শাবিপ্রবির এই আন্দোলনে কার বিজয় হলো?

সরকারের অনুরোধে শিক্ষাবিদ ও লেখক ড. জাফর ইকবাল শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙান
ছবি: প্রথম আলো

অবশেষে নানা জল্পনা-কল্পনা শেষে অনশন ভাঙলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা। সরকারের অনুরোধে শাবিপ্রবিরই সাবেক শিক্ষক ও লেখক ড. জাফর ইকবাল অনশনকারীদের কাছে ছুটে যান, সঙ্গে তাঁর স্ত্রী আরেক সাবেক শিক্ষক ইয়াসমিন হক। তখন কঠোর এই অনশন কর্মসূচির টানা দেড়শ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। তারও আগে অনশনকারীদের ২৮ জনের মধ্যে ২০ জনেরই ঠাঁই হয় হাসপাতালে, সেখানে থেকেও তাঁরা অনশন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এমনকি একজনের অস্ত্রোপচার ছিল, সেখানেও তিনি অনশনে অটল ছিলেন। একজনের পরিবারের সদস্য মারা যান, এরপরেও অনশনস্থল থেকে টলানো যায়নি তাঁকে। ফলে গোটা বাংলাদেশের মনোযোগ কেড়ে নেন শাবিপ্রবির তেজদীপ্ত এই শিক্ষার্থীরা। শরীর দুর্বল হয়ে গেলেও তাঁদের চোখগুলো যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠেছিল। তাদের শয্যার পাশে রাখা ফুলগুলো যেন আরও বেশি সৌরভ ছড়াচ্ছিল।

এমন অনড় অবস্থানের আর মাত্র একদিন পার হলেও তাদের শরীরের অঙ্গ নিশ্চল হয়ে যেত। সেই পরিস্থিতির কথা চিন্তা করেই হয়তো সম্মিলিত আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অনুরোধ করেন অনশন ভাঙতে। তবুও তারা অনড় থাকেন। শেষমেশ দৃশ্যপটে হাজির হওয়া অধ্যাপক জাফর ইকবালের আশ্বাসে অনশন ভাঙলেন শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জাফর ইকবালকে নিয়ে নানা সমালোচনাও আমরা দেখতে পাচ্ছি। সবার প্রত্যাশা ছিল, উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের পদত্যাগের মাধ্যমেই এই অনশন কর্মসূচির সমাপ্তি ঘটবে, সেটি যখন ঘটেনি তখন অনেকেই জাফর ইকবালের এই উদ্যোগে নাখোশ হয়েছেন।

এই অনশন অবশ্যই ভাঙার দরকার ছিল এবং সেটা উপাচার্য ফরিদের পদত্যাগের মধ্য দিয়েই। সরকারের এক ধরনের ‘গোঁয়ার্তুমির’ কারণেই সেটা হয়নি। কারণ, উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি থেকে এই ইস্যু সরকারের ইগো বা প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানা অমানবিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেও যখন অনশনকারীদের টলানো যাচ্ছে না, তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে জাফর ইকবালের সহায়তা নিল সরকার। বলতে গেলে, এক পশলা বৃষ্টির মতো সরকারকে আপাত স্বস্তি এনে দিলেন তিনি।

মরণাপন্ন অনশনকারীদের অনশন ভাঙাটা জরুরি ছিল এ জন্য, সরকারের ‘গোঁয়ার্তুমির’ কারণে কোনো অঘটন ঘটে গেলে সেটা হতো বিপর্যয়কর। কিন্তু শাবিপ্রবির এই আন্দোলন গড়ে ওঠে অহিংস চেতনা থেকেই। অনশন নিশ্চয়ই এই আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপ ছিল। উপাচার্য পদত্যাগ না করলেও জয় কিন্তু শিক্ষার্থীদেরই হয়েছে। তারা হার মানেনি। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকারি ক্ষমতা ঝাঁপিয়ে পড়েও তাদের পরাজিত করতে পারেনি। তবে অনশন শেষ মানে আন্দোলন শেষ নয়৷ সেই তেজ আমরা এখন পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি শাবিপ্রবিতে। উপাচার্যকে পদত্যাগ করানোর আরও আরও উপায় আছে। এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস তা-ই বলে। সেই সঙ্গে ড. জাফর ইকবালের আশ্বাসেও আমরা আশ্বস্ত হতে চাই। সরকারের প্রতিনিধি দল শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি তাঁকে দেওয়া হয়েছে, সেটির প্রতিফলন আমরা দেখার অপেক্ষায়।

২.
স্বীকার করতেই হবে, শাবিপ্রবি এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। এখনো উপাচার্য পদত্যাগ না করলেও শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন সফল। শুধু সফলই না বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনে নতুন একটা স্টান্ডার্ড তৈরি করে দিয়েছে তারা। সামনে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের জন্য শাবিপ্রবির এই আন্দোলনই অনুসরণীয় হয়ে উঠবে।

