শাহজালাল কিংবা নিরাপদ সড়ক, আন্দোলনে বল প্রয়োগই কেন শেষ কথা?

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সহজেই সামাল দেওয়া যেত।
ছবি: আনিস মাহমুদ

গত এক-দেড় সপ্তাহ যাবৎ দেশের গণমাধ্যমগুলোর শিরোনাম জুড়ে ছিল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) খবর। ছাত্রছাত্রীদের উত্তাল আন্দোলন, পুলিশ আর ছাত্রলীগের দুই দফা হামলা আর অনশন—পুরো পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তুলেছিল। অথচ বিষয়টি এত দূর গড়ানোর কথা নয়।

বহু আগেই এর সমাধান হতে পারত। আন্দোলনের একপর্যায়ে ছাত্রদের এক দফা দাবি ছিল উপাচার্যের পদত্যাগ। আর তাই প্রশ্ন উঠতেই পারে, উপাচার্য কি আগেই পদত্যাগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলা চরমতম অচলাবস্থার সমাধান করতে পারতেন না। দেশের সর্বস্তরের মানুষ দাঁড়িয়েছিল ছাত্রদের পক্ষে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা টের পাওয়া গেছে। সরকারি দলের একেবারে অন্ধ সমর্থক ছাড়া সবাই একমত ছিল উপাচার্যের সরে যাওয়ার বিষয়ে।

দেশে নির্বাচনব্যবস্থা থাকুক আর না-ই থাকুক, মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পাক কিংবা না-ই পাক, গণতন্ত্র মূল্যায়নকারী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মূল্যায়ন যা-ই হোক না কেন, সরকার নিজেকে জোর গলায় গণতান্ত্রিক দাবি করে। এই কয়েক দিন আগেই বর্তমান মেয়াদের তিন বছর পূর্তিতে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, অকল্পনীয় পরিমাণ ভোট দিয়ে জনগণ তাদের তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে। কী ভয়ংকর তামাশা জাতির সঙ্গে!

দেশের প্রায় সব মানুষ যখন শাবিপ্রবির উপাচার্যের পদত্যাগ চাইছে, ছাত্রছাত্রীরা অনশন করে অনেকেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে, তখনো বাংলাদেশের ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার এই ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং আন্দোলনকারী এবং আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়ানো অনেকের ওপর সরকারের নিপীড়ন নেমে এসেছে। বিষয়টি অনেককে অবাক করলেও বর্তমান বাংলাদেশে সরকার যেভাবে দেশ চালাচ্ছে তাতে এমনটিই হওয়ার কথা।

সম্প্রতি গণমাধ্যমে আমরা দেখতে পেলাম, গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের বাড়িতে গিয়ে তাঁদের স্বজনদের ভয়ভীতি দেখিয়ে, চাপ প্রয়োগ করে সাদা কাগজে সই দিতে বাধ্য করছে পুলিশ। স্বজনদের তরফে এমন অভিযোগ করা হয়েছে। পুলিশের বক্তব্য খুব পরিষ্কার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে, এমন সাক্ষী থাকা সত্ত্বেও তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা সম্পূর্ণ গোপন করে বলতে হবে নিজের ইচ্ছায় ঘর ছেড়েছেন তাঁরা বা হারিয়ে গেছেন। এমন লিখিত বক্তব্য সই করে দিতে হবে পুলিশকে।

২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে এসেছিল। স্বতঃস্ফূর্ত অরাজনৈতিক গণজাগরণের এক মাইলফলক হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে আন্দোলনটি লিখিত থাকবে। আন্দোলনটি একটা পর্যায়ে সরকারকে অনেকটা ভীতও করে দেয়। একটি জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে স্বাভাবিকভাবেই নানা রকম ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ ভেসে বেড়াচ্ছিল বাতাসে।

সম্প্রতি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর জাতিসংঘ গুম হওয়া কিছু মানুষের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য চাইবার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের এই তোড়জোড়। এর আগে ৮-১০ বছর যাবৎ নিখোঁজ থাকা মানুষগুলোর পরিবারের কোনো খোঁজ রাখেনি সরকার। একটি ন্যূনতম জবাবদিহি থাকা সরকারের কাজ হতো গুমের শিকার অসহায় পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো, মানুষগুলোকে খুঁজে বের করার উদ্যোগ নেওয়া। কিন্তু সরকার সে পথে না গিয়ে গেছে বল প্রয়োগের পথে।

একটু পেছন ফিরে তাকালেই সরকারের বল প্রয়োগের মানসিকতা আরও স্পষ্ট হবে। ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে এসেছিল। স্বতঃস্ফূর্ত অরাজনৈতিক গণজাগরণের এক মাইলফলক হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে আন্দোলনটি লিখিত থাকবে। আন্দোলনটি একটা পর্যায়ে সরকারকে অনেকটা ভীতও করে দেয়। একটি জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে স্বাভাবিকভাবেই নানা রকম ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ ভেসে বেড়াচ্ছিল বাতাসে।

সে সময়ের সরকারের নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ভীষণভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন। কারণ, বহুদিন থেকে তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার নানা পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছিলেন। চলচ্চিত্র অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনসহ আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে নানা আক্রমণাত্মক এবং তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথা বলেছিলেন তিনি। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরুর একেবারে প্রথম দিকেই মন্ত্রী দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনাকে লঘু করে তাচ্ছিল্যপূর্ণ বক্তব্য দেন। ফলে শিক্ষার্থীরা শাজাহান খানের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

সেই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধতা কমিয়ে আনার জন্য খুব দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারত তাদের দাবিমতো শাজাহান খানকে মন্ত্রিত্ব থেকে দ্রুত সরিয়ে দেওয়া। সঙ্গে তাঁকে পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার গণমুখী পদক্ষেপ নিতে পারত সরকার। এমন তো নয় যে তাঁর কোনো বিকল্প নেই। মন্ত্রী কিংবা শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা হিসেবে তাঁর কোনো অসাধারণ অবদানের কথা কারও জানা নেই। একই সঙ্গে সরকারের কর্তব্য হতো শাজাহান খান এবং পরিবহনমালিকদের সংগঠনের নেতাদের তীব্র বাধায় বছরের পর বছর আটকে থাকা নিরাপদ সড়ক আইনটি অতি দ্রুত পাস করার উদ্যোগ নেওয়া।

কিন্তু না, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ কমাতে গণমুখী কোনো পথে হাঁটেনি সরকার। দলীয় ক্যাডার বাহিনীকে হেলমেট পরিয়ে নামিয়েছিল পথে ছাত্রদের আন্দোলন দমনের জন্য। নির্মমভাবে পিটিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে তাদের ক্ষোভ প্রশমিত করতে পারত সরকার, কিন্তু তা না করে নিপীড়নের পথ ধরে সরকার।

যেহেতু সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী বর্তমান উপাচার্যের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন, সারা দেশের অসংখ্য মানুষ যেহেতু চাইছিল না এই উপাচার্য আর থাকুক, তাই তাঁর চলে যাওয়াটাই হতে পারত এই পরিস্থিতিকে শান্ত করার একমাত্র কার্যকর পথ। সেই পথে সরকার তো যায়ইনি, বরং হাঁটল একেবারে উল্টো পথে।

ঠিক একই ধরনের পরিস্থিতি হয়েছে শাবিপ্রবিতে। বিশ্ববিদ্যালয়টির সমস্যার শুরু ছাত্রী হলে ছাত্রীদের সঙ্গে প্রভোস্টের কিছু আচরণগত সমস্যার অভিযোগ থেকে। এরপর আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করতে ‘প্রথা মেনে’ ছাত্রলীগ হামলা করে প্রতিবাদমুখর শিক্ষার্থীদের ওপর। এই হামলা শিক্ষার্থীদের না দমিয়ে উল্টো আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে, যার মাশুল দিতে হয় লাঠিপেটা, সাউন্ড গ্রেনেড, শটগানের গুলি নিয়ে পুলিশের বর্বর হামলার শিকার হয়ে। এরপর আবারও ‘প্রথা মেনে’ নিপীড়িত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দেওয়া হয় হয়রানিমূলক মামলা। সার্বিক পরিস্থিতি ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের উপাচার্যের পদত্যাগের ‘এক দফা এক দাবি’তে চলে যেতে বাধ্য করে।

শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে ঘেরাও করেন, মশাল মিছিল করেন এবং বেশ কিছু শিক্ষার্থী আমরণ অনশনে বসেন। প্রচণ্ড শীতের রাতে ক্যাম্পাসে দিনের পর দিন শিক্ষার্থীরা অনশন করেছেন। অনেকেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেলেও তাঁরা অনশন চালিয়ে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক জাফর ইকবাল সরকারের অনুরোধে সেখানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙান।

যে কারণেই এই পরিস্থিতি তৈরি হোক না কেন, যেহেতু সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী বর্তমান উপাচার্যের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন, সারা দেশের অসংখ্য মানুষ যেহেতু চাইছিল না এই উপাচার্য আর থাকুক, তাই তাঁর চলে যাওয়াটাই হতে পারত এই পরিস্থিতিকে শান্ত করার একমাত্র কার্যকর পথ। সেই পথে সরকার তো যায়ইনি, বরং হাঁটল একেবারে উল্টো পথে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের শুরুর দিকেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে ছাত্রছাত্রীরা ক্যাম্পাসে থেকে সরেননি। হলে খাবার না পাওয়া যাওয়ার কারণে তাঁরা ক্যাম্পাসের মাঠে খিচুড়ি রান্না করে খাচ্ছিলেন। এ জন্য তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়েরই কিছু সাবেক শিক্ষার্থী (বর্তমানে কর্মজীবী) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আর্থিক সাহায্য করেছিলেন, যা যেকোনো বিচারেই অনৈতিক কিংবা বেআইনি নয়। কিন্তু এই অভিযোগেই ঢাকা থেকে পাঁচজন মানুষকে আটক করা হলো। শুধু সেটাই নয়, যেসব শিক্ষার্থীর নম্বরে টাকা পাঠানো হতো, অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ আবারও সরকার বল প্রয়োগের পথেই হেঁটেছে।

বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার তার টানা ক্ষমতায় থাকার ১৩ বছরের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে সংকটময় সময় পার করছে। র‍্যাব এবং এর কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে সরকার দৃশ্যত যত হালকাভাবে নেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন এটা সরকারকে নিশ্চিতভাবেই চিন্তায় ফেলেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, আপাতদৃষ্টে সহজ পদ্ধতিতে না গিয়ে সরকার কেন গেছে তুলনামূলকভাবে কঠিন এবং প্রচুর সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে, এমন পদক্ষেপে? এর জবাব আছে সরকারের ধরনের মধ্যে। একটি কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার টিকে থাকে বল প্রয়োগ করার মাধ্যমে। সরকারটি যেকোনো জায়গায় তার বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন করা, এমনকি কথা বলাকেও দমন করে বল প্রয়োগের মাধ্যমে।

অন্যায় ও অন্যায্য বল প্রয়োগের ক্ষমতা এবং জনগণের মধ্যে এ-সংক্রান্ত ভীতিই বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রধান ভিত্তি। এমন বাস্তবতায় কোনো একটা ক্ষেত্রে যদি আন্দোলনকারীরা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাঁদের দাবি করতে পারেন তবে তা হবে সরকারের একচ্ছত্র ক্ষমতার ভিত্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলা। এমন একটা উদাহরণই তখন অন্যদের উৎসাহিত করতে পারে। সে কারণেই সরকার কারও কোনো দাবি মানতে রাজি নয়, তা যতই ন্যায্য হোক।

বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার তার টানা ক্ষমতায় থাকার ১৩ বছরের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে সংকটময় সময় পার করছে। র‍্যাব এবং এর কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে সরকার দৃশ্যত যত হালকাভাবে নেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন এটা সরকারকে নিশ্চিতভাবেই চিন্তায় ফেলেছে।ওদিকে ১২টি মানবাধিকার সংস্থা কর্তৃক র‍্যাবকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী থেকে বাদ দেওয়ার আহ্বান এবং র‍্যাবকে ইউরোপীয় ইউনিয়নেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার জন্য স্লোভাকিয়ার প্রতিনিধির লেখা চিঠি সরকারের কপালের ভাঁজ আরও বাড়াচ্ছে নিশ্চয়ই।

সরকারে বিরুদ্ধে বিরক্ত মানুষ সামনে যে কোনো ইস্যুতে আন্দোলনে নামলেও বল প্রয়োগ ছাড়া সরকারের সামনে কোনো পথ থাকবে না। সরকার এত দিন এই নীতিতেই চলেছে। কিন্তু বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের অনেক বেশি নজরদারিতে থাকা সরকার কোন মাত্রায় বল প্রয়োগ করতে পারবে সেটাও একটা প্রশ্ন। এই পরিস্থিতিতে সামনে সরকারের কৌশল কী হবে সেটাই দেখার বিষয়।

রুমিন ফারহানা বিএনপিদলীয় সাংসদ ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী