শিক্ষার মান, কোচিং ও শিক্ষা-বাণিজ্য

দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ দেওয়ার দাবিতে ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশ
দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ দেওয়ার দাবিতে ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশ

মাস দুয়েক ধরে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বাঙালি হুজ্জত পছন্দ করে। তবে শিক্ষা নিয়ে হুজ্জত ভালো। অন্তত যাঁরা সাধারণত রাজনীতির আলোচনা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাঁরা নতুন একটি ইস্যু পেলেন। শুরুটা হয়েছিল এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পরপর। ৭৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রী এই পরীক্ষায় পাস করল। বেশুমার ছাত্রছাত্রী ‘এ প্লাস’ বা ‘গোল্ডেন এ প্লাস’ পেয়েছে। সবার চক্ষু চড়কগাছ। ওমা, সে কী কথা! এত পরীক্ষার্থী পাস করল আর এত বিশালসংখ্যক পরীক্ষার্থী এ প্লাস পেল, তা কেমন করে সম্ভব?
যাঁরা এই আহাজারি করেন, তাঁরা সবাই আমার বা আমার আগে-পরের প্রজন্ম। তখন এসএসসি অথবা এইচএসসি পরীক্ষায় ৪০ শতাংশ পাস করলে সবাই বলত, এবার শিক্ষা বোর্ড ৪০ শতাংশ পাস করিয়েছে। কদাচিৎ শোনা যেত, ৪০ শতাংশ পাস করেছে। প্রথম বিভাগ পেলে তো কথাই নেই। আমি দুটি পরীক্ষায় বোর্ডের মেধাতালিকায় স্থান পেলে আমাদের পাড়ামহল্লায় সেকি কাণ্ড। রাতারাতি সেলিব্রেটি। যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসব (তখন কোনো ভর্তি পরীক্ষা চালু হয়নি) তখন মহল্লার লোকজন মিলে শুধু আমাকে নয়, আমার বাবাকে পর্যন্ত এক ছোটখাটো সংবর্ধনা দিল। মহল্লার প্রথম স্থানীয় ছেলের উচ্চশিক্ষায় ঢাকা যাত্রা! তখন কেউ পড়ালেখার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। তখন কোচিং শব্দটির সঙ্গে সম্পূর্ণ অপরিচিত। ক্লাসের যেসব ছাত্র অঙ্কে কাঁচা, তাদের জন্য সপ্তাহে এক কি দুই দিন বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা। ইংরেজি নিয়ে সমস্যা নেই, কারণ স্কুলটা ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত খানদানি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। যুগের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু পাল্টে গেল।
এখন এসব পাবলিক পরীক্ষায় পাস করলে কেউ তেমন একটা খোঁজখবর নেয় না, কারণ এখন শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। বাড়ির ছেলেমেয়েরা স্কুল-মাদ্রাসায় পড়ছে। পরীক্ষায় পাস করা তেমন কোনো বিষয় নয়, কারণ পাঠশালায় গেলে একজন শিক্ষার্থী পাস করবে, তাই স্বাভাবিক। পাঠশালায় কেউ ফেল করতে যায় না। সুতরাং, এত ছেলেমেয়ে পাস করলে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।
তবে পুরো বিষয়টা অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে সামনে চলে আসে, যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় শতকরা ১০ থেকে ১৫ জন ভর্তির জন্য মনোনীত হলো। পুরো বিষয়ে আরও উত্তাপ ছড়াল যখন ইংরেজি বিভাগে ভর্তির জন্য মাত্র দুজন পরীক্ষার্থী নির্বাচিত হলো। সবাই সমস্বরে চিৎকার শুরু করে দিয়ে বলল, এত ছেলেমেয়ে পাস করল, গোেল্ডন এ প্লাস পেল—তাহলে এত বিরাটসংখ্যক পরীক্ষার্থী ফেল করে কীভাবে? বিষয়টা তো পাস-ফেলের বিষয় নয়। আসল বিষয় হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যার তুলনায় পরীক্ষা দিয়েছে অনেক বেশি। সুতরাং, ভর্তি হতে না পারার সংখ্যা তো বাড়বেই। সামনের বছর যদি আরও বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী এইচএসসি পাস করে আর ঢাকা বা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আসনসংখ্যা অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে অবস্থা এই বছরের তুলনায় তো আরও খারাপ হবে। এটি সাধারণ গাণিতিক হিসাব। আর ইংরেজি বিভাগে যা হয়েছে, তা হচ্ছে স্রেফ পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে। অ্যাডভান্সড ইংরেজিতে পরীক্ষা দিতে হবে, তা পরীক্ষার্থীরা জেনেছে অনেক পরে। এর দায়দায়িত্ব কিছুটা হলেও বিভাগ বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। ২০০০ সালে আমার কন্যা ইংরেজিতে প্রথম দফায় টিকেও পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তির নির্ধারিত যোগ্যতা পরিবর্তন করলে তার আর ওই বিভাগে পড়া হয়নি।
