ধরুন, আপনি বিসিএস পরীক্ষা দেবেন। আপনি যদি সাধারণ চাকরিপ্রার্থী হন, পেশা বাছাইয়ের সময় আপনি আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, বা ভালো লাগা-মন্দ লাগা তেমন দেখবেন না, অথবা কোন কোন পেশায় গেলে আপনি সবচেয়ে ভালো করতে পারবেন, সেটাও খুব একটা আন্দাজ করার চেষ্টা করবেন না। খোঁজখবর নেবেন কোন কোন পেশায় সুযোগ-সুবিধা বা ক্ষমতা-প্রতিপত্তি বেশি, তারপর সে অনুযায়ী আপনি টিক চিহ্ন দেবেন। কারণ, সেখান থেকে যেটা পান, সেটা্তেই চোখ বন্ধ করে ঝুলে পড়লে আপনার তেমন কোনো অসুবিধা হবে না। আপনি চেষ্টা করলেই একজন ভালো প্রশাসক, একজন ভালো পুলিশ বা একজন ভালো কর কর্মকর্তা হয়ে উঠতে পারবেন। অথবা ধরুন, আপনি বিসিএসে টিকতে না পেরে একটা ব্যাংকে চাকরি নিলেন। তাতেও অসুবিধা হবে না। চেষ্টা করলে আপনার পক্ষে একজন ভালো ব্যাংকারও হওয়া সম্ভব। কিন্তু ব্যাংকে বা অন্য কোথাও চাকরি না পেয়ে আপনি যদি শিক্ষক হতে বাধ্য হন, সে ক্ষেত্রে আপনার পক্ষে একজন ভালো শিক্ষক হওয়া খুব কঠিন হবে।
শিক্ষকতা একটি সৃষ্টিশীল পেশা এবং যেকোনো মানুষ চাইলেই যেহেতু হঠাৎ করে যেকোনো ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল হয়ে উঠতে পারেন না, সে কারণে আপনার পক্ষে ভালো শিক্ষক হওয়া সম্ভব নয়। সৃষ্টিশীলতা বিষয়টা এমন নয় যে আপনার মাথায় টুপ করে একটা আপেল পড়ল আর আপনি নিউটন হয়ে গেলেন বা আপনার বাথটাবের পানি উপচে পড়ে মেঝে ভিজে গেল, আপনি ‘ইউরেকা’ বলে আর্কিমিডিস হয়ে গেলেন অথবা ক্রৌঞ্চযুগলের পুরুষ ক্রৌঞ্চ নিহত হওয়ায় স্ত্রী ক্রৌঞ্চের কান্না শুনে আপনি ‘রামায়ণ’ লিখে বাল্মীকি হয়ে গেলেন। যেকোনো ধরনের সৃষ্টিশীলতার জন্য দীর্ঘ সাধনা করতে হয়। শিক্ষকদের এই সাধনা অন্য যেকোনো শিল্পীর সাধনার চেয়ে কঠিন হওয়ার কথা। কারণ, শিক্ষকের কাজ হচ্ছে মানুষ নামের একটি প্রাণীকে গড়ে-পিটে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে তৈরি করা।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে হলে কমপক্ষে তিনটি কাজ করতে হবে। এখন যেভাবে শিক্ষকদের হেনস্তা করা হচ্ছে, প্রথমত সবাই মিলে সেটা বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যেমন হাসপাতালে বা যানবাহনে শিক্ষকদের অগ্রাধিকার দিয়ে তাঁদের হেঁট হয়ে যাওয়া মাথাকে কিছুটা হলেও উঁচু করে দিতে হবে। তৃতীয়ত, শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার দিকে নজর দিতে হবে। শেষোক্ত বিষয়টিতে আর্থিক সংশ্লেষ আছে, কিন্তু প্রথম দুটো প্রায় নিখরচায় এখনই করা যায়।
অন্যান্য সৃষ্টিশীল বিষয় যেমন গান, নাচ, অভিনয় বা খেলার ক্ষেত্রে দেখুন, এমন কিন্তু খুব কমই হয় যে একজন গায়ক বা একজন নৃত্যকলাকার বা একজন খেলোয়াড় পেশায় ঢোকার পর তাঁর সাধনা শুরু করেন। সাধারণত সাধনা করতে করতে যখন একজন খেলোয়াড়ের নাম–ডাক বা একজন গায়কের যশ-খ্যাতি হয়, তখন তিনি খেলা বা গানকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই সাধনা শুরু হয় জীবনের প্রথম ভাগে, যখন থেকে কেউ কিছু একটা হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। এই স্বপ্ন ও সাধনা কার্যকারণ সূত্রে আবদ্ধ। স্বপ্ন না দেখলে কেউ সাধনায় ব্রতী হন না।
বাংলাদেশের শিক্ষকতা পেশায় এখন সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে, অঙ্গুলিমেয় কিছু মানুষ ছাড়া এখন আর ভুল করেও কেউ শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখে না। এই স্বপ্নহীনতা শুধু যে শিক্ষকদের নির্জীব করে রাখছে, তা নয়, এতে সরকার, বিদ্যালয় এবং শিক্ষার্থীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সময়ের অপচয় হচ্ছে। কীভাবে? সেটা আমরা দেখব, কিন্তু তার আগে দেখে নিই, আপনি যদি হঠাৎ করে শিক্ষক না হয়ে ছোটবেলা থেকেই শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে বড় হতেন, তাহলে কী হতো?
আপনি খেয়াল করতেন একজন ভালো শিক্ষক কীভাবে কথা বলেন, কীভাবে হাঁটেন, কীভাবে জীবন যাপন করেন ইত্যাদি; আপনি লক্ষ করতেন, একজন ভালো শিক্ষক হওয়ার জন্য কী কী যোগ্যতা লাগে এবং আপনি যত দ্রুত ও যত ভালোভাবে সম্ভব, সেগুলো অর্জন করার চেষ্টা করতেন। তার অর্থ, আপনি এখন চাকরিতে ঢোকার পর সরকারি খরচে শিক্ষক হওয়ার জন্য যেভাবে তৈরি হন, আপনি তখন নিজ চেষ্টায় তার চেয়ে অনেক ভালোভাবে তৈরি হয়ে শিক্ষকতা শুরু করতে পারতেন।
এ জন্যই বলছিলাম, আপনি যদি শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন, তাহলে আপনাকে তৈরি করার জন্য আপনাকে ছুটি দিয়ে, বেতন দিয়ে, আপনার জন্য শিক্ষক-শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে সরকারকে আর এত দায় বা ব্যয়ভার বহন করতে হতো না। এখন কথা হচ্ছে, আপনি স্বপ্ন দেখেননি কেন? দেখেননি কারণ, এই পেশায় অর্থ-কড়ি, সুযোগ-সুবিধা, মান-মর্যাদা, ক্ষমতা-প্রতিপত্তি প্রায় নেই বললেই চলে। দেখেননি কারণ, আপনি জানেন এই পেশায় ঢুকলে আপনাকে কান ধরে উঠ-বস করতে হতে পারে, কারও পা ধরে মাফ চাইতে হতে পারে, জেল খাটতে হতে পারে, জুতার মালা গলায় দিয়ে সেটা সার্কাসের পশুর মত হেঁটে হেঁটে সবাইকে দেখাতে হতে পারে, এমনকি শিক্ষার্থীর প্রহারে আপনার মৃত্যুও হতে পারে। এ ছাড়া নিত্যনৈমিত্তিক অপমান, বঞ্চনা, গঞ্জনা তো আছেই। তার মানে আপনি যদি কোনো অজানা কারণে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেও ফেলতেন, সেটা স্বপ্ন না হয়ে হয়তো দুঃস্বপ্নই হতো।
এই দুঃস্বপ্নকে সুখস্বপ্নে পরিণত করতে চাইলে শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় না করে উপায় নেই। তা করার জন্য অবশ্যই কিছু অর্থ চাই। তবে এই অর্থ ব্যয় যে অন্যদিকে সাশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারে, সেটা তো আমরা মাত্র দেখলাম। অঙ্কের হিসাবে এই বিনিয়োগ কতটুকু লাভজনক, হিসাব–নিকাশ না করে তা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু গুণগত শিক্ষাকে আমরা যদি লাভ হিসেবে বিবেচনা করি, এই লাভের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে হলে কমপক্ষে তিনটি কাজ করতে হবে। এখন যেভাবে শিক্ষকদের হেনস্তা করা হচ্ছে, প্রথমত সবাই মিলে সেটা বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যেমন হাসপাতালে বা যানবাহনে শিক্ষকদের অগ্রাধিকার দিয়ে তাঁদের হেঁট হয়ে যাওয়া মাথাকে কিছুটা হলেও উঁচু করে দিতে হবে। তৃতীয়ত, শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার দিকে নজর দিতে হবে। শেষোক্ত বিষয়টিতে আর্থিক সংশ্লেষ আছে, কিন্তু প্রথম দুটো প্রায় নিখরচায় এখনই করা যায়।
এ ছাড়া হয়তো আরও অনেকভাবে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখানোর কাজটি শুরু করা যায়। যেভাবেই হোক, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমাদের এই স্বপ্ন দেখাতেই হবে; নাহলে দেশকে নিয়ে আমাদের জাতির জনকের যে স্বপ্ন, তা বাস্তবায়ন করা যাবে না।
সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক