শিক্ষাব্যবস্থা পুনরুদ্ধারে করণীয়

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ১২ সেপ্টেম্বর থেকে খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। প্রধানমন্ত্রীর নীতিগত অনুমোদন পাওয়া সাধারণ পাঠ্যক্রম সংস্কারের প্রস্তাবেরও আমরা প্রশংসা করছি।

দুটি শিক্ষাবর্ষ হারানোর পর বিদ্যালয়গুলো আবার চালু হওয়ার পর শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের নিরাপত্তা ও সুস্থতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পড়াশোনার ঘাটতি পুনরুদ্ধারে তাদের সাহায্য করতে হবে। এই করণীয়গুলো শিক্ষার্থীদের শিখনঘাটতি পূরণে যেমন সহায়তা করবে, তেমনি তাদের আগামী দিনের জন্যও তৈরি করবে। এ লক্ষ্যে আমরা চারটি প্রস্তাব করেছি এবং একই সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে কিছু করণীয়ও চিহ্নিত করেছি।

চারটি জরুরি ধাপ

শিক্ষা পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার অপরিহার্য উপাদান এবং ত্বরিত শিখনকে উৎসাহিত করার জন্য অত্যন্ত জরুরি চারটি ধাপ রয়েছে।

ধাপ ১: শিক্ষার্থীদের শিক্ষাস্তরের দ্রুত মূল্যায়ন

দুটি শিক্ষা বছর হারানোর পরে একজন শিক্ষার্থী কোন শ্রেণির জন্য প্রস্তুত? ২০২০ সালের মার্চ মাসে যে শিক্ষার্থী প্রথম শ্রেণিতে ছিল, ‘অটো-পাস’-এর কারণে সে এখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে এবং এই জানুয়ারিতে তৃতীয় শ্রেণিতে থাকবে। প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজনীয় দক্ষতা সে অর্জন করবে না। এটি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের জন্য অবিচার। এতে শিক্ষার্থীর স্থায়ী ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রাথমিক স্তরের জন্য বাংলা ও গণিত বিষয়ে এবং মাধ্যমিক শ্রেণির জন্য বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে দক্ষতা মূল্যায়নের জন্য দ্রুত পদ্ধতি নির্ধারণ ও তা প্রয়োগ করা উচিত। এই মূল্যায়নের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের তাদের অধীত শ্রেণির জন্য তৈরি করতে হবে। এ জন্য তার মৌলিক দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ত্বরিত শিখনের ব্যবস্থা করতে হবে।

কোনো শিক্ষাব্যবস্থা তার শিক্ষকদের চেয়ে ভালো হতে পারে না। শিক্ষকতা পেশায় মেধাবী ও নিবেদিত তরুণদের আকৃষ্ট করা এবং ধরে রাখার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এ জন্য উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার অভিজ্ঞতাগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে

ধাপ ২: শিখন পুনরুদ্ধারে পরিকল্পনা এবং স্থায়ীভাবে শিক্ষা বছর দীর্ঘায়িত করা

বর্তমান শিক্ষাবর্ষকে জুন, ২০২২ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করে স্কুল ব্যবস্থাকে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য ও শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতির জন্য সময় নেওয়া দরকার। ডিসেম্বরের মধ্যে পাবলিক ও বার্ষিক পরীক্ষায় ছুটে যাওয়া এড়িয়ে আরও বেশি সময় নেওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে জুলাই-আগস্ট দীর্ঘ গ্রীষ্মকালীন ছুটির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্থায়ীভাবে সেপ্টেম্বর-জুন স্কুল ক্যালেন্ডার চালু করা যেতে পারে। স্থায়ীভাবে সেপ্টেম্বর-জুন স্কুল ক্যালেন্ডার চালু করার যথেষ্ট জলবায়ু-সম্পর্কিত কারণও রয়েছে। রমজানের সময় শ্রেণি অনুযায়ী বিদ্যালয় সময়সূচি পরিমার্জন করা যাবে।


ধাপ ৩: পিইসি ও জেএসসি সমমানের পরীক্ষা পরিত্যাগ করা

প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রম ও শিক্ষার্থী মূল্যায়ন সংস্কারের ধারায় পিইসি ও জেএসসি ও সমমানের পরীক্ষাগুলো এই বছর থেকে বাদ দিয়ে শিক্ষকদের শক্তি ও প্রচেষ্টাকে পরীক্ষা প্রস্তুতির পরিবর্তে শেখার ক্ষতিপূরণের জন্য নিবেদিত করা। পরবর্তী এসএসসি পরীক্ষা আগামী বছরের প্রথম দিকে সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচিতে নেওয়া যাবে। জুন পর্যন্ত শিক্ষাবর্ষ বাড়ানোর কথা বিবেচনা করে মূল বিষয় তথা বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর পরীক্ষা নেওয়া যায় (বিভাগওয়ারি বিষয়ের পরিবর্তে)। মূল বিষয়গুলোতে দক্ষতা ভবিষ্যতে তাদের সহায়ক হবে। একইভাবে এইচএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে অনুরূপ ব্যবস্থা নিতে হবে।

ধাপ ৪: শিখন পুনরুদ্ধার বাস্তবায়নে শিক্ষকদের সহায়তা ও নির্দেশনা

শিখন পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার উপাদান এবং কার্যকর বাস্তবায়ন বিষয়ে স্কুল ও শিক্ষকদের জন্য নির্দেশিকা ও দিকনির্দেশনা প্রদান করা। যেমন: (ক) দ্রুত মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্তর নির্ধারণ; (খ) ফলাফলের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা নির্ধারণের পদ্ধতি প্রয়োগ; (গ) শিক্ষার্থীদের আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করার লক্ষ্যে মূল দক্ষতার ওপর মনোনিবেশ করা, (ঘ) শিক্ষার্থীদের সামাজিক-মানসিক সহায়তা প্রদান এবং শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। এ ছাড়া অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ব্যাপক ও যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে একদিকে শিক্ষকদের সঙ্গে অভ্যস্ত করে তাদের নির্দেশনা প্রদান এবং একই সঙ্গে অনলাইনের শিক্ষা যেন শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার পরিপূরক হয়ে ওঠে, তা নিশ্চিত করা।

দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার

চারটি জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার বিবেচনা ও প্রাথমিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

১. এসএসসি স্তর পর্যন্ত একটি মাত্র শিক্ষাধারা বাস্তবায়নের শর্ত তৈরি করা

দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটি সাধারণ শিক্ষাধারা বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রস্তুতি দরকার এবং সবাইকে তাঁদের ভূমিকা পালনের জন্য দক্ষ হতে হবে। বিজ্ঞান, গণিত, জীবন ও কর্মদক্ষতাবিষয়ক মূল বিষয়গুলোর শিক্ষামান বজায় রাখার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করার উদ্দেশ্যে কার্যকর পরিকল্পনা ও সম্পদ দিয়ে যথাযথ সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।

২. শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের নিয়ে নতুন চিন্তা

কোনো শিক্ষাব্যবস্থা তার শিক্ষকদের চেয়ে ভালো হতে পারে না। শিক্ষকতা পেশায় মেধাবী ও নিবেদিত তরুণদের আকৃষ্ট করা এবং ধরে রাখার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এ জন্য উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার অভিজ্ঞতাগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে। এটি বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এভাবে শিক্ষকের খারাপ মান ও দুর্বল শিক্ষার দুষ্টচক্র বিলুপ্ত হতে পারে। এই ধরনের পরিকল্পনার সম্ভাব্যতা ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সবাইকে আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন।


৩. শিক্ষা ব্যবস্থাপনা সংস্কার ও শিক্ষা-শাসন বিকেন্দ্রীকরণ

উন্নত দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থাসহ অধিকাংশ দেশেই স্কুলগুলো ও স্থানীয় শিক্ষা সংস্থা উচ্চতর কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের দ্বারা চিহ্নিত। মধ্যম আয়ের দেশ এবং শেষ পর্যন্ত উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কীভাবে এই দিকে অগ্রসর হওয়া যায়, তা আমাদের বিবেচনা করতে হবে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ গ্রহণের এক দশক পরও তা যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। সেখানে শিক্ষা সংস্কার প্রচেষ্টায় নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানের জন্য একটি স্থায়ী বিধিবদ্ধ শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ ছিল। এমন একটি সংস্থা স্থাপন গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা উচিত।

নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এই পরামর্শগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। সুপারিশকৃত সংস্কার ও তা বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে আমরা ভবিষ্যতে আরও সুপারিশ রাখব। আমরা আশা করি এটি একটি দরকারি আলোচনার সূত্রপাত করবে এবং তা বাস্তবায়নযোগ্য হয়ে উঠবে। দৃঢ় ও প্রথাবিরুদ্ধ কার্যক্রম এই ব্যতিক্রমী সময়ের দাবি।

এ বিষয়ে প্রশ্ন ও মতামত [email protected] –এই ই–মেইলে পাঠানো যাবে।

লেখকেরা শিক্ষাবিদ, সাবেক অধ্যাপক এবং শিক্ষা কার্যক্রম ও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত