শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের আর কী কী পথ খোলা আছে?

ছবি: প্রথম আলো


হঠাৎ করেই পলাশীসহ অনেক জায়গায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আনাগানো বাড়ছে। পলাশী বাজারেই দেখা হলো কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। জানাল, পত্রিকায় পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা জেনে দেরি না করেই তারা চলে এসেছে ঢাকায়। উঠেছে মেসে। পরীক্ষা কবে হবে, তারিখ হয়েছে কি না, সেটি জিজ্ঞেস করতেই একজন বলল, ‘পরীক্ষার তারিখ দিলে তো সবাই একসঙ্গে আসবে ক্যাম্পাসে। হল তো খুলছে না, তখন এই মেসগুলোতেই আর সিট পাওয়া যাবে না, তাই আগেই চলে এসেছি, অন্তত আগে থেকেই থাকার একটা ব্যবস্থা করেছি। এখন খুঁজছি টিউশনি। আগেরটা তো আর নেই। এখন মেসে থাকতে হলে বেশি টাকা দরকার হবে।’
শুধু পলাশীই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে আরও কয়েকটি এলাকাতেও শিক্ষার্থীরা মেস ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেছে। আবার অনেকেই এসেছে পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে। পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও বিশ্ববিদ্যালয় এখনো এই ভর্তি কিংবা পরীক্ষা–সংক্রান্ত ফরমগুলোর অনলাইন ভার্সন তৈরি করতে পারেনি। যে কারণে পরীক্ষা দিতেই নয়, এই পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে ফরম পূরণের জন্যও শিক্ষার্থীদের আসতে হচ্ছে দূরদূরান্ত থেকে।

এই করোনার সময়ে শিক্ষার্থীদের নিশ্চিতভাবেই কোনো আত্মীয়ের বাসায় থাকা কঠিন হবে। আর সবারই যে ঢাকায় আত্মীয়স্বজন আছে, এমনও নয়। হোটেল ভাড়া করে পরীক্ষা দেওয়ার অর্থনৈতিক সংগতিও অনেকেরই নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ একাডেমিক কাউন্সিলে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়, যদিও এর আগে প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর এক মাস ক্লাস হয়ে তারপর পরীক্ষা হবে। কারণ, অনেক শিক্ষার্থীই নানা বাস্তবতায় অনলাইন শিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি। তাদের প্রতি ন্যায়বিচারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই জায়গা থেকে সরে এসে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার আগেই হঠাৎ সিদ্ধান্ত হলো পরীক্ষা হবে। তবে হল যে খোলা হবে না, সেই বিষয়ে জানিয়ে দিয়েছে প্রশাসন। বিভাগগুলোক নিজ নিজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে পরীক্ষার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর প্রায় সব ছাত্রসংগঠনই হলগুলো খুলে দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আহ্বান জানায়। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চিঠি দিয়ে হল না খোলার জন্য বলে। সরকার থেকেও সাম্প্রতিক সময়ে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসার আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলার কথা জানানো হয়। এই যে বিভিন্নমুখী সিদ্ধান্ত এবং এগুলো বাস্তবায়নের নানা অসংগতি এবং অস্পষ্টতা সমস্যায় ফেলছে শিক্ষার্থীদের।
প্রথমত, এই করোনার সময়ে শিক্ষার্থীদের নিশ্চিতভাবেই কোনো আত্মীয়ের বাসায় থাকা কঠিন হবে। আর সবারই যে ঢাকায় আত্মীয়স্বজন আছে, এমনও নয়। হোটেল ভাড়া করে পরীক্ষা দেওয়ার অর্থনৈতিক সংগতিও অনেকেরই নেই। এ ক্ষেত্রে আসলে বিভাগগুলোর সামর্থ্যও খুবই সীমিত। তা ছাড়া একেক বিভাগে শিক্ষার্থীসংখ্যা একেক রকমের। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগই রয়েছে, যেখানে একটি সেমিস্টারেই শিক্ষার্থীসংখ্যা দুই শ জনের বেশি, সেখানে বিভাগ চাইলেও তাদের থাকা–খাওয়ার বিষয়ে কিছু করতে পারবে না। আর তার সঙ্গে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টিও আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, প্রতিটি বিভাগের শিক্ষার্থীদের অনেকেই আছে যারা মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেয়। সেখানে দেখা গেছে, শেষ সেমিস্টারের পরীক্ষা নিলেই যে সে বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে, তা নয়, তাদের কারও যদি অন্য ব্যাচের সঙ্গে মানোন্নয়ন পরীক্ষা থাকে, সেই ব্যাচের পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত সেই শিক্ষার্থীর রেজাল্ট হবে না। সেখানে পুরো ব্যাচেরই রেজাল্ট আটকে যাবে। সুতরাং একটি সেমিস্টারের সঙ্গে আরেকটি সেমিস্টার জড়িত। তাই যে উদ্দেশ্যে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটির অর্জন সম্ভব হবে না বলেই মনে হচ্ছে।
তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রতি মাসেই এক একটি সেমিস্টারের পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তা করছে বর্তমানে প্রচলিত ‘দুজন পরীক্ষক/মূল্যায়নকারী’ ব্যবস্থা রেখেই। এখানে এক মাসে করোনার মধ্যেই দুই পরীক্ষকের কাছে পরীক্ষার উত্তরপত্র পাঠানো, উত্তরপত্র মূল্যায়ন এবং তা সংগ্রহ করা বাস্তবসম্মত হবে কি না, সেটিও বিবেচনার প্রয়োজন আছে।

অনেক শিক্ষার্থী নানা বাস্তবতায় অনলাইন শিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি। তারা কীভাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে? যে একটি ক্লাসেও অংশ নিতে পারেনি, তার মূল্যায়ন আমরা কীভাবে করব?

