শিল্পপতির ‘কইলজা পুইড়া ধোঁয়া ওড়ে’

ঋণখেলাপি, ঋণখেলাপি করে আমরা কত কথাই না বলি। কিন্তু ঋণখেলাপিদের কতজন ইচ্ছাকৃত, আর কতজন বিপাকে পড়ে, তার খোঁজ রাখি আমরা কতজন! অবশ্য এ বিষয়ে কোনো সমীক্ষা হয়নি দেশে। ফলে আমরা গড়ে সবাইকে এক কাতারে গুনতেই অভ্যস্ত। আমরা তাদের আড়চোখে দেখি, বিরূপ মন্তব্য করি। ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছেন বলে ঘেন্নাও করি। কিন্তু অবস্থার ফেরে পড়ে যাঁরা ঋণখেলাপি হন, তাঁদের প্রতি কিছুটা অবিচারই হয়। তাঁদের ট্র্যাজেডির অন্তরালে কত কাহিনি লুকিয়ে রয়েছে, তা কেই-বা জানেন।

ব্যাংকের প্যাঁচে পড়ে শিল্পকারখানা গড়ে পথে বসেছেন, এমন কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হলো। কীভাবে ব্যাংকের অসহযোগিতার কারণে মার খেয়েছেন এবং এখন অস্তিত্ব নিয়ে লড়ছেন, এমন একজন প্রকৃত শিল্পপতি দুই ঘণ্টার গল্পের উপসংহার টানলেন একটি প্রবাদ দিয়ে। সেটি হচ্ছে, ‘কইলজা পুইড়া ধোঁয়া ওড়ে, আর পাবলিক কয় রেলগাড়ি যায়!’ তিনি বলছিলেন, ‘চাকরি মানে ১০টা-৫টা অফিস, অফিস শেষ মানে চাকরিজীবীর দায়িত্বও শেষ। কিন্তু ব্যবসায় এই নিয়ম খাটে না। আমাদের কাজ বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টার।’

তার মানে কি সারাক্ষণ গায়ে-গতরে খাটতে হয়? না। তবে টেনশন ২৪ ঘণ্টারই। ফলে কাজটি সহজ নয় মোটেও।

সরকার ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের পাশে দাঁড়িয়েও যেন দাঁড়াল না। উচিত হচ্ছে প্রকৃত ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের পাশে দাঁড়ানো। ব্যাংকের একটু সহায়তার ছোঁয়া পেলেই একজন কারখানার মালিক ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটু নীতিসহায়তা পেলেই একজন প্রকৃত ব্যবসায়ী পলায়নের চিন্তা মাথায় এলেও দূরে ঠেলে রাখবেন তিনি নিজেই

এই টেনশন মাথায় নিয়েই কেউ শিল্প গড়েন, কেউ ব্যবসা করেন। মুনাফা করার জন্যই তা করেন। কিন্তু মাঝখানে অনেক বিষয় চলে আসে পরোক্ষভাবে। যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়, বেকারত্ব ঘোচে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়, অর্থনীতি চাঙা হয় এবং সর্বোপরি যে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তাঁরা শিল্প-ব্যবসা দাঁড় করান, সেই ব্যাংকও লাভবান হয়। একেকটি ব্যাংক যে বছরে ১০০, ১৫০, ২০০ এমনকি ৫০০ কোটি টাকাও লাভ করে, নিবেদিতপ্রাণ এই ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কারণেই তা সম্ভব হয়।

এই দেশে একশ্রেণির ব্যবসায়ী এবং একশ্রেণির ব্যাংকারের যোগসাজশে ব্যাংক থেকে জনগণের আমানতের অর্থ বের করে নিয়ে যাওয়ার যে উদাহরণ আছে, তা থেকে একটু পাশ ফিরে আমরা আলোচনাটা করতে চাই। ধান্দাবাজদের কথা আলাদা। আলোচ্য বিষয় প্রকৃত ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের নিয়ে। প্রকৃত ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি এক দিনে তৈরি হয় না। হুট করে শিল্পকারখানা গড়াও প্রায় অসম্ভব। আর ব্যাংকঋণ ছাড়াও শিল্প গড়া যায় না। এ জন্য প্রথমেই উদ্যোক্তাকে একটি প্রকল্প প্রস্তাব দাখিল করতে হয় ব্যাংকে। তার আগে অন্তত ৩০ শতাংশ পুঁজি নিজের থাকতে হয়। বাকি ৭০ শতাংশ ব্যাংকঋণ। নিজের অংশের সংস্থান করেই ব্যাংকে প্রস্তাব দাখিল করতে হয়।

এরপর ঘুরতে ঘুরতে বা ধরনা দিতে দিতে একপর্যায়ে ঋণ প্রস্তাব পাস হয়। ঋণের বিপরীতে জামানত থাকে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি। শুরু হয়ে যায় কর্মযজ্ঞ। কারখানা ভবন নির্মাণ, যন্ত্রপাতি আমদানি, যন্ত্রপাতি স্থাপন, আইনি কাগজপত্র তৈরি, পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ পাওয়ার চেষ্টা ইত্যাদি। গ্রাহক ঋণ পরিশোধের জন্য গ্রেস পিরিয়ড পেয়ে থাকেন ৬ থেকে ৯ মাস। ওই সময়ের সুদের বোঝা আসল হিসেবে বিবেচিত হয়। কারখানাটি যদি হয় রপ্তানিমুখী, তাহলে উৎপাদন থেকে রপ্তানি পর্যন্ত প্রকল্প ব্যয়ের ৯০ শতাংশই হয়ে যায় মোট ঋণ। এতে শিল্পোদ্যোক্তা শুরুর দিকেই বড় ধাক্কা খান।

তবে শিল্পোদ্যোক্তারা এ ধাক্কা সামলেই চলতে থাকেন। কিন্তু বিপদে পড়েন কোনো দুর্যোগ এলে। সেটি হতে পারে দেশীয় রাজনৈতিক সমস্যা বা আন্তর্জাতিক কোনো সমস্যা। কাঁচামালের দুষ্প্রাপ্যতাও একধরনের দুর্যোগ। উদ্যোক্তা যখন বিপদে পড়তে থাকেন, তখন ব্যাংক অবস্থা পাল্টে ফেলে। ঋণের কিস্তি বাবদ কারখানার মালিক যে টাকা পরিশোধ করেন, ব্যাংক তার পুরোটাই সমন্বয় করে সুদ হিসেবে। এমনকি ব্যাংক তখন চলতি মূলধন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সীমাও কমিয়ে দেয়; অনেক সময় ঋণসীমা বাতিলও করে দেয়।

ফলে ঋণের কিস্তি অনিয়মিত হয়ে পড়ে এবং শিল্পপতি তখন মূলধন ঘাটতিতে ভুগতে থাকেন। অথচ এমন দুঃসময়ে ব্যাংকই হতে পারত শিল্পোদ্যোক্তার সবচেয়ে বড় সহায়। ব্যাংকের সহযোগিতার অভাবে শিল্পোদ্যোক্তারা একপর্যায়ে খেলাপি হয়ে পড়েন। উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়, কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ঋণ পুনঃ তফসিল ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না।

জনপ্রিয় ধারণা হচ্ছে, শিল্পপতিরা ঋণ নিয়ে বিদেশে অর্থ পাচার করেন এবং বাড়ি-গাড়ি কিনে বিলাসিতা করেন। কেউ কেউ যে করেন না, তা নয়। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা খুবই কম; হতে পারে ১ থেকে ৫ শতাংশ। বাকিদের ক্ষেত্রে এ বদনাম সত্য নয়। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, ব্যাংকার ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে এক মাস ধরে কথা বলে এটাই বোঝা গেছে যে ঋণখেলাপি সংস্কৃতির জন্য সরকারি নীতি, এমনকি ব্যাংকের অসহযোগিতাও অনেকটা দায়ী। অন্যদিকে একশ্রেণির ব্যবসায়ীর সঙ্গে একশ্রেণির ব্যাংকারের যোগসাজশ তো আছেই।

ব্যাংকঋণের সুদ এখন ৯ শতাংশ। এ হারের বয়স দুই বছরও হয়নি। অনেকে বলছেন, এমনকি এ হারও উচ্চ। এত দিন শিল্পপতিরা যে ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ সুদ দিয়েই ঋণ নিয়ে আসছিলেন, কিস্তি খেলাপি হলেই সুদ বেড়ে যেত আরও ২ থেকে ৩ শতাংশ। লিজিং কোম্পানি থেকে ঋণ নিলে তো সুদ পড়ে যেত গড়ে ১৮ শতাংশের মতো।

প্রশ্ন হচ্ছে, শিল্পপতিরা তাঁদের উৎপাদিত পণ্য থেকে মুনাফা করেন কত শতাংশ? ১০ থেকে ২০ শতাংশ। একটা সময় উচ্চ হারে সুদ গুনতে গুনতে মুনাফা ছাড়িয়ে মূলধনেও টান পড়ে যায় শিল্পপতিদের। অথচ ব্যাংক ঠিকই কয়েক বছরের ব্যবধানে তার মূলধন উঠিয়ে নেয়। তারপর আছে সুদের ওপর সুদ। দেখা যায়, ১০০ টাকার ঋণে ৩০ টাকা কিস্তি দেওয়ার পরও ব্যাংকের পাওনা থাকে ১৪০ টাকা। শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে খেলাপির পথে হাঁটতে শুরু করেন।

ব্যাংকগুলো শিল্প স্থাপন ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণ দিলেও দরকারের সময় চলতি মূলধন দিতে চায় না। অথচ বিশ্বজুড়ে ব্যাংকের মূল কাজই হচ্ছে চলতি মূলধন দেওয়া। চলতি মূলধনের অভাবে দেশে অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার উদাহরণ রয়েছে। শিল্পপতিদের মতে, এখানে ডাউন পেমেন্ট হারও উচ্চ। মেয়াদোত্তীর্ণ দায়ের ওপর প্রথম দফায় ১৫ শতাংশ, দ্বিতীয় দফায় ৩০ শতাংশ এবং তৃতীয় দফায় ৫০ শতাংশ। কারখানা ঠিকভাবে পরিচালনা করা যায় না বলেই পুনঃ তফসিলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সেখানে আছে পুনঃ তফসিল করা ঋণস্থিতির ওপর ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হারে কমপ্রোমাইজড অ্যামাউন্ট জমা দেওয়ার খড়্গ।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের উদ্যোগে ২০১৯ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরে ঋণ পুনঃ তফসিল করার সুযোগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১২ সালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ৭ দশমিক ৫ শতাংশ কমপ্রোমাইজড অ্যামাউন্ট জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতার কারণে শিল্পপতিরা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। এ টাকা দিতে না পারায়ও অনেকে নতুন করে ঋণখেলাপি হয়ে যাচ্ছেন। ফলে অবস্থা দাঁড়িয়েছে ‌‘যেই লাউ সেই কদু’র মতো। সরকার ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের পাশে দাঁড়িয়েও যেন দাঁড়াল না। উচিত হচ্ছে প্রকৃত ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের পাশে দাঁড়ানো। ব্যাংকের একটু সহায়তার ছোঁয়া পেলেই একজন কারখানার মালিক ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটু নীতিসহায়তা পেলেই একজন প্রকৃত ব্যবসায়ী পলায়নের চিন্তা মাথায় এলেও দূরে ঠেলে রাখবেন তিনি নিজেই।

ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

[email protected]