শিক্ষা নিতে হবে ইতিহাস ও বাস্তবতা থেকে

দেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন ২০২৩ সালে। স্বভাবতই প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এতে সাফল্যের কৌশল নির্ধারণকেই এখন প্রাধান্য দেবে। বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক প্রতিনিধিরাও ২০১৮ সালের নির্বাচনের সূত্র টেনে সবার জন্য সমান সুযোগের নিশ্চয়তা বজায় রেখেই ২০২৩ সালের নির্বাচন চাইছেন। পাশাপাশি অরাজনৈতিক পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও সুষ্ঠু-অবাধ নির্বাচনের পক্ষে জোরালো মতামত রয়েছে। সম্ভবত ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রশাসনের একশ্রেণির কর্মকর্তার ভূমিকা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি বিশ্বস্ত বিশিষ্টজনেরাও বিব্রত বোধ করেন এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথাই ভাবেন। এসবই সংগত ভাবনা।

নির্বাচনী ব্যবস্থা যে ভোটারদের আস্থা প্রায় হারিয়েছে, তার লজ্জাজনক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সদ্য সমাপ্ত ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ডের উপনির্বাচন। এতে ৩৬ হাজার ভোটারের মধ্যে মাত্র ২৩ শতাংশ ভোট দিয়েছেন; প্রার্থী ছিলেন ২১ জন। ফলাফলে দেখা গেল ভোট এমনভাবে বিভক্ত হয়েছে যে জয়ী প্রার্থীও জামানত রক্ষা করতে পারেননি। ভোটারদের অংশগ্রহণে অনীহা এবং মাত্র ৭৬৯ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়ে বিজয়ী হওয়া গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটা হাস্যকর লজ্জাজনক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

অতএব আসন্ন সাধারণ নির্বাচন নিয়ে ভাবা সংগত এবং জরুরি। প্রায় ভোটারবিহীন নির্বাচন, জামানত খুইয়ে বিজয় বা অদৃশ্য কারসাজিতে ভোট বাক্স পূরণ হওয়ার মতো ঘটনা কেবল নির্বাচন কমিশনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে না, যেহেতু এর গঠন থেকে কার্যক্রম পরিচালনায় সরকারেরই একক দায়িত্ব থাকছে, তাই তারাও দায় এড়াতে পারে না। সবটা মিলিয়ে পরিস্থিতি গণতন্ত্রের অনুকূল নয়, এটা সত্য।

অনেকেই গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে পারস্পরিক বিয়োগযোগ্য মনে করছেন। অর্থাৎ উন্নয়ন চাইলে গণতন্ত্রকে বাদ না দিলেও নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। কেননা, তাঁদের আশঙ্কা, অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনে বর্তমান সরকার ক্ষমতা হারালে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হবে। বিএনপির পূর্ববর্তী শাসনামলের অব্যবস্থা ও দুর্নীতির কথা এ প্রসঙ্গে ওঠাই স্বাভাবিক। তবে আদতে ব্যাপক দুর্নীতি ও কিছু অব্যবস্থার মধ্যেও বর্তমান আমলে উন্নয়ন বেগবান রয়েছে, সামাজিক সূচকগুলোয় উন্নতি ঘটেছে, বড় বড় প্রকল্প দৃশ্যমান হচ্ছে, সমাজের দরিদ্র মানুষের অনুকূলে অনেক কার্যক্রমও সফল হচ্ছে। এ–ও সত্য, করোনা অতিমারিতে যখন বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতি পিছিয়ে পড়ে হিমশিম খাচ্ছিল, তখনো বাংলাদেশ দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। টিকা ব্যবস্থাপনা ও করোনা চিকিৎসার প্রাথমিক দুর্বলতা বর্তমান সরকার কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।

রাষ্ট্রব্যবস্থা বা শাসকের পরিবর্তন সহজ। স্বাধীনতার জাদুকরি মন্ত্রে জনপ্রিয় গণজোয়ার ঘটিয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে বহু প্রাণ বলি দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনও সম্ভব। কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এর চেয়ে ঢের কঠিন। কারণ, এর জন্য সমাজকে পরিবর্তন ও উন্নয়ন করতে হয়। এটা একটি ধারাবাহিক ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া।

মানুষের সাধারণ সরল ভাষ্যটি বস্তুত অপরীক্ষিত ধারণানির্ভর, তারপরও এটি সত্য হলেও আদর্শ বাস্তবতা নয়। আমাদের সেই বাস্তবতাতেই পৌঁছাতে হবে, যা যুগপৎ উন্নয়ন ও গণতন্ত্রকে ধারণ করতে সক্ষম।

গণতন্ত্রের মডেল আমরা পেয়েছি এককালের শাসক ব্রিটেনের কাছ থেকে। পশ্চিম ইউরোপের যেসব দেশে গণতন্ত্র দীর্ঘকাল ধরে চলমান এবং ধীরে ধীরে আইনের শাসন, মানবাধিকারের প্রতিষ্ঠাসহ কাঠামোগত ভিত্তি পেয়েছে, তাদের রাজনৈতিক উত্তরণের ইতিহাস একটা ধারণা স্পষ্ট করে। এই রাষ্ট্রীয় রূপান্তরের কাজ কোনো হুকুম বা সরাসরি আইনে হয়নি, সামাজিক অঙ্গনে এর ধারাবাহিক পূর্বপ্রস্তুতি অনেক দীর্ঘ।

১২১৫ সালে ইংল্যান্ডের ম্যাগনাকার্টার কথা একবার ভাবুন। তখনই রাষ্ট্র ও চার্চের বিভাজন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথাও উল্লেখিত হয়েছে। অবশ্য তখনো এসব ছিল অভিজাত শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর পরবর্তী দু-তিন শতকে পশ্চিম ইউরোপের কোনো কোনো দেশে খনিজ সম্পদ আবিষ্কার ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের বিস্তার ঘটলে তারা সম্পদ-শক্তিতে সমৃদ্ধ হতে থাকে। তখন সম্পদ ও জ্ঞানে শক্তিশালী মানুষের আবির্ভাবও ঘটেছে স্বাভাবিকভাবে।

আমরা ধর্মসংস্কারক, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের দেখা পেতে শুরু করি। এভাবে রেনেসাঁস, এনলাইটেনমেন্ট ও রিফরমেশনের ভেতর দিয়ে তাঁদের সমাজে ইহজাগতিক জীবনচেতনা ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার-কুসংস্কার থেকে অনেকাংশে মুক্তি লাভ করে। অবশ্যই এসবও প্রথমে ঘটেছে অভিজাত শ্রেণির মধ্যে, তবে যুক্ত হয়েছে নব্য সম্পদশালী গোষ্ঠী, আগ্রহী হয়ে উঠেছিল নতুন সৃষ্ট কারিগর ও কর্মিশ্রেণি। ভূমিদাসেরাও মুক্তিপ্রত্যাশী হয়ে উঠেছিল স্বভাবতই। এ কারণে দীর্ঘ সময় এ অঞ্চলে নানামুখী দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়েছে, আবার কখনো আপসহীন অবস্থান রক্তক্ষয়ী পরিণতি পেয়েছে, ক্ষমতার বা আধিপত্য বিস্তারের লড়াই অনেক সময় রণাঙ্গনেই নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে এসবের সামষ্টিক ফল হলো সমাজের নবায়ন, রূপান্তর।

ব্রিটেনের অলিভার ক্রমওয়েলের ভূমিকা এবং ১৬৮৮ সাল নাগাদ পার্লামেন্টের সঙ্গে রাজার ক্ষমতা বণ্টনের আপস গণতন্ত্রের অগ্রগতি নিশ্চিত করেছিল। এর পরের বড় দুটি ঘটনা ঘটল অষ্টাদশ শতাব্দীতে—শিল্পবিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লব। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের বোধ আধুনিক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে বড় পদক্ষেপ। ফরাসি বিপ্লব ব্যর্থ হলেও তার চেতনার স্ফুলিঙ্গ দিন দিন তেজি হয়েছে। কারণ, পশ্চিম ইউরোপের মানুষ ক্রমে স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক চেতনায় সমৃদ্ধ হয়েছে। ইউরোপের বাইরে উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি ইউরোপীয় অভিবাসীরাই—অবশ্যই নির্মমভাবে স্থানীয় আদিবাসীদের উৎখাত করেই—ঘটিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসও একই।

নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটারের পক্ষে সরকার পরিবর্তন করা সম্ভব, কিন্তু সমাজবাস্তবতার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়; বরং আশঙ্কা আছে নতুন প্রবণতার অন্ধ জোয়ারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হারানো সমাজ কোন দিকে ঝোঁকে, তা নিয়ে।

আর বাকি তিন মহাদেশ—দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকা ওদের ঔপনিবেশিক অধিকারে গেছে, দাসত্বের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছে আর নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদ, সংস্কৃতি, জীবনবিকাশ—সবই লুণ্ঠিত, ক্ষয়িত হয়েছে। পাশ্চাত্যে ও অস্ট্রেলিয়ার বাইরে বাকি বিশ্বে গণতন্ত্র এখনো শক্তিশালী নয়। স্বাধীন ভারতে গণতন্ত্রচর্চার ৭৫ বছর পরও এর দুঃখজনক পরিণতি ঘটেছে অগণতান্ত্রিক ধর্মান্ধ (হিন্দুত্ববাদী) শক্তির উত্থান ও ক্রমবর্ধমান শক্তি সঞ্চয়ে। কামাল পাশার আধুনিক তুরস্কও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গোঁড়াপন্থীদের হাতেই গেছে। মিসর বা আলজেরিয়ায় মুক্ত নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডই বিজয়ী হয়। আফগানিস্তানে দুই দশকের আধুনিকায়নের যে চেষ্টা, তা বাইরের খোলসটুকু ছিল। মজ্জায় তালেবানি মানস অটুট থেকেছে। ইন্দোনেশিয়াও তার ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও বহুত্ববাদী সংস্কৃতিচর্চার ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারছে বলে মনে হয় না।

দেখা গেছে, রাষ্ট্রব্যবস্থা বা শাসকের পরিবর্তন সহজ। স্বাধীনতার জাদুকরি মন্ত্রে জনপ্রিয় গণজোয়ার ঘটিয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে বহু প্রাণ বলি দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনও সম্ভব। কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এর চেয়ে ঢের কঠিন। কারণ, এর জন্য সমাজকে পরিবর্তন ও উন্নয়ন করতে হয়। এটা একটি ধারাবাহিক ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আরও অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও সে কাজ হয়নি; বরং আমাদের সমাজে ইদানীং যেটুকু রূপান্তর ঘটেছে বা নবতর ভাবধারা ও চিন্তার ঢেউ দেখা যাচ্ছে, তাতে কট্টর ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ও ভোগবাদিতার এক মিশ্রণ তৈরি হয়েছে।

নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটারের পক্ষে সরকার পরিবর্তন করা সম্ভব, কিন্তু সমাজবাস্তবতার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়; বরং আশঙ্কা আছে নতুন প্রবণতার অন্ধ জোয়ারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হারানো সমাজ কোন দিকে ঝোঁকে, তা নিয়ে। বায়ান্ন থেকে একাত্তরে অর্জিত চেতনা এবং ২০০৭ সাল থেকে আংশিকভাবে পুনরুজ্জীবিত সেই চেতনাকে নির্বাচন ঝুঁকিতে ফেলবে কি না, তা স্পষ্ট করার দায় বিএনপির। সে কাজ কিন্তু আরব্ধ রয়ে গেছে। তাহলে কি ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন ও রকিবউদ্দীন-নূরুল হুদার মতো কমিশন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে? না, সেটাও কাজের কথা নয়।

কিন্তু ক্ষমতা নিয়ে যুযুধান দুটি রাজনৈতিক দল তো ক্ষমতা ধরে রাখার ও ফিরে পাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টার মধ্যে এ বিষয়ে সমাধান দিতে পারবে না। বিশিষ্টজন বা নাগরিক সমাজকেও বুঝতে হবে গণতন্ত্র বা আইনের শাসন এবং নাগরিক হিসেবে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা কেবল কিছু সুষ্ঠু নির্বাচনে সীমাবদ্ধ নয়, জ্ঞানচর্চার মুক্ত বাতাবরণ তৈরি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিবৃতি বা টক শো দিয়েও অর্জিত হওয়ার বিষয় নয়। ভাবনার চর্চা ও চেতনার প্রবাহ রুদ্ধ হওয়ায় সামগ্রিকভাবে সমাজে চিন্তা, রুচি ও নৈতিকতার অবক্ষয় প্রকট। ফলে বিত্তশালীদের ভিড় বাড়লেও রাজনৈতিক দলও আদতে দেউলিয়া। এ অবস্থায় কেবল সুষ্ঠু নির্বাচনে সমাধান খোঁজা বাতুলতা।

যথার্থ নির্বাচন কমিশন গঠনের বা সুষ্ঠু নির্বাচনের গুরুত্ব মেনেও বলব, তারও চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষাঙ্গনসহ সমাজে বুদ্ধি বা চিন্তার মুক্তির কাজ করা, সমাজমানসের রূপান্তরের লক্ষ্যে সংস্কার ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং নতুন চিন্তার পক্ষে কাজ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এসব কাজ আরব্ধ থাকলে সুষ্ঠু গণতন্ত্রেও ক্ষমতা অগণতান্ত্রিক শক্তির হাতেই জমা হয়, তা শোধরানো আরও কঠিন। পূর্ব ইউরোপে এই পরিণতি আমরা দেখছি। ভারত, পাকিস্তান, তুরস্কে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। শিক্ষা নিতে হবে ইতিহাস ও বাস্তবতা থেকে।

আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক