শহীদ ডা. মিলনের আত্মত্যাগ ও অধরা গণতন্ত্র

২৭ নভেম্বর ছিল ডা. মিলন দিবস। ৩০ বছর আগে ১৯৯০ সালের এই দিনে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে তৎকালীন সরকারের লেলিয়ে দেওয়া ঘাতকদের হাতে খুন হন ডা. শামসুল আলম খান মিলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের সীমানা ঘেঁষে নির্মিত ছোট্ট ত্রিকোণাকৃতি স্মৃতিস্তম্ভটি তাঁর আত্মদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে।

সেদিন ডা. মিলনের আত্মত্যাগের ঘটনায় সমগ্র দেশ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠেছিল, আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ইস্পাতকঠিন প্রতিজ্ঞার মুখে স্বৈরাচারী এরশাদের আস্ফালন বাতাসে মিলিয়ে যায়। গদি রক্ষার জন্য তিনি মরণ কামড় দেন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। সংবাদপত্রের ওপর আরোপ করা হয় কঠোর বিধিনিষেধ। বলা হয় যেকোনো সংবাদ প্রকাশের আগে সরকারের নিয়োজিত কর্মকর্তাকে দেখিয়ে নিতে হবে। এর প্রতিবাদে সাংবাদিকেরা লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দেন। ফলে এরশাদ ক্ষমতায় থাকতে বাংলাদেশে কোনো পত্রিকা বের হয়নি। তখন সরকারের মালিকানাধীন একাধিক পত্রিকা ছিল। তারপরও দলমত-নির্বিশেষে সাংবাদিকেরা গণতন্ত্রের সংগ্রামে সামনের কাতারে দাঁড়িয়েছিলেন। ঐক্যবদ্ধ ছিলেন বলেই তাঁরা সেদিন এই সাহসী ভূমিকা নিতে পেরেছিলেন। আজ সাংবাদিকেরা নানা দলে-উপদলে বিভক্ত।

তিন জোটের রূপরেখায় স্বৈরাচারের চিহ্নিত সহযোগীদের দলে না নেওয়ার যে অঙ্গীকার ছিল, কোনো দলই তা মানেনি। তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে ভাগাভাগি করে ছিলেন এবং এখনো আছেন।

২৭ নভেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণার পাশাপাশি এরশাদ কারফিউ জারি করেন; কিন্তু আন্দোলনরত মানুষকে কারফিউ-গুলি-কাঁদানে গ্যাসের শেল কিছুই নিবৃত্ত করতে পারেনি। জনতার বিদ্রোহ মোকাবিলার সাধ্য স্বৈরাচারীর ছিল না। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

তার আগে ১৯ নভেম্বর আন্দোলনরত তিন জোট—আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দল, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দল এবং ৫–দলীয় বাম জোট মিলে ঘোষণা করে পাঁচ দফা কর্মসূচি। এতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ‘সার্বভৌম সংসদ’ প্রতিষ্ঠা এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করার কথা বলা হয়েছিল। অঙ্গীকার করা হয়েছিল হত্যা, অভ্যুত্থান, ষড়যন্ত্রের রাজনীতির অবসান ঘটানো হবে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় দেশে ‘পুনর্গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়েছিল তিন জোটের রূপরেখায়।

এরশাদের পতনের পর আন্দোলনরত তিন জোট ‘রাজনৈতিক দলসমূহের পারস্পরিক আচরণবিধি’ নামে একটি অঙ্গীকারনামায়ও সই করেছিল। তারা অঙ্গীকার করেছিল, ‘...আমরা তিনটি জোটের নেতৃবৃন্দ সুষ্ঠুভাবে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের নিম্নবর্ণিত অভিন্ন অঙ্গীকার পালনের জন্য আমাদের সকল কর্মী ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’

আচরণবিধির ৩ নম্বর ধারা ছিল এ রকম, ‘আমাদের তিনটি জোটভুক্ত দলসমূহ ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা এবং অপর দলের দেশপ্রেম ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে কটাক্ষ করা থেকে বিরত থাকবে। আমাদের জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলসমূহ সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় প্রদান করবে না এবং সাম্প্রদায়িক প্রচারণা সমবেতভাবে প্রতিরোধ করবে।’

৪ নম্বর ধারায় বলা হয়, ‘নির্বাচনী কার্যক্রমে সর্বতোভাবে সংঘাত পরিহার করার জন্য তিনটি রাজনৈতিক জোটভুক্ত দলসমূহ অঙ্গীকার করছে। সে জন্য এরশাদের স্বৈরাচারী সরকারের চিহ্নিত সহযোগী ও অবৈধ অস্ত্রধারীদের আমাদের জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলসমূহে স্থান না দেওয়ার জন্য আমাদের ইতিপূর্বে প্রদত্ত ঘোষণা কঠোরভাবে কার্যকর করা হবে। ভোটাররা যাতে স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে এবং ভোটকেন্দ্রে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকে, সে বিষয়ে আমাদের তিনটি জোটভুক্ত দলসমূহ সতর্ক দৃষ্টি রাখবে।’

তিন জোটের রূপরেখায় স্বৈরাচারের চিহ্নিত সহযোগীদের দলে না নেওয়ার যে অঙ্গীকার ছিল, কোনো দলই তা মানেনি। তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে ভাগাভাগি করে ছিলেন এবং এখনো আছেন। স্বৈরাচারের সঙ্গে জোট গড়েছেন। অন্যদিকে মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে বিএনপির বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছে; বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে সরকারেও নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে।

স্বৈরাচারের আমলে সংঘটিত সব হত্যার বিচার করার ওয়াদা করেছিলেন রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা। কিন্তু তাঁরা সেই ওয়াদা রাখেননি। ডা. মিলনের হত্যাকাণ্ড ছিল একটি রাজনৈতিক হত্যা। কিন্তু মামলা দাঁড় করানো হয় নিছক ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে। ফলে চাক্ষুষ সাক্ষ্য–প্রমাণ না থাকায় এই মামলার সব আসামি বেকসুর খালাস পেয়ে যান। ডা. মিলনকে কেন খুন করা হয়েছিল, তা কারও অজানা নয়। স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে চিকিৎসকদের যাঁরা সংগঠিত করেছিলেন, বিএমএর তৎকালীন সহকারী সম্পাদক ডা. মিলন ছিলেন তাঁদের একজন। ২৭ নভেম্বর সকালে তিনি রিকশাযোগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পিজিতে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) যাচ্ছিলেন। টিএসসি পার হতেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিক থেকে দুর্বৃত্তরা গুলি ছুড়লে তাঁর বুকে এসে লাগে। সেই গুলি ভিন্ন গ্রহের কেউ এসে ছোড়েনি। কে তাঁকে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিল? তার তিন বছর আগে, ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে জিপিওর সামনে মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এরপর তাঁকে লক্ষ্য করেই পুলিশ গুলি ছোড়ে। সেদিন সেখানে কারা দায়িত্বে ছিলেন, কে বা কারা মিছিল লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে, বের করা অসম্ভব ছিল না।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো মানুষ যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিয়েছে, সেটা কতটা সংহত হয়েছে? আজ বিএনপি অভিযোগ করে, আওয়ামী লীগ স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ চালাচ্ছে। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগও একই অভিযোগ করত। গণতন্ত্র অধরাই থেকে গেছে।

এরশাদের পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় আসে। বিএনপির পর আওয়ামী লীগ। কিন্তু গত তিন দশকে কোনো সরকারই নূর হোসেন হত্যার বিচার করেনি। বিচার হয়নি শ্রমিকনেতা তাজুল ইসলাম, ছাত্রনেতা রাউফুন বসুনিয়া, সেলিম-দেলোয়ারসহ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নিহত আরও অনেক হত্যার। আওয়ামী লীগ নেতা ময়েজউদ্দিন হত্যার বিচার হলেও এরশাদ যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আজম খানকে ‘মাফ’ করে দেন। এখন তাঁর দল ‘গণতন্ত্রের সহযাত্রী’।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচার করেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য যাঁরা জীবন দিলেন, তাঁদের ঘাতকদের কেন বিচারের আওতায় আনা গেল না? ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় হত্যাকারীদের যাঁরা সরকারি পদে থেকে রক্ষা করেছেন, ন্যায্যতই তাঁদের বিচার হয়েছে। একইভাবে স্বৈরাচারের আমলে সংঘটিত হত্যাগুলোর সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদেরও বিচারের মুখোমুখি করা উচিত ছিল।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো মানুষ যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিয়েছে, সেটা কতটা সংহত হয়েছে? আজ বিএনপি অভিযোগ করে, আওয়ামী লীগ স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ চালাচ্ছে। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগও একই অভিযোগ করত। গণতন্ত্র অধরাই থেকে গেছে। গণতন্ত্র মানে শুধু লেবাস ও ছবি বদল নয়, গণতন্ত্র একটি ব্যবস্থা এবং তার নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলন। আব্রাহাম লিংকনের ভাষায়, ‘গণতন্ত্র হলো জনগণ দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসন।’ কিন্তু দুঃখজনক হলেও আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেই জনগণই অনুপস্থিত থাকে। তারা কেবলই সংখ্যা।

কতিন জোটের রূপরেখায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক ধারায় দেশ শাসনের কথা বলা হয়েছিল। এখন ঘরে-বাইরে, মাঠে–ময়দানে (সবাই মাঠে নামতে না পারলেও কেউ কেউ পারে) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব বক্তৃতা-বিবৃতির জোয়ার বইছে, তাতে বলার উপায় নেই যে দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক ধারায় চলছে।

স্বৈরাচারের পতনের তিন দশক পর পেছনে তাকিয়ে মনে হয়, সরকারি ও বিরোধী দলের রাজনীতিকেরা তিন জোটের রূপরেখা পুরোপুরি ভুলে গেছেন। তিন জোটের রূপরেখায় রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা তথা ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা না করার কথা বলা হয়েছিল। এখন বড় দুই দলের নেতারা একে অপরকে গালমন্দ না করে কথা বলেন না।

গত তিন দশকে বাংলাদেশ অর্থনীতির সূচকে অনেক এগিয়ে গেছে। মানুষের গড় আয় ও আয়ু দুটোই বেড়েছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। প্রবৃদ্ধি সাতের ঘরে পৌঁছেছে। কিন্তু রাজনীতি তথা গণতন্ত্রের সূচকগুলো অবিশ্বাস্যভাবে নিম্নগামী। ­­


সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]