চতুর্থত: পরীক্ষা মূলত একটি মূল্যায়ন প্রক্রিয়া। শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে যা পড়ান, সেটি শিক্ষার্থীরা কতটা বুঝতে পেরেছে, সেটিই আসলে পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচাই হয়। সে ক্ষেত্রে আমাদের অনলাইন শিক্ষার উদ্দেশ্য ভিন্ন। এখনকার মূল ভাবনা হলো শিক্ষার্থীদের শিক্ষাক্রমে যুক্ত রাখা। সেখানে সিলেবাসের ৬০ শতাংশ অনেকাংশে শেষ করা যায় না এবং শ্রেণিকক্ষের মতো সেভাবে পড়ানোও যায় না। অনেক শিক্ষার্থী নানা বাস্তবতায় অনলাইন শিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি। তারা কীভাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে? যে একটি ক্লাসেও অংশ নিতে পারেনি, তার মূল্যায়ন আমরা কীভাবে করব? আমার বিভাগের কথাই যদি সামনে আনি, তাহলে দেখব প্রতি সেমিস্টারে ৬০ জন শিক্ষার্থী। সেখানে যদি এই পরীক্ষায় নানা কারণে ১০ জন উপস্থিত না হতে পারে, তাহলে সে ক্ষেত্রে তাদের পরীক্ষা কি আবার আলাদাভাবে নেওয়া হবে? নাকি তাদের সেমিস্টার ‘লস’ হবে। যদিও প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে, শতভাগ শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নিশ্চিত করেই বিভাগগুলো পরীক্ষা নেবে।
প্রশাসন থেকে আরও বলা হয়েছে যে পরীক্ষা তিন ঘণ্টার জায়গায় দেড় ঘণ্টা হবে। তবে এখানেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগে একই পরীক্ষাপদ্ধতি চলছে না। মানে কোথাও সেমিস্টার আবার কোথাও ইয়ার সিস্টেম। তাই ঠিক কার জন্য কীভাবে হবে, সেটিতেও রয়েছে নানা ধরনের অস্পষ্টতা এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনার অভাব।

এখন প্রশ্ন হলো, শারীরিকভাবে উপস্থিত হয়ে পরীক্ষা না দিয়ে কি কোনোভাবেই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন সম্ভব নয়? আমরা এই পদ্ধতির বাইরে আর অন্য কোনো সম্ভাব্য ব্যবস্থা নিয়ে ভাবছি কি না? করোনা বাস্তবতাকে বিবেচনা করেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই শিক্ষার্থী মূল্যায়ন অনলাইনে হচ্ছে (অনেক জায়গায় ৫০০০-৭০০০ শব্দের অ্যাসাইনমেন্ট, কোথাও ওপেন বুক এক্সাম, অনলাইন পরীক্ষা)। এ ক্ষেত্রে প্রথম দুটো আমরা অনায়াসেই করতে পারি। সে ক্ষেত্রে আমাদের বাধাগুলো কী কী?
বর্তমানে এই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিয়ে প্রশাসনিক দূরদর্শিতার অভাব, নানা বড়সড় অসংগতিকে সঙ্গে নিয়েই শিক্ষার্থীদের শারীরিকভাবে উপস্থিতি নিশ্চিত করে পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে অনড় আছে প্রশাসন। তবে অবস্থা বিবেচনায় মনে হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে, হুড়মুড় করে নেওয়া যেকোনো ধরনের অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের প্রধান ভুক্তভোগী হবে আমাদের শিক্ষার্থীরা। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, যে কারণে এই পরীক্ষার সিদ্ধান্ত, সেটির সফল বাস্তবায়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান কাঠামোতে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এখন ‘দু–একটি বিভাগ পারলে অন্যরা পারবে না কেন’—এই যুক্তি দিয়ে তো আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় নব্বইয়ের কাছাকাছি বিভাগ, ইনস্টিটিউটকে এক পাল্লায় তোলা যাবে না।
শিক্ষার্থীরাই আমাদের প্রধান বিবেচনা। আমরা তাদের অবশ্যই মূল্যায়ন করব, তারা যাতে চাকরি বাজারে পিছিয়ে না পড়ে, সেটি দেখাও আমাদের অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু সেই মূল্যায়ন এবং দায়িত্বের জায়গা থেকে আর কী কী পথ আমাদের হাতে আছে এবং তা অপেক্ষাকৃত সহজতর ও সম্ভবপর হয়ে উঠবে, সেটির দিকেই যাওয়াই মনে হয় এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় বিবেচনা হতে পারে।

জোবাইদা নাসরীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক । zobaidanasreen@gmail. com