শরণার্থী সংকটের দায়বদ্ধতা কার?

এই লরি থেকে উদ্ধার হয়েছে শরণার্থীদের মৃতদেহ
এই লরি থেকে উদ্ধার হয়েছে শরণার্থীদের মৃতদেহ

এবার আর ভূমধ্যসাগরের অতল জলে নয়, এবার মধ্য ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সংযোগকারী ব্যস্ত হাইওয়েতে একটি লরি থেকে উদ্ধার হলো ৭১ জন সিরীয় শরণার্থীর লাশ। মানব পাচারকারীরা মাত্র ১৩ বর্গমিটারের লরিতে গাদাগাদি করে এসব ভাগ্যহত মানুষকে হাঙ্গেরি থেকে অস্ট্রিয়া বা জার্মানিতে নিয়ে যাচ্ছিল। মাঝে ভিয়েনা শহরের ১০ মাইল দক্ষিণে হাইওয়ের পাশে থেমে থাকা লরি থেকে লাল তরল পদার্থের নির্গমন দেখে হাইওয়ে পুলিশের সন্দেহের পর বন্ধ লরির দরজা খুলে এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে পায়। প্রাথমিক তদন্তে, এদের সবাই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
ইউরোপে কয়েক সপ্তাহ ধরেই এখানে আগমনরত শরণার্থী নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে, মহাদেশজুড়ে সংবাদমাধ্যমগুলো সোচ্চার রয়েছে, ইউরোপীয় দেশগুলোয় উন্মুক্ত সীমান্ত পুনরায় বন্ধ করে দেওয়া, সীমান্তে আরও কড়াকড়ি, শরণার্থীদের আশ্রয় ও পুনর্বাসনের সমস্যা, আশ্রয়স্থলগুলোয় পৌঁছানোর আগেই রাস্তায় বাধা সৃষ্টি, কোথাও কোথাও আগুন দেওয়ার খবর, মানব পাচারকারী গ্রেপ্তার—এ-সংক্রান্ত নানা ঘটনা নিত্যদিনের খবর হচ্ছে অথচ আসল আলোচনাটি নেই।
সিরিয়া, লিবিয়া বা ইরাকের মতো দেশগুলো থেকে কেন এত উদ্বাস্তু জীবন বাজি রেখে নিজের জন্মভূমি ফেলে দুর্গম সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপের পথে পা বাড়াল, সেই আলোচনা ইউরোপের কোথাও নেই, সযত্নে এই আলোচনা এড়িয়ে চলেছেন সবাই। ওই সব দেশে হয়তো পশ্চিমা আদলের গণতন্ত্র ছিল না, তাই বলে তো এখনকার মতো গৃহযুদ্ধ আর হানাহানিও ছিল না, আর ওই সব দেশের মানুষকে বাস্তুহারা করার পেছনে ইউরোপের অনেক দেশ, আমেরিকা আর ন্যাটো জোট তাদের ভুল যুদ্ধনীতিকে অস্বীকার করতে পারবে না বা যুদ্ধের কারণে আজকের যে মানবিক সমস্যা, তাতে তাদের দায়ভার বা দায়বদ্ধতার কথাও অস্বীকার করতে পারবে না, কিন্তু সেই আলোচনা ইউরোপের কোথাও নেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীজুড়ে বিপন্ন জীবন বাঁচাতে আর মাথা গোঁজার জন্য নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে এত শরণার্থীর নানা দিকে ছোটাছুটির ঘটনা এর আগে আর ঘটেনি। ২০১৪ সালে যুদ্ধ-দাঙ্গাপীড়িত বা অভাবের তাড়নায় প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ নিজের জন্মভূমি আর ঘরবসত ছেড়ে নানা দেশে পাড়ি দিয়েছিল।
এদের মধ্য ২০১৪ সালেই ৮০ শতাংশ মানুষই সমস্যাজর্জরিত নিজ দেশ ছেড়ে আশপাশের প্রতিবেশী দেশে ঠাঁই নিয়েছে এই আশায় যে নিজেদের দেশের সমস্যা মিটে গেলেই পুনরায় তারা জন্মভূমিতে ফিরে যাবে। বিরাটসংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া দেশগুলো হলো তুরস্ক, ইরান, জর্ডান, লেবানন, পাকিস্তান, কেনিয়া, চাদ ও ইথিওপিয়া। বলাই বাহুল্য, এই আশ্রয়দাতা দেশগুলো নিজেদের শত সমস্যার মাঝে নিরাশ্রয় বিপদাপন্নদের আশ্রয় দিয়েছে।
এই সংখ্যার বিপরীতে বাকি ২০ শতাংশ মানুষের মধ্য কেবল ৬ লাখ ২৫ হাজার মানুষ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টি দেশে আশ্রয় নিয়েছিল। এদের মধ্য বেশির ভাগ শরণার্থী গেছে ইউরোপের সেই দেশগুলোয়, যেখানে সামাজিক সুযোগ-সুবিধার পরিমাণ বেশি।
সেই হিসাবে সর্বোচ্চ জার্মানিতে ১ লাখ ৭৩ হাজার, সুইডেনে প্রায় ৭৫ হাজার, ফ্রান্সে ৫৭ হাজার, আর যুক্তরাজ্যে ৩১ হাজার এবং আরও কিছু দেশে।
এই তো গেল ২০১৪ সালের মোটামুটি একটা হিসাব। আর এই বছরের চালচিত্রটা অন্য রকম। কারণ হিসেবে ইউরোপের অভিবাসী এবং শরণার্থী–বিষয়ক সংগঠনগুলো পাঁচটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছে। কারণগুলো হলো—১. সিরিয়া, ইরাক আর লিবিয়ায় আত্মঘাতী জাতিগত গৃহযুদ্ধ আরও বেড়ে যাওয়া ২. দাঙ্গাপীড়িত দেশগুলোতে শিগগিরই সমস্যা সমাধানের আশা না থাকা ৩. প্রতিবেশী দেশগুলোর শরণার্থীদের সমস্যা ও পুনর্বাসনের ব্যাপারে অনীহা ৪. তুরস্কে বসবাসরত সিরিয়ার শরণার্থীদের যেকোনো সময় ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা ৫. সাবেক যুগোস্লাভিয়ার বিভক্ত বলকান রাষ্ট্র সার্বিয়া, কসোভো মন্টেনেগ্রো ও মেসিডোনিয়ার মতো দেশগুলোতে অর্থনৈতিক বিপর্যয়। আর মূলত এসব কারণেই এই বছর ইউরোপে শরণার্থীদের আগমনটা বেড়েছে। জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টমাস ডে ম্যাজেয়ার বলেছেন, গত বছর কেবল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ২ লাখ ১৮ হাজার মানুষ ইউরোপে প্রবেশ করেছিল, তবে এই বছর তা ছাড়িয়ে ৫ থেকে ১০ লাখে পৌঁছাবে। তিনি আরও জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে লিবিয়ায় প্রায় ১০ লাখ শরণার্থী ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
এই বছরের ২৫ জুন ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইতালি ও গ্রিসে আসা প্রায় লক্ষাধিক শরণার্থীকে পুনর্বাসনের জন্য এবং ইতালি ও গ্রিসে শরণার্থীবিষয়ক সংকট কাটানোর লক্ষ্যে ৪০ হাজার শরণার্থীকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোয় পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সংখ্যার বাইরে আরও ২০ হাজার সিরীয় শরণার্থীকে যুদ্ধপীড়িত দেশটির উদ্বাস্তু শিবির থেকে বিমানযোগে সরাসরি ইউরোপে আনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। তবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে থেকেই যুক্তরাজ্য, পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ ও বাল্টিক দেশগুলো শরণার্থীদের নেওয়ার ব্যাপারে গড়িমসি করছে। এই প্রথম বহু বছর পর যুক্তরাষ্ট্রও আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১০ হাজার শরণার্থী নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
উল্লেখ্য, মধ্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকার বলেছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যত অভিবাসী ইউরোপে আসছে, তার চেয়ে বেশি অভিবাসী বলকান অঞ্চল পাড়ি দিয়ে ইইউভুক্ত দেশগুলোয় প্রবেশ করছে বিধায় সেঙ্গেন চুক্তিভুক্ত মুক্ত সীমান্তপ্রথা বাতিল করে পুনরায় সীমান্তচৌকিগুলোয় তল্লাশিপ্রথা চালু করার কথা উঠেছে। যুক্তরাজ্য অভিবাসী ও শরণার্থীদের আগমন ঠেকাতে শিগগিরই কঠোর আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। ইউরোপে বর্ণবাদী ও অভিবাসীবিরোধী দলগুলোও ইউরোপে শরণার্থী আগমন রোধে বিক্ষোভ ও নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক মানুষ দুর্গতপীড়িত অঞ্চল থেকে আসা শরণার্থীদের সহযোগিতার ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তুলনায় ইউরোপে আসা শরণার্থীদের সংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও অনুন্নয়নশীল দেশগুলোয় শরণার্থীদের পেছনে সিংহভাগ ব্যয়টা করে থাকে জাতিসংঘের শরণার্থী–বিষয়ক হাইকমিশন। আর ইউরোপের উন্নয়নশীল বেশির ভাগ দেশে আসা শরণার্থীদের আবাস, চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা ছাড়াও সামান্য হাতখরচ দেওয়ার নিয়ম চালু রয়েছে। আর শরণার্থীদের পেছনে এই খরচাদি বহন করছে মূলত নিজ নিজ দেশের করদাতারা। এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, জার্মানিতে আসা শরণার্থীদের পেছনে মাথাপিছু বার্ষিক ব্যয় প্রায় ১৩ হাজার ইউরো আর তা মেটাতে একজন করদাতাকে গত বছরে নিদেনপক্ষে ২০ ইউরো বেশি কর দিতে হয়েছে আর এই বছর শরণার্থীদের সংখ্যা বাড়ার কারণে তা অনেক গুণ বাড়বে। এই বছরের শেষ দিক পর্যন্ত জার্মানিতে রেকর্ডসংখ্যক ৮ লাখ শরণার্থী আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, এই শরণার্থীর আগমন ও তাদের পুনর্বাসনের জন্য জার্মান সরকার এবং শরণার্থী–বিষয়ক সংগঠনগুলো নানা রকম তৎপরতা চালাচ্ছে।
শরণার্থীদের ইউরোপে আসার পেছনের ঘটনা যদিও গণমাধ্যমে আসছে না, তারপরও আশার কথা ইউরোপের মুক্তবুদ্ধির বিপুলসংখ্যক মানুষ এখানে আসা শরণার্থীদের জন্য ধর্ম আর বর্ণের বাঁধ ভেঙে যেভাবে নানা রকম মানবিক সহযোগিতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে সাহায্য আর সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তা ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে রইবে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি।
[email protected]