সবাই শিক্ষার মান নিয়েও বেশ কথা বলছেন। এত বেশিসংখ্যক পাস অথবা এত গোল্ডেন এ প্লাসের অর্থ কি শিক্ষার মানও বেড়ে গেছে? সবাই মোটামুটি একমত—না, তা বাড়েনি। তাদের সঙ্গে দ্বিমত নেই। তবে এর জন্য শিক্ষার্থীদের দায়ী করতে আমি নারাজ। আমার চার দশকের বেশি সময়ের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এর দায়দায়িত্বের বেশির ভাগ শিক্ষকদের। ১৯৯৮ সালে আমার সুযোগ হয়েছিল ইউনেসকোর আমন্ত্রণে বিশ্বভারতীর এক আন্তর্জাতিক উচ্চশিক্ষা সম্মেলনে যোগ দেওয়ার। একটি সেশনে প্রবন্ধ পাঠ করবেন বিশ্বভারতীর একসময়ের উপাচার্য ও প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অম্লান দত্ত। নির্ধারিত সভাপতি না আসায় সভায় সভাপতিত্ব করার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। বিষয় ‘উচ্চশিক্ষার মান’। এই বিষয়ে বলতে গিয়ে একপর্যায়ে অধ্যাপক দত্ত বললেন, If the students have not learnt, teachers have not taught। শিক্ষার্থীরা যদি না শেখে, তাহলে বুঝতে হবে, শিক্ষক তাদের পাঠদান করেননি।
এর চেয়ে খাঁটি কথা আর কী হতে পারে? প্রথমে এটি স্বীকার করে নেওয়া ভালো, শিক্ষার মান বিষয়টা অনেকটা আপেক্ষিক এবং তা বহুলাংশে নির্ভর করে শিক্ষকদের ওপর। একসময় গ্রামের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে পাবলিক পরীক্ষায় শহুরে শিক্ষার্থীদের চেয়ে ভালো করত। এখন তা হয় না, তার অন্যতম কারণ গ্রামের স্কুল-কলেজগুলোতে এখন আর ভালো শিক্ষক পাওয়া যায় না। অন্যদিকে শহুরে শিক্ষার্থীদের অনানুষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ অনেক বেশি। তবে গ্রাম হোক আর শহর, সবখানেই শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের লেঠা চুকেছে অনেক আগেই। ব্যতিক্রম কিছু অবশ্যই আছে। পড়ালেখা এখন প্রায় সম্পূর্ণটাই কোচিং সেন্টার আর পরীক্ষামুখী। শ্রেণিকক্ষে ঢুকে একজন শিক্ষক প্রথমে যে কাজটি করেন, তা হচ্ছে বোর্ডে তাঁর কোচিং সেন্টারের ঠিকানাটা লেখা। এ কাজে ড্রয়িং শিক্ষক থেকে বাংলার শিক্ষক—কেউ বাদ যান না। ব্যতিক্রম বাদ দিচ্ছি।
চট্টগ্রামে একজন শিক্ষক বাড়িতে ইংরেজি বিষয়ে প্রাইভেট পড়াতেন। সকাল পাঁচটায় শুরু হতো। টেপরেকর্ডার ছেড়ে দিয়ে তিনি ঘুমাতে যেতেন। পদোন্নতি দিয়ে তাঁকে সন্দ্বীপে বদলি করা হলো। চাকরিতে ইস্তফা দিলেন, কারণ তাঁর প্রাইভেট পড়ানোতে বিঘ্ন ঘটবে। পরের দিকে তিনি ধর্মসভায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতেন। এখন কেউ তেমন আর বাড়িতে প্রাইভেট পড়ান না। সবাই নিজে একটা আস্ত বাড়ি অথবা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেন। পশ্চিম ধানমন্ডির ৯/এ সড়কে বিকেল চারটার পর থেকে হাঁটাচলা অসম্ভব, কারণ ওই সড়কে অবস্থিত একটি কোচিং সেন্টারে দলে দলে ছাত্রছাত্রীরা গাড়িতে করে আসে কোচিংয়ে পড়তে। সে এক এলাহি কারবার। প্রায় সব কোচিং সেন্টারের মালিকেরাই এই ঢাকা শহরে একাধিক বাড়ি-গাড়ির মালিক।
বড় প্রশ্ন, তাঁরা যে বিষয়টি এই কোচিং সেন্টারে পড়ান, তা ক্লাসে কেন পড়াতে পারেন না? এই প্রশ্নের কোনো জবাব কিন্তু তাঁদের কাছে কখনো পাওয়া যাবে না। শিক্ষার্থীদের এসব কোচিং সেন্টারে না এসে কি কোনো উপায় আছে? না, নেই। কারণ, না এলে তার পক্ষে স্কুল বা কলেজ পরীক্ষায় কখনো পাস করা সম্ভব হবে না, সে যত ভালো পরীক্ষাই দিক না কেন। কোচিং সেন্টারে আসতে সে বাধ্য। একজন অভিভাবকের তঁার প্রত্যেক সন্তানের জন্য মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা কোচিং সেন্টার বাবদ ব্যয় অনেকটা বাধ্যতামূলক। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে ঘোষণা করে, তাদের কলেজে পড়লে প্রাইভেট কোচিংয়ের প্রয়োজন হয় না। যে কথাটি তারা বলে না, এসব প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ক্যাম্পাসে কোচিং বাবদ বছরের শুরুতেই লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। বাংলাদেশে শিক্ষার যদি কেউ সর্বনাশ করে থাকেন, তাহলে তার দায়দায়িত্ব ওই কোচিং সেন্টারওয়ালা শিক্ষকদেরই নিতে হবে। তাঁরা সবাই মিলে বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা বাণিজ্য করেন কিন্তু কর-খাজনা দেন বলে তেমন একট শোনা যায় না।
সেদিন একটি টিভি টক শোতে এ বিষয়ে চমৎকার একটি আলোচনা হচ্ছিল। অন্যদের সঙ্গে ছয়জন সদ্য এইচএসসি পাস করা শিক্ষার্থীও অংশ নিয়েছিল সেই টক শোতে। তাদের একাধিকজন বলল, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও তাদের কোচিং সেন্টারে যেতে বাধ্য করেন তাদের মায়েরা (বাবারা নন)। মায়েরা সন্তানদের পড়ালেখা নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকেন, তা সত্য কিন্তু তাঁদের প্রতি অনুরোধ কোচিং সেন্টারে যেতে বাধ্য করে আপনার সন্তানের সৃজনশীলতা ধ্বংস করবেন না। বর্তমান ছাত্ররা মেধাবী নয়, তা মানতে রাজি নই। তবে এটি মানতে হবে, তাদের মেধার মান উন্নত করার যথেষ্ট সুযোগ আছে, সার্বিক পরিবেশের কারণে তা তারা করতে পারে না। এটি সম্ভব স্কুল কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক আর সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হোক সব কোচিং সেন্টার । স্কুলে ভালো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক দেওয়া হোক, পড়ালেখার পরিবেশ উন্নত করা হোক। আমার বাড়ির সামনে একটি প্রাইমারি স্কুল আছে। তাতে ইসলামিয়াত পড়ানোর কোনো শিক্ষক নেই কয়েক বছর ধরে। বর্তমান মন্ত্রিসভায় যে কজন সফল মন্ত্রী আছেন, নিঃসন্দেহে শিক্ষামন্ত্রী তাঁদের অন্যতম। তাঁর আমলে এমনটি ঘটবে কেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারাটা হচ্ছে স্রেফ চাহিদার চেয়ে জোগান কম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় হাজার আসনের বিপরীত তিন লাখ দুই হাজার ৬৩ জন ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিল। প্রতি আসনের জন্য ৪৬ জন। এ জোগানটা বাড়াতে হবে। আবার এটাও ঠিক, সবাইকে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে কেন? সারা বিশ্বে বর্তমানে কারিগরি বৃত্তিমূলক দক্ষতার মূল্য অপরিসীম। বাংলাদেশে এই শিক্ষায় তেমন একটি প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায় না। মাত্র ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী এই শিক্ষায় আসে। এখানে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার বিকল্প নেই। পরীক্ষা পাসের নম্বর বাড়িয়ে নাকি শিক্ষার মান বাড়ানোর একটি অভিনব চিন্তা করা হচ্ছে, যা নিতান্তই বোকামি। পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর শিক্ষার মানের মাপকাঠি নয়। শিক্ষক নিয়োগে পৃথক কমিশনের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। এটি উত্তম প্রস্তাব। একই সঙ্গে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতনকাঠামো প্রয়োজন। শিক্ষাকে শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনতে পারলে সমস্যার অর্ধেক সমাধান হয়ে যাবে। যেসব শিক্ষক এ কাজ করতে অক্ষম তাঁদের আলু-পোটলের ব্যবসা করা ভালো।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।