শিক্ষার্থী–গ্রামবাসী, কেউ কারও শত্রু নয়

তালা ভেঙে হলে ওঠার আগে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

কোভিড-১৯–এর ছোবল থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে গত বছরের ১৭ মার্চ বাংলাদেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোও ছেড়ে চলে যেতে হয় শিক্ষার্থীদের। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকলেও নানা কারণে মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আবারও উত্তপ্ত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের গেরুয়া গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে ১৯ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীদের সংঘাতের পর এখনো উত্তপ্ত ক্যাম্পাস।

গেরুয়া গ্রামবাসী এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ–মারামারিতে ৩৫ জন শিক্ষার্থী আহত হয় এবং পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের গেট ভেঙে অনেক শিক্ষার্থী হলে অবস্থান নেয়। শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী অজ্ঞাত ২৫০ জনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

অন্যদিকে তালা ভেঙে প্রবেশ করে আবাসিক হলে থাকা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে আলটিমেটাম দিয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, তাদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে (প্রথম আলো ২১ ফেব্রুয়ারি)। শিক্ষার্থীদের অন্যতম দাবি হলো, ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে গেরুয়া গ্রামবাসীর চলাচল নিষিদ্ধ এবং এটির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংযোগ গেটটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া। এটিকে শিক্ষার্থী বনাম গ্রামবাসীর লড়াই হিসেবে গণমাধ্যম হাজির করছে।

এই ঘটনাটি যখন পত্রিকায় পড়ছিলাম, তখন আমাদের শিক্ষার্থী জীবনের কথা মনে পড়ে গেল। ১৯৯৭ সালে সাভারের আমিনবাজারে আমদু হাজির গ্রুপের কয়েকজন সন্ত্রাসী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে আক্রমণ চালালে তখনো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শ্রমিকদের বড়সড় বচসা হয়। সে সময়টি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল, তখন সেটি থামাতে সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়েছিল এবং সেদিনও পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করেছিল শিক্ষার্থীদের ওপর। সে সময়ও বিষয়টিকে শ্রমিক বনাম শিক্ষার্থী হিসেবে হাজির করা হয়েছিল এবং এই ধরনের উপস্থাপন সমাজের অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটো গ্রুপকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর রাজনীতি অব্যাহত থাকার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।

ঠিক এবারও তেমনটাই ঘটেছে। বলা হয়েছে শিক্ষার্থী ও গ্রামবাসীর মুখোমুখি অবস্থানের কারণ কয়েক দিন আগে আয়োজিত একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। কিন্তু এর পেছনের মূল কারণটি এখনো আড়ালেই রয়েছে। আসলে এখানে বড় বিষয় হলো সেই এলাকায় ক্ষমতাসীন আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল। এখানে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগেও ক্ষমতাসীন সংগঠনের ক্ষমতাকেন্দ্রিক আধিপত্য কেন্দ্র করে ‘লোকাল’ এবং ‘নন–লোকাল’ সংঘর্ষে ১৯৯৪ সালে ছাত্রদল নেতা দীপু নিহত হয়েছিলেন।


এর পরের প্রসঙ্গটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের বিষয় যখন ঘটে, তখন আমরা যদি এটিকে শিক্ষার্থী-স্থানীয় জনগণ কিংবা শিক্ষার্থী-শ্রমিকের সংঘর্ষ হিসেবে পাঠ করতে চাই। এই প্রবণতা খুবই ঝুঁকির এবং এটি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যের বিপরীতে অবস্থান করে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় জনগণের সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

তবে সম্ভবত আমাদের শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো ধরনের ত্রুটি রয়েছে, তা না হলে শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেকের মধ্যেই অযথাই ক্ষমতাচর্চার ঝোঁক আছে। যে কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস অনেক সময় উল্টো রাস্তা দিয়ে যায়, শুধু শিক্ষার্থীদের বাস বলে। ঠিক একইভাবে এই ঘটনার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলেছে, গ্রামবাসী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করতে পারবে না।

অথচ বিষয়টি ভিন্ন হওয়ারই কথা। শিক্ষার সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক অনিবার্য। লোকালয়–সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনেক। কিন্তু এর বিপরীতে গিয়ে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কেন সমাজ বিচ্ছিন্ন এবং একই সঙ্গে ক্ষমতাচর্চার জায়গা হয়ে উঠছে, সেটি নিয়ে কথা পাড়া অতি জরুরি। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি লোকজন ব্যবসা করতে চায় না চাঁদার ভয়ে। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও কীভাবে সামাজিক কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতা কাজ করে, সেই বিশ্লেষণও জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অন্য অনেকের চেয়ে সামাজিকভাবে মর্যাদাবান, যার কারণে তাদের ক্ষমতাচর্চা একভাবে সামাজিকভাবে গৃহীত হয়ে আসছে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, আমরা কী তবে এই ধরনের সমাজ ও পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে সম্পর্ক বাদ দিয়ে শুধু নানা ক্ষমতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি?

কেন এই প্রশ্ন? কারণ, শিক্ষার্থীরা অন্য কারও প্রবেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধ করছে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এখনো অনেকের কাছেই চড়ুইভাতি করা, শীতের পাখি দেখতে যাওয়া কিংবা ঘুরতে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে আদর্শ জায়গা। তাতে শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা নেই। তাদের সমস্যা শুধু গ্রামবাসীর চলাচল নিয়ে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের বক্তব্য আমলে নিতে হবে। তিনি শিক্ষক হিসেবেও যদি সেই বিশ্ববিদ্যালয়–সংশ্লিষ্ট গ্রামটিতে যাওয়া নিয়ে নানা ধরনের যুক্তি পাড়েন, তাহলে মনেই হতে পারে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের সম্পর্কের টানাপোড়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকাও আছে। কারণ, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা শিক্ষার্থীদের কাছে স্পষ্ট করতে পারেননি।

আমাদের মানতে হবে, বুঝতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু এর দেয়ালের চৌহদ্দীতে আবদ্ধ রাখলে সেটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে না। আশপাশের অনেক সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং আয়োজনের সঙ্গে এর প্রতিদিন লেনদেন হবে, সেটিই কাঙ্ক্ষিত। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এলিটিজম’ দেখানোর সুযোগ এদিকে যেমন কমই তেমনি সংবাদমাধ্যমে এটিকে গ্রাম বনাম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উপস্থাপন সমস্যার মূল জায়গাকে আড়াল করার দিকে আমাদের নিয়ে যায়। তাই রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই এই সংঘাত। এখানে শিক্ষার্থী এবং গ্রামবাসীকে মুখোমুখি দাঁড় করাবেন না, এদের সম্পর্ক অনেক নির্ভরশীলতার, কারণ, এরাই একে অপরকে তৈরি করছে।

জোবাইদা নাসরীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। [email protected]