শিক্ষার এই দুর্গতি ঠেকাবে কে?

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক মোছাম্মৎ হাস্নাহেনার সাহসের তারিফ করতে হয়। তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য পদ পাওয়ার জন্য শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আবেদন করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। দরখাস্ত করার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে এই অধ্যাপক বলেছেন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন নারী সহ-উপাচার্য থাকা দরকার এবং ওই পদে তিনি নিজেকে যোগ্য মনে করেন।

কিন্তু গোল বেঁধেছে সেই যোগ্যতাকে আরও বেশি পোক্ত করতে হাস্নাহেনা সরকারের দুজন মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের সাতজন নেতার সুপারিশ নিয়েছেন। প্রার্থীর যোগ্যতা থাকলে অন্য কারও সুপারিশের প্রয়োজন হয় না, তাও শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন, এমন ব্যক্তিদের। মেডিকেল শিক্ষার সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর একটি সম্পর্ক থাকলেও শিক্ষার সঙ্গে নৌপরিবহনমন্ত্রীর কোনো যোগসূত্র আছে বলে মনে হয় না। এর বাইরে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির দুজন সদস্য, যাঁর একজন জাতীয় সংসদের সাংসদ, একজন রাজশাহী মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, আরেকজন মহানগর যুবলীগের সভাপতির সুপারিশ নিয়েছেন, যাঁদের কাজের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। হাস্নাহেনার এই দরখাস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ কিংবা শিক্ষামন্ত্রী আমলে নেননি বলেই চলতি বছর ১৯ মার্চ আরেকজনকে সহ–উপাচার্য পদে নিয়োগ দেন।  অথচ অধ্যাপক হেনা ‘বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য পদে একজন লোক নিয়োগ করা হবে’ বলে দরখাস্ত করেন, তার পাঁচ মাস আগে ২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর।

এর মাধ্যমে হাস্নাহেনা এবং তাঁর দরখাস্তের সুপারিশকারীরা বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাব্যবস্থাকে কোথায় নামিয়ে এনেছেন, সেটি অনুমান করা কঠিন নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক সহ-উপাচার্য পদে নিজেকে যোগ্য প্রার্থী মনে করা সত্ত্বেও তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো জ্যেষ্ঠ শিক্ষক, সাবেক উপাচার্য, সহ-উপাচার্য কিংবা শিক্ষক সমিতির কাছে ধরনা না দিয়ে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতা-নেত্রীর সুপারিশ নিয়েছেন। কেননা তিনি মনে করেছেন নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকাই বড়। এই দরখাস্তের মধ্য দিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটি খণ্ডচিত্র পাওয়া গেল।

২.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে ‘সম্পূর্ণ অস্থায়ী’ হিসেবে সাবেক সহ-উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের নিয়োগের মধ্য দিয়ে কয়েক মাস ধরে এই পদ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার সমর্থক শিক্ষকদের মধ্যে যে টানটান উত্তেজনা, পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, আইন-আদালত, মামলা ইত্যাদি চলছিল, তার আপাতত অবসান হয়েছে বলে মনে করি। অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এই পদে আট বছর সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলেও শেষ দিকে কোথায় যেন ছন্দপতন ঘটে যায়। শিক্ষকদের একাংশ তাঁর বিরুদ্ধে চলে যান, যা নিয়ে নীল দল বলে পরিচিত সরকার সমর্থক শিক্ষকদের গণভবন পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা গেছে। নতুন উপাচার্য দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্যাম্পাসে একটি কথা চাউর হয়ে গিয়েছিল যে হল প্রশাসন ও প্রক্টর অফিসের দায়িত্ব পালনকারীরা একযোগে পদত্যাগ করতে পারেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা কেউ পদত্যাগ করেননি। এবং সেটি না করে একটি মন্দ দৃষ্টান্ত থেকে দেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়টিকে রক্ষা করেছেন। এখন নতুন উপাচার্য শিক্ষকদের দ্বন্দ্বে প্রায় স্থবির বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষা ও গবেষণার কার্যক্রমে গতি ফিরিয়ে আনতে পারেন কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।

অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করলে সাবেক উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি বেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়েছেন। তাঁর সময়ে ক্যাম্পাসে বড় ধরনের অঘটন ঘটেনি। কিন্তু একজন উপাচার্যের কাজ শুধু পরিস্থিতি সামাল দেওয়া নয়, তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়কে সত্যিকার জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ভবিষ্যতের নেতৃত্ব তৈরি হবে। গত সাড়ে আট বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে, তার কোনো কোনোটির উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। নতুন বিভাগ খোলার চেয়ে পুরোনো বিভাগ বা বিষয়ে গবেষণা বাড়ানোর কাজটি জরুরি ছিল। নতুন উপাচার্য দায়িত্ব নেওয়ার পর শোনা যাচ্ছে, গবেষণাকাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আরেকজন সহ-উপাচার্য নিয়োগ করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিমধ্যে উপাচার্য ও সহ-উপাচার্য মিলে তিন শীর্ষ পদাধিকারী আছেন। আশা করি আখতারুজ্জামানের আগের শূন্য পদেও একজন নিয়োগ পেয়ে যাবেন এবং সে জন্য রাজশাহীর হাস্নাহেনার মতো কেউ দরখাস্ত না করলেও অনেকে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন। মাথাভারী প্রশাসন কখনোই গবেষণার সহায়ক নয়। দুই সহ-উপাচার্যের মধ্যে যিনি একাডেমিক বিষয়টি দেখেন, তিনিই গবেষণার কাজ তদারক করতে পারেন; এ জন্য একজন বাড়তি সহ-উপাচার্য নিয়োগের প্রয়োজন নেই।

 দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ আছে। সাবেক উপাচার্য শিক্ষার্থীদের অনেক দাবির সঙ্গে একমত হলেও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ার হোসেন অন্তত চেষ্টা করেছিলেন ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়ার। কিন্তু আরেফিন সাহেব চেষ্টাও করেননি। তিনি বলতেন, এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। তাই যদি হবে, তাহলে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশটি ছুড়ে ফেলতে হয়। ক্যাম্পাসে এখন সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনটি ছাড়া অন্য কারও কার্যক্রম তেমন লক্ষ করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও নিরাপদ বোধ করে না। কয়েক দিন আগে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সাধারণ ছাত্র পরিষদ আহূত সমাবেশে যোগ দিতে গিয়ে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা ছাত্রলীগের কাছে ধাওয়া খেয়েছেন। তারপরও ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আপত্তি কোথায়? ১০৫ সদস্যের সিনেট যদি ৪৭ জনকে নিয়ে বিশেষ অধিবেশন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করতে পারে, তাহলে তারা কেন ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না? যেখানে সামরিক সরকারের আমলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো, সেখানে গণতান্ত্রিক আমলে কেন হবে না? এ ব্যাপারে সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, ‘আমরা ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে ভয় পাই না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্বাচন দিলে আমরা অংশ নেব।’

তাহলে সমস্যাটি কোথায়? যাঁরা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার মালিক-মোক্তার, তাঁরাই–বা কেন ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে ভয় পাচ্ছেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য, যিনি দেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে এসে ডাকসু নির্বাচন করার তাগিদ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। বরং সম্প্রতি বাম ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানাতে গিয়ে লাঞ্ছিত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁদের লাঞ্ছনার মূল্য না দিক, অন্তত রাষ্ট্রপতি আচার্যের অভিপ্রায়ের মূল্য দিক।

৩.

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে কথা উঠলেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষকেরা নানা ব্যাখ্যা দেন ও অজুহাত তোলেন। বহির্বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, অবকাঠামোগত সুবিধা, শিক্ষায় বরাদ্দ ইত্যাদির কথা বলেন। মেনে নিলাম। কিন্তু তাঁরা কি অস্বীকার করতে পারবেন, অতীতে কম সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা তথা জ্ঞান সৃষ্টিতে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। তখন কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো বিভাগের শিক্ষকেরা এমন সব গবেষণা করেছেন, যা বাইরের দুনিয়ায় সমাদৃত ও আলোচিত হয়েছে। এখন শিক্ষকেরা গবেষণার চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন দলীয় রাজনীতি ও পদ-পদবি নিয়ে। ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক রেহমান সোবহান এক দেশ দুই অর্থনীতি তত্ত্ব নিয়ে পাকিস্তানকেই নাকচ করে দিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জামাল নজরুল ইসলাম কেবল দেশে নয়, বিদেশেও নন্দিত ছিলেন। রাষ্ট্র বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গবেষণায় প্রণোদনা দেবে, কিন্তু কাজটি করতে হয় শিক্ষককেই।

এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার দুর্বলতার দিকটিও আলোচনার দাবি রাখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় যখন এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া পরীক্ষার্থীদের ৯০ শতাংশ অকৃতকার্য হতে দেখি, তখন আক্ষেপ হয়। শিক্ষাবিদ ও লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একবার বলেছিলেন, তাঁদের বিভাগে যেসব ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়, তাদের ৮০ শতাংশ ন্যূনতম ইংরেজি জানে না। আরেকজন শিক্ষক সম্প্রতি জানিয়েছেন, তাঁর বিভাগে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ ইংরেজি দূরে থাক, একটি বাংলা বাক্যও শুদ্ধ করে লিখতে পারে না। এর কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় সৃজনশীল প্রশ্ন ও পাঠপদ্ধতির নামে যা হচ্ছে, তা প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল আলম খান জানিয়েছেন, এই শিক্ষা শিক্ষাও নয়, সৃজনশীলও নয়। পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর বাবা দুঃখ করে বলেছেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে এবং দীর্ঘদিন সাহিত্যচর্চা করেও তাঁর পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া সন্তানের বাংলা বইয়ে সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর বুঝতে পারেননি। তিনি বিষয়টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একজন শিক্ষককে দেখালে তিনিও অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তাহলে শিক্ষার্থী কী শিখবে?

 শিক্ষামন্ত্রী অতীতের কথা পুনরুল্লেখ করে বলেছেন, শিক্ষকেরা কোচিং বাণিজ্য করবেন, এটি মেনে নেওয়া যায় না। শিক্ষকদের কথা বাদ দিলাম। কেন শিক্ষার্থীরা কোচিং করে, সেই প্রশ্নের জবাব ওই অভিভাবকের ক্ষুব্ধ মন্তব্যের মধ্যেই প্রতিধ্বনিত হয়।

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষার এই দুর্গতি ঠেকাবে কে?

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।