শাবিপ্রবির সংকট: যে দূষিত চক্রে আটকে আছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো

শাবিপ্রবিতে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের অনশন
ছবি: প্রথম আলো

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) যা ঘটছে, তা না বিস্ময়কর, না অভূতপূর্ব। বাংলাদেশের একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গত এক দশকে এ রকম ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। শিক্ষার্থীরা দাবি তুললেই উপাচার্যের পক্ষে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীদের হামলা, পুলিশের আক্রমণ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা, ছাত্র–ছাত্রী নিবাস থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়া, তদন্ত কমিটি গঠন, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বেশুমার মামলা, উপাচার্যের পক্ষে ক্ষমতাসীনদের আস্থা ঘোষণা—এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থেকেছে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে জলকামান, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেডের ব্যবহার আগের চেয়ে আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার এবং আরও কঠোর ব্যবস্থার প্রমাণ। তদুপরি যেসব শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে থেকে গেছেন, তাঁদের নিবাসগুলোতে খাবার বন্ধ করে দেওয়ার ঘটেছে।

শিক্ষার্থীরা যে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি তুলছেন, সেটাও ব্যতিক্রম নয়। আগেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে উপাচার্যরা বহাল তবিয়তে টিকে যান। কারণটা আমরা জানি, তাঁরা উপাচার্য হন যে যোগ্যতায়, তাতে এসব ঘটনা তাঁদের সাফল্যের টুপিতে আরেকটি পালক যোগ করে। এগুলো প্রমাণ করে যে ক্ষমতাসীন দলের হয়ে কাজ করতে তাঁরা ন্যূনতম পিছিয়ে নেই। এই যোগ্যতায়ই তাঁরা পদে আসীন হয়েছেন। তাঁদের একাডেমিক ও প্রশাসনিক যোগ্যতা থাকুক অথবা না থাকুক। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা পদত্যাগ করতে চান না​। কেন চান না, সে বিষয়ে ২০১৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে যে প্রশ্নগুলো তুলেছিলাম, তা–ই আবার বলতে হচ্ছে, ‘কারণ কি এই যে তাঁদের যাঁরা নিয়োগ দেন, তাঁদের অনুমতি ছাড়া উপাচার্যরা পদত্যাগ করতে পারেন না? আর নিয়োগদাতারা উপাচার্যদের পদত্যাগকে রাজনৈতিক পরাজয় বিবেচনা করেন বলেই যেকোনো মূল্যে তাঁদের টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে তাঁদের কোনো দ্বিধা নেই’ (‘উপাচার্যরা পদত্যাগ করতে চান না কেন’, প্রথম আলো, ৭ নভেম্বর ২০১৯)।

উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়াটিই এ রকম জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য ছাড়া সেখানে কেউ আসীন হতে পারবেন না। ফলে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁদের রক্ষা করা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক লড়াই। এতে প্রতিষ্ঠানের কী ক্ষতি হলো, সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। এই উপাচার্যরা যখন দৃশ্যমান দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তা নিয়েও তাঁদের নিয়োগদাতারা বিব্রত বোধ করেন না।

গত বছরের মে মাসে গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানা গিয়েছিল যে দেশের ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২০১৯-২১ পর্যায়েই ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সেই সময়েই পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল, ইতিমধ্যে চলমান আরও পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে তদন্ত সম্ভবত শেষ হয়েছে। ২০১৯ সালের হিসাবে এ ধরনের যে তদন্ত হয়েছে, তার সংখ্যা আরও বেশি। কিন্তু এসব তদন্তে কোনো ফল হয় না। ইউজিসির সচিব ফেরদৌস জামান ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন, ‘আমরা তদন্ত করে সরকারের কাছে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করতে পারি। কিন্তু নিজেরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। আইনের সীমাবদ্ধতা আছে’ (ডয়েচে ভেলে, মে ১৪, ২০২১)। ইউজিসির আইনের সীমাবদ্ধতা আছে, সরকারের নেই। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যে এসব দুর্নীতির বিষয়েই একধরনের দায়মুক্তি ভোগ করেন, কেবল তা নয়, তাঁরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যেনতেন আচরণ করেও এর জন্য সামান্য তিরস্কৃতও হন না।

তাঁরা উপাচার্য হন যে যোগ্যতায়, তাতে এসব ঘটনা তাঁদের সাফল্যের টুপিতে আরেকটি পালক যোগ করে। এগুলো প্রমাণ করে যে ক্ষমতাসীন দলের হয়ে কাজ করতে তাঁরা ন্যূনতম পিছিয়ে নেই। এই যোগ্যতায়ই তাঁরা পদে আসীন হয়েছেন। তাঁদের একাডেমিক ও প্রশাসনিক যোগ্যতা থাকুক অথবা না থাকুক।

উপাচার্যরা শক্তি প্রয়োগের ওপরে ভরসা করেন, শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনা করতে উৎসাহী হন না। কেন এ পরিস্থিতির সূচনা হলো, তা খুঁজে বের করতে আগ্রহী হন না। এটা দেশে অন্যত্র যা ঘটছে, তা থেকে আলাদা বিষয় নয়। যখনই কোনো দাবি উঠেছে, সরকারের পক্ষ থেকে তা মোকাবিলা করা হয়েছে শক্তি দিয়ে। কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং সাম্প্রতিক কালে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা স্থায়ীভাবে বাড়ানোর বিষয়ে আন্দোলন এভাবেই মোকাবিলা করা হয়েছে। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে টিকে থাকার যে আদর্শ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বহাল, এগুলো তারই ধারাবাহিকতা। শাসনের ধরন যখন শক্তিপ্রয়োগনির্ভর, তখন সেটি সব ধরনের প্রতিষ্ঠানেই ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যরা তা তাঁদের সীমিত পরিসরে চর্চা করেন—ক্ষমতাসীন দলের ও সরকারের সাহায্য নিয়ে। জবাবদিহিহীন শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতার এভাবেই প্রয়োগ করবেন, এটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।

ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে উপাচার্যদের এই যে বন্ধন, তা উপাচার্যের নিয়োগ ও টিকে থাকার ক্ষেত্রেই সীমিত নয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের মধ্যে এই চর্চা দৃশ্যমান। সিলেটের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৫ সালের আগস্টে সংঘটিত ঘটনাবলির কথা স্মরণ করতে পারেন। উপাচার্যের পক্ষ হয়ে ছাত্রলীগ কর্মীরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে অন্য শিক্ষকদের ওপর চড়াও হয়েছিলেন। সেই সময়ে অনেকেই এ নিয়ে যখন ব্যথিত হয়েছিলেন, তখন স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে দলীয় আনুগত্যের বিবেচনায় প্রশাসন তৈরি হলে, এটাই স্বাভাবিক (আকাশ ভেঙে পড়েনি, প্রথম আলো, আগস্ট ৩১, ২০১৫)। এই দলীয় আনুগত্যের কারণেই সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাদের কাছে শিক্ষকেরা একধরনের ঋণে আবদ্ধ। এই ঋণ অপরিশোধ্য, কেননা এটি একবারের ঘটনা নয়; দলের অনুগত শিক্ষকেরা বারবার তাঁদের সাহায্য গ্রহণ করেন। কিন্তু যাঁরা সুবিধাভোগী, তাঁরাই কি কেবল দলের উঞ্ছবৃত্তি করেন? যাঁরা দলের প্রতি অনুগত হয়ে এ ধরনের শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্বে নির্বাচিত করে তাঁদের উপাচার্য হয়ে ওঠার পথ প্রশস্ত করেন, তাঁরাও আসলে এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এ দায় থেকে তাঁদের বাদ দেওয়া যাবে না। এক দূষিত বৃত্তচক্র গড়ে উঠেছে।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ঘটনাপ্রবাহ চলছে এক সপ্তাহ ধরে। কিন্তু দেশের প্রধান প্রধান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিগুলো নির্বিকার। শিক্ষক সমিতিগুলোর নির্বাচনে যাঁরা প্রার্থী হন, তাঁদের পরিচয় হচ্ছে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা। যে কারণে এসব শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর এবং তাঁদের দাবিগুলোকে বিবেচনা করার তাগিদ অনুভব করেন না। অন্ধ দলীয়করণের এ ধারা দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকিয়ে সে কারণেই প্রশ্ন জাগে, উপাচার্য এবং তাঁদের নিয়োগদাতাদের সেটাই উদ্দেশ্য কি না।

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট