শিক্ষাদারিদ্র্য উত্তরণের সূচনা হোক

করোনা অতিমারির দাপটে বিশ্বব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থা বিপন্ন।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০১৮ সালে শান্তি ও উন্নয়নে শিক্ষার অবদান তুলে ধরার লক্ষ্যে প্রতিবছর ২৪ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। করোনা অতিমারির দাপটে বিশ্বব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থা বিপন্ন। এ বছরের আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবসকে তাই নতুন আলোকে দেখতে হবে। বাংলাদেশসহ নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকা, অর্জিত দক্ষতার মান ও বৈষম্য নিয়ে বড় সমস্যা আগে থেকেই ছিল। বর্ষব্যাপী শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকার ফলে এসব সমস্যা আরও প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। এগুলো থেকে উত্তরণের উপায় কী হতে পারে, তাই এখন সবার জন্য উদ্বেগের বিষয়।

শিক্ষাবিদেরা একমত যে প্রতিটি শিশুর ১০ বছর বয়স পেরোনোর আগে পড়তে ও লিখতে পারতে হবে। এই বয়সে বা অন্তত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সীমার মধ্যে পড়া ও লেখার দক্ষতা অর্জন করতে না পারলে এই পিছিয়ে পড়া তাদের জন্য অনতিক্রম্য বাধায় পরিণত হয়। পরবর্তী শিক্ষাজীবনে তারা পিছিয়েই থাকে। শিক্ষায় এবং জীবনে সাফল্য তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ২০২১-এ মহামারির অভিঘাত জয় করে সামনের দিকে এগোতে হবে। ভাবতে হবে ১০ বছর পর শিক্ষাব্যবস্থা কোথায় দাঁড়াবে। টেকসই উন্নয়ন ২০৩০-এর শিক্ষার সাতটি লক্ষ্য এই নিরিখের যথার্থ মাপকাঠি হতে পারে। বাংলাদেশ সরকার ২০৩০-এর লক্ষ্য অর্জনে অঙ্গীকারবদ্ধ।

১০ বছর বয়সে একটি সাধারণ লিখিত ভাষ্য (যেমন দৈনিক পত্রিকায় একটি খবরের বিবরণ) পড়তে ও বুঝতে না পারাকে বিশ্বব্যাংক শিক্ষাদারিদ্র্য বলে সংজ্ঞায়িত করেছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে ৫৩ শতাংশ শিশু শিক্ষাদারিদ্র্যের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশও শিক্ষাদারিদ্র্যে আক্রান্ত।

সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে বিশ্বব্যাংক জানাচ্ছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উচ্চতর শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ৫৬ শতাংশ পড়া ও লেখার নিম্নতম প্রত্যাশিত দক্ষতা অর্জন করে না। করোনা মহামারির প্রভাবে সমস্যা আরও জটিল হয়েছে। (বিশ্বব্যাংক LEARNING POVERTY BRIEF, 2019) গণসাক্ষরতা অভিযানের এডুকেশন ওয়াচ সমীক্ষা করোনাকালে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের পরিস্থিতি জরিপ করে শিক্ষাকার্যক্রম আবার শুরু করার ব্যাপারে ছয় দফা সুপারিশ করেছে। উপযুক্ত সাবধানতা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে ধাপে ধাপে বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা পুনরুদ্ধারের দুই সালা পরিকল্পনা তৈরি করতে বলা হয়েছে। এই স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা পাঁচসালা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। (প্রথম আলো, ২০ জানুয়ারি) স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ২০২১-এ মহামারির অভিঘাত জয় করে সামনের দিকে এগোতে হবে। ভাবতে হবে ১০ বছর পর শিক্ষাব্যবস্থা কোথায় দাঁড়াবে। টেকসই উন্নয়ন ২০৩০-এর শিক্ষার সাতটি লক্ষ্য এই নিরিখের যথার্থ মাপকাঠি হতে পারে। বাংলাদেশ সরকার ২০৩০-এর লক্ষ্য অর্জনে অঙ্গীকারবদ্ধ।

১. ২০৩০-এর মধ্যে ১২ বছর পর্যন্ত মানসম্মত প্রাথমিক–মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষা সমতার ভিত্তিতে সর্বজনীন হবে। বর্তমানে নির্দিষ্ট বয়সের মাত্র অর্ধেক মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে, উচ্চমাধ্যমিক সমাপ্ত করে এক-চতুর্থাংশ। সর্বজনীন মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জনের কোনো কার্যক্রম এখনো গৃহীত হয়নি।

২. প্রাক্‌-প্রাথমিক শিক্ষায় সব শিশু অন্তর্ভুক্ত হবে এবং আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য তাদের প্রস্তুতি নিশ্চিত হবে। এখন প্রায় সব প্রাথমিকের শিক্ষার্থী এক বছরের প্রাক্-প্রাথমিকে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু এটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য মানসম্মত নয়।

৩. যথার্থ মানের সাশ্রয়ী কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার সুযোগ নারী-পুরুষের জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত হবে। বর্তমানে কারিগরি ও পেশাগত প্রশিক্ষণে নারীর অনুপাত এক-চতুর্থাংশ ও উচ্চশিক্ষায় নারীর অনুপাত এক-তৃতীয়াংশ।

৪. অধিকাংশ তরুণ ও বয়স্ক বিভিন্ন পেশায় ও কাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য উচ্চ মানের দক্ষতা অর্জন করবেন। এগুলোর মধ্যে থাকবে সমস্যা বিশ্লেষণ ও সমাধান, বিচক্ষণ চিন্তা, সৃজনশীলতা, দলবদ্ধ কাজ এবং বক্তব্য প্রকাশ ও যোগাযোগের দক্ষতা। বর্তমানে কারিগরি ও পেশাগত প্রশিক্ষণের প্রাসঙ্গিকতা, যথার্থতা ও মানে বড় ঘাটতি বয়েছে বলে স্বীকৃত।

৫. শিক্ষায় সব রকম বৈষম্য বিলুপ্ত হবে। লিঙ্গ, বয়স, মাতৃভাষা নৃ-পরিচয়, বর্ণ-ধর্ম, সামাজিক-আর্থিক অবস্থান বৈষম্যের কারণ থাকবে না। বর্তমানে আর্থিক, ভৌগোলিক, প্রতিবন্ধিতা ও নৃ-পরিচয়ের কারণে বৈষম্য বড় চ্যালেঞ্জ।

৬. সব তরুণ ও বয়স্ক মানুষ ব্যবহারযোগ্য সাক্ষরতা ও গণনার দক্ষতা আয়ত্ত করবেন, যা আনুষ্ঠানিক মৌলিক শিক্ষা সমাপ্তির সমতুল্য হবে। সবার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষা (প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষাসহ) কার্যক্রমের সুযোগ উন্মুক্ত হবে। বর্তমানে সরকারি হিসাবে ৭৩ শতাংশ বয়স্ক সাক্ষরতা অর্জন করেছেন। কিন্তু তাঁদের অনেকেরই দক্ষতার মাত্রা তাঁদের দৈনন্দিন প্রয়োজনের জন্য যথেষ্ট নয়। জীবনব্যাপী শিক্ষার কোনো কার্যক্রম গৃহীত হয়নি।

৭. সবাই টেকসই উন্নয়নের জন্য জ্ঞান ও দক্ষতা (ইএসডি) এবং বৈশ্বিক নাগরিকত্ববোধের শিক্ষায় (জিসিইডি) অংশ নেবে। এই জ্ঞান ও দক্ষতা শান্তি, মানুষের অধিকার, ভিন্ন সংস্কৃতি ও জাতি-পরিচয়ের প্রতি সহনশীলতা ও সহমর্মিতা বিকাশের মূল্যবোধ ও আচরণ প্রতিষ্ঠা করবে। বর্তমানে শিক্ষা কার্যক্রম ও পাঠক্রম সংস্কারের কাজে এ বিষয়গুলো বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়ন জটিল ও শিক্ষকের দক্ষতা, প্রস্তুতিসহ শিক্ষা সংস্কারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যের ওপর নির্ভরশীল। সামগ্রিকভাবে শিক্ষা খাতের জন্য মহাপরিকল্পনা গ্রহণ এখন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ও শিক্ষার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হবে বিদ্যালয়শিক্ষাকে দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বিভাজিত না রেখে একীভূত প্রশাসনে নিয়ে আসা। সামগ্রিক পরিকল্পনা তৈরি ও এটির অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন (উপযুক্ত দায়িত্ব ও কর্তৃত্বসহ) গঠন করা হবে আরেকটি জরুরি পদক্ষেপ। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে এ সুপারিশ করা হয়েছিল। এভাবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে শিক্ষাদারিদ্র্য উত্তরণের সূচনা হতে পারে।

মনজুর আহমদ: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক