শিক্ষামন্ত্রীর ‘শিগগির’ কবে হবে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে আবাসিক হলগুলো খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে প্রথমে এই সুযোগ পাবেন স্নাতক সম্মান শেষ বর্ষ ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে শঙ্কাও প্রকাশ করি, তারা শেষতক এই সিদ্ধান্ত রাখতে পারবে কি না। গত মার্চ মাসেও তারা আবাসিক হল খোলার ও শ্রেণিকক্ষে ক্লাস চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। এরপর অবশ্য করোনার ডেলটা ধরন এসে পুরো দেশ কাবু করে ফেলে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। সরকারের পক্ষ থেকে দফায় দফায় ছুটি বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।

১০-১২ দিন ধরে করোনা সংক্রমণ আবার কমতির দিকে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা মনে করেন, ছুটি আর না বাড়িয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যত দ্রুত সম্ভব খুলে দেওয়া উচিত। বাংলাদেশের চেয়ে সংক্রমণ বেশি এমন দেশও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এক পা সামনে এগোয় তো দুই পা পিছিয়ে যায়। ইউনেসকোর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, তাদের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মাত্র ১৯টি দেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘস্থায়ী ছুটি দিয়ে রেখেছে, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম।

মার্কেট, শপিং মল, সরকারি-বেসরকারি অফিস, গণপরিবহন সবই খোলা আছে। গত সপ্তাহে পর্যটনকেন্দ্রগুলো খোলারও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ থাকবে? এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, তাঁরা শিক্ষার্থীদের করোনার ঝুঁকিতে ফেলতে চান না। কিন্তু শিক্ষার ঝুঁকিটাও তো দেখতে হবে। ১৮ মাসের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ আছে। অনেক দেশই শ্রেণিকক্ষে ক্লাস বন্ধ থাকলেও অনলাইনে বিকল্প ক্লাস চালু রেখেছে এবং অনেকটা সফলও হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশকে আমরা ডিজিটাল ডিজিটাল নিয়ে যতই চিৎকার করি না কেন, এখনো অ্যানালগে আছি। অনলাইনে ক্লাস করতে গিয়ে আবারও তা প্রমাণিত হলো। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের কথা না হয় বাদই দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও অনলাইন ক্লাসের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন অধিকাংশ শিক্ষার্থী। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতেই স্নাতক পর্যায়ের ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী। তাঁদের ১০ শতাংশও অনলাইন সুবিধা পাননি। এই বঞ্চনার জন্য দায়ী কে?

আমাদের শিক্ষার অভিভাবক বলে যাঁরা দাবি করেন, তাঁরা অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন না। সরকার ব্যবসা-বাণিজ্য চালু রাখতে কোটি কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে। রপ্তানিমুখী শিল্প চালু রাখতে প্রণোদনা দিয়েছে। কিন্তু শিক্ষা চালু রাখার জন্য কিছু করেনি। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া শিক্ষা চালু রাখা নয়। অনলাইন ক্লাস করতে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কী সমস্যা, কোনো শিক্ষার্থীর অনলাইনে ক্লাস করার সুবিধা আছে কি না—সেসব খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। ফলে অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী বঞ্চিত হয়েছেন। অথচ তাঁদের হাতে একটি স্মার্টফোন দিলে, যাঁদের স্মার্টফোন নেই, তাঁদের বিনা মূল্যে বা স্বল্প মূল্যে ডিভাইস সরবরাহ করলে সমস্যাটি সহজেই সমাধান করা যেত। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি সুপারিশও পাঠিয়েছিল।

অনেক দেশই শ্রেণিকক্ষে ক্লাস বন্ধ থাকলেও অনলাইনে বিকল্প ক্লাস চালু রেখেছে এবং অনেকটা সফলও হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশকে আমরা ডিজিটাল ডিজিটাল নিয়ে যতই চিৎকার করি না কেন, এখনো অ্যানালগে আছি। অনলাইনে ক্লাস করতে গিয়ে আবারও তা প্রমাণিত হলো। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের কথা না হয় বাদই দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও অনলাইন ক্লাসের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন অধিকাংশ শিক্ষার্থী।

কিন্তু ইচ্ছে থাকলে যে উপায় হয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) তা প্রমাণ করেছে। তারা তাদের পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীর কাছে ফরম পাঠিয়ে জানতে চেয়েছে, অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে কার কী সমস্যা আছে। এরপর তাদের চাহিদার ভিত্তিতে সবাইকে বিনা সুদে ঋণ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক হল বন্ধ থাকায় তাদের বিদ্যুৎ-পানিসহ অনেক খরচই কম হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব তহবিল থেকে শিক্ষার্থীদের এই সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

এ কথা সত্য যে, সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে অনেক বেশি শিক্ষার্থী তাঁদের পক্ষে নিজস্ব তহবিল থেকে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সহায়তা দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সরকার তো সহায়তা দিতে পারত। কেন তারা করোনাকালে শিক্ষা চালু রাখতে বিশেষ তহবিল করল না? কেন সরকার কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো বাদ দিয়ে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াল না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলো করোনাকালেও শিক্ষা কার্যক্রম যথারীতি চালু রেখেছে এবং শতভাগ শিক্ষার্থীর অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষা নিশ্চিত করেছে।

গত মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ‘আশা করি, যেভাবে সংক্রমণের হার ক্রমে নিচে নেমে আসছে, এটা আমাদের জন্য সুখবর। এই নিম্নগতি অব্যাহত থাকলে খুব শিগগির সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে পারব। তবে ধাপে ধাপে খুলব। কারণ, আমাদের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা পৃথিবীর যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি। করোনায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।’

শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, ‘সবাই শুরু থেকেই সপ্তাহে ছয় দিন হয়তো ক্লাস করার সুযোগ পাবে না। একটু সময় নিয়ে হবে সেটা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য আমাদের সার্বিক প্রস্তুতি আছে। শুধু অপেক্ষা সংক্রমণের হার আরেকটু নিচে নামার।’ একই দিন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের। তাঁদের এই সদিচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়েও বলছি, কবে নাগাদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে, দয়া করে জানাবেন কি? শিক্ষামন্ত্রী যে বলেছেন, শিগগিরই খুলে দেওয়া হবে। সেই ‘শিগগিরই’টা কবে আসবে।

প্রস্তুতি তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ার-টেবিল সাফসুতরো করলেই হবে না; অন্যান্য পূর্বশর্তও মানতে হবে। সেই পূর্বশর্তের একটি হলো শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া নিশ্চিত করা। অন্তত যাদের বয়স ১৬ বছর তাদের ও তাদের ওপরের বয়সী শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৭ কোটি টিকা আসবে। তিনি যা বলেন, বাস্তবে তার উল্টোই ঘটে। করোনা রোগীদের টিকা ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে অনেক উল্টাপাল্টা ঘটনা ঘটেছে, এখন দয়া করে এসব থেকে বিরত থাকুন। কবে দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর টিকা দেওয়া নিশ্চিত করতে পারবেন, সেই রূপরেখা দিন।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি। [email protected]