেয়ে উদ্বাস্তুবান্ধব সরকার হিসেবে খ্যাতি পাওয়া আঙ্গেলা ম্যার্কেল জার্মানিতে গত নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে বঞ্চিত হয়ে আপসরফার সরকার গড়েছেন।

ভিনদেশি সংস্কৃতির কথিত আগ্রাসন বন্ধে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারতও পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের প্রধান কারণই কথিত অনুপ্রবেশ বন্ধ করা। বিপন্ন রোহিঙ্গারা যাতে সে দেশে ঢুকতে না পারে, সে জন্য দিল্লির রাজনীতিকদের নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের কথাও আমরা জানি। মিয়ানমারের আরেক সীমান্তে সান এবং কাচিন প্রদেশে গত মে মাসে জাতিগত বিদ্রোহী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মোকাবিলায় সেনা অভিযানের সময় চীনের প্রতিক্রিয়াও উদ্বাস্তুবান্ধব ছিল না। উদ্বাস্তুদের গ্রহণ এবং তাদের দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসনের জন্য এসব দেশের কথিত সহায়তার আশ্বাস তাই কার্যত একধরনের পরিহাস। জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক ফোরামে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাবে আমরা এসব বন্ধুরাষ্ট্রের সমর্থনও আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছি।

কয়েক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে জাতিগত নির্মূল নীতি অনুসরণ করে আসছে যে দেশটি, সেই প্রতিবেশীর আশ্বাস যে শুধুই অপকৌশল তা অনুধাবনেই পার হয়েছে একটি বছর। আপসের নীতি যে এ ক্ষেত্রে অকার্যকর তা ইতিমধ্যেই প্রমাণ হয়েছে। গণহত্যার বিচার এবং জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পক্ষে বৈশ্বিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠার দিকেই বরং আমাদের মনোযোগী হওয়া উচিত। আবারও একঘরে হয়ে পড়ার চাপেই দেশটি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের প্রশ্নটির নিষ্পত্তিতে বাধ্য হতে পারে এবং তাহলেই প্রত্যাবাসনের পথ সুগম হবে।

কামাল আহমেদ সাংবাদিক