নিকট অতীতে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি শাবিপ্রবিতেও ছাত্র আন্দোলন দেখেছি। সেসময় আন্দোলনগুলাতে উপাচার্যের পদত্যাগের ঘটনাও ঘটেছে। সময়ের বিবেচনায় সেসব আন্দোলনের সাথে শাবিপ্রবির এই আন্দোলনের অবশ্যই পার্থক্য আছে। আগের আন্দোলনগুলো ছিল অনেকটা মারমুখী বা এগ্রেসিভ। সে তুলনায় শাবিপ্রবি আন্দোলন ছিল শুরু থেকেই অহিংস। তবে ধাপে ধাপে এই আন্দোলন এমন একপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেটার শক্তিমত্তা অন্য আন্দোলনগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে।

একইসঙ্গে বিরাজনীতি ও অসম ক্ষমতাচর্চার এই সময়ে যে অদম্যতা, তেজ, অনড় অবস্থান দেখিয়েছে শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা, তাতেই গোটা দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের তখত নড়ে ওঠেছে। একজন উপাচার্যকে হটানোর এ আন্দোলন ৩৪ জন উপাচার্যের স্বরূপ উন্মোচন করে দিয়েছে। এর আগে উপাচার্য হটাও আন্দোলনে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের এমন আওয়াজ কখনো দেখা যায়নি, এককাট্টা হওয়া তো দূরের কথা। শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের এই মরণকামড় আন্দোলন দেশের সব উপাচার্যকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। তাই উপাচার্য ফরিদকে পদত্যাগ করতে হলে বা সরকার তাকে সরিয়ে দিলে তাঁরাও একযোগে পদত্যাগের হুমকি দেন। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা নিজেদের হাস্যকর ও আরও মেরুদণ্ডহীনই প্রমাণ করেছে।

উপাচার্য গেলে উপাচার্য আসবে, নতুন করে দুর্নীতি-অনিয়মও হবে, এটি কারও অজানা নয়। কিন্তু উপাচার্য ফরিদ উদ্দীনকে বিদায় করার ব্যাপারে শিক্ষার্থীরা অনমনীয় ছিল কারণ তাঁদের ওপর বর্বর পুলিশি হামলা হয়েছে। এটা ছিল শিক্ষার্থীদের আত্মসম্মানবোধের ওপর বড় আঘাত। এখানে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু উপাচার্যকে বিদায় করতে শিক্ষার্থীরা যখন এককাট্টা তখন সরকার কোনো আলাপ-আলোচনার পথ না ধরে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনকে টিকিয়ে রাখার কৌশল নিল। শুধু তাই নয়, উল্টো শিক্ষার্থীদের ওপর মিথ্যা ও বেনামি মামলা দিল, অনশনকারীদের মেডিকেল সাপোর্ট বন্ধ করে দিল, অর্থসহায়তার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিল, গণচাঁদায় অংশ নেওয়ায় পাঁচ প্রাক্তন শিক্ষার্থীকে রাতের আঁধারে তুলে নিল, পরে তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হলো, ক্যাম্পাসে সব ধরনের খাবারের দোকান বন্ধ করে দিল। এর চেয়ে দানবীয় ও অমানবিক আচরণ আর কী হতে পারে। এত কিছু করেও শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের হটানো যায়নি, অনশন কর্মসূচি থেকে তাদের দমানো যায়নি। এতে করে বরং গোটা দেশের মানুষের কাছে তাঁদের সাহসিকতারই বিজয় হলো।

শাবিপ্রবির এই আন্দোলন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও উপাচার্যদের যত অনাচার, অমানবিকতা, নির্লজ্জতার মুখোশ নতুন করে উন্মোচিত করে দিয়েছে। যে শিক্ষকেরা এত বড় জুলুমের সময়ও শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াননি, সর্বমহল তাঁদের ধিক্কার জানাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের সামনে কোনো ধরনের নৈতিকতার ভীত আর রইল না তাঁদের। আগে এসব বিষয় শুধু শিক্ষাঙ্গনকে ঘিরে ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যেই ছিল, এখন একেবারে সাধারণ মানুষের কাছেও পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, যার কারণে আমরা খালিশপুর পাটকল শ্রমিকদেরও সংহতি জানাতে শিক্ষার্থীদের পক্ষে রাস্তায় দাঁড়াতে দেখি। এর চেয়ে বড় অর্জন হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো, শিক্ষক রাজনীতি, নানা অনিয়ম–অনাচার ও প্রশ্নবিদ্ধ উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে বড় ধরনের ঝাঁকুনিও দিল এ আন্দোলন। আগামীতে বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি ও ছাত্র–শিক্ষক–প্রশাসনের পারস্পরিক সম্পর্কেও এর প্রভাব পড়তে বাধ্য।

অনশন ভাঙার সময় হাউমাউ করে কাঁদছিলেন শিক্ষার্থীরা। সে দৃশ্য দেখে যে কারও চোখ ভিজে আসার কথা। এ কান্না কোনো পরাজয়ের না। এটি অবশ্যই বিজয়ের অশ্রু। তাঁদের মেরুদণ্ডকে তাঁরা অবনত হতে দেয়নি। তাঁরাই এই আন্দোলনের বীর। মানবিকতার কাছে দানবিকতাকে হার মানিয়েছেন তাঁরা। শাবিপ্রবির এই হার না মানা তরুণদের অভিবাদন জানাই।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক