শিল্পবিপ্লবের ডাক তরুণেরা শুনতে পেয়েছে, সরকার কি পাচ্ছে

ছোটবেলায় দুই প্রতারকের সেই গল্প আমরা কে না পড়েছি। প্রতারক দুজন এক রাজাকে গিয়ে বলে, এমন কাপড়ের জামা তারা বানাতে পারে, যা শুধু ‘বুদ্ধিমান’ লোকেরাই দেখতে পায়। তারপর টাকা নিয়ে তারা অদৃশ্য পোশাক রাজাকে গছিয়ে দিয়ে কেটে পড়ে। রাজ্যবাসী নিজেকে ‘বুদ্ধিমান’ প্রমাণ করতে ওই জামা দেখার ভান করে। শেষ পর্যন্ত এক শিশুর কথায় সবার বোধোদয় হয়। ওই গল্পের একটি শিক্ষা হলো, যা কিছু অদৃশ্য, তার বিনিময় মূল্য নেই। ৪ জুন রাতে ইতালির একটি ভাস্কর্য বিক্রির কথা জেনে গল্পটার কথা মনে পড়ল। অনলাইন সংবাদমাধ্যম ইয়াহু ফিন্যান্স জানিয়েছে, শিল্পী সালভাতোর গাড়ু তাঁর একটি ‘অদৃশ্য ভাস্কর্য’ মাত্র ১৫ লাখ ৩০ হাজার টাকায় (১৮ হাজার ডলার) বিক্রি করেছেন!

‘আমি (লো সোনো)’ নামের এ ভাস্কর্যকে ‘বাতাস ও আত্মা’ দিয়ে বানানো হয়েছে এবং এর কোনো ‘বস্তুগত রূপ’ নেই বলে শিল্পী জানান! কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার সূত্র অনুসারে এই দুনিয়ায় কোনো শূন্যস্থান নেই। শূন্যস্থানেও প্রতিনিয়ত বস্তু ও প্রতিবস্তু তৈরি হয়ে তা পরস্পরকে লয় করে, যা শূন্যস্থানের শক্তিকে কখনো নিঃশেষিত হতে দেয় না। শিল্পী সালভাতোর এ সত্যকে ব্যবহার করে এই ‘অদৃশ্য ভাস্কর্য’ বানিয়েছেন। মিলানের এক শিল্প সংগ্রাহক ভাস্কর্যটি কিনেছেন, ভাস্কর্যের মালিকানার একটি সনদও তিনি পেয়েছেন। বিক্রির আগে শহরের একটি ফুটপাতের দেড় বর্গমিটার আয়তনের এক স্থানে ভাস্কর্যটি ‘রেখেছিলেন’ সালভাতোর! রূপকথার লেখক হয়তো এ রকম কোনো অদৃশ্য কাপড়ের কথাই কল্পনা করেছিলেন!

এই যে ডিজিটাল পণ্য, সেবা বা সম্পদের নতুন রূপ, তা সম্ভব হয়েছে এক নতুন বিপ্লবের কারণে। এ বিপ্লবের নাম চতুর্থ শিল্পবিপ্লব

বিশ্বজুড়ে এ রকম নানা কিছু ঘটতে শুরু করেছে কয়েক বছর যাবৎ, যা কিনা সাধারণ বোধবুদ্ধিতে ব্যাখ্যা করা মুশকিল। টুইটারের সহপ্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটিতে প্রথম যে টুইটটি (Just setting up my twttr) করেন, সম্প্রতি এক ভদ্রলোক সেটি ২১ কোটি টাকায় কিনে নিয়েছেন! কিন্তু এই টুইট কেবল টুইটারে এবং জ্যাক ডরসির প্রোফাইলেই দেখা যাবে। তাহলে ২১ কোটি টাকায় যিনি কিনলেন, তিনি কীভাবে এর মালিকানা পাবেন? তিনি পেয়েছেন একটি ‘টোকেন’, যাকে বলা হয় নন-ফাঞ্জিবল টোকেন বা এনএফটি। এই সনদে ক্রেতাকে ওই টুইটের মালিকানা দেওয়া হয়েছে। এটিই ডিজিটাল অ্যাসেটের নতুন ধরনের বেচাকেনা। এ ধরনের ডিজিটাল শিল্প কিংবা সম্পদ বেচাকেনায় সহায়তা করার জন্য এরই মধ্যে বেশ কিছু নিলাম/মার্কেট প্লেস গড়ে উঠেছে। সেখানে নিয়মিত বেচাকেনাও হচ্ছে!

এই যে ডিজিটাল পণ্য, সেবা বা সম্পদের নতুন রূপ, তা সম্ভব হয়েছে এক নতুন বিপ্লবের কারণে। এ বিপ্লবের নাম চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। ডিজিটাল প্রযুক্তি যখন শিল্প–সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার মধ্যে ঢুকে পড়ে, তখনই এই বিপ্লব দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এই বিপ্লবের প্রভাব বোঝার জন্য এ উক্তিই যথেষ্ট, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্যাক্সি কোম্পানির (উবার) নিজের কোনো ট্যাক্সি নেই, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিডিয়া (ফেসবুক) নিজে কোনো কনটেন্ট তৈরি করে না, পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাইকারের (আলিবাবা) কোনো গুদাম নেই এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় আবাসন প্রোভাইডারের (এয়ারবিএনবি) নিজেদের কোনো রিয়েল এস্টেট নেই।’ এ বিপ্লবের প্রভাবে জীবনমানের পাশাপাশি সংস্কৃতির পরিবর্তনও লক্ষণীয়। বাংলাদেশেও আমরা নারীদের দেখি অবলীলায় পাঠাও বা উবারের রাইডারের পেছনে উঠে গন্তব্যে নেমে পড়ছেন। ওই রাইডারের সঙ্গে তাঁর কোনো পূর্বপরিচয় নেই! মাত্র এক দশক আগেও এমনটি আমাদের কল্পনারও বাইরে ছিল।

এভাবে তারুণ্য এক নতুন জগৎও গড়ে তুলছে, যেখানে আমাদের পুরোনো চিন্তার ‘বেইল’ নেই। এদেরই একটা অংশ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের পণ্য বা সেবার ‘দোকান’ খুলে বসেছে। তাদের কিন্তু কোনো ফিজিক্যাল শোরুম নেই। ফেসবুকের ওই ভার্চ্যুয়াল দোকানেই তারা তাদের জামাকাপড় সাজিয়ে রাখে। নিজেরা অথবা অন্য কেউ ফেসবুকে বা ইউটিউবে হাজির হয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ওই জামা পরার পর কেমন দেখায়! কাস্টমারও ওই ছবি বা ভিডিও দেখে অর্ডার দিচ্ছে, বিকাশে দাম পরিশোধ করছে এবং ই-কুরিয়ারের ডেলিভারিম্যান এসে তার জামা দিয়ে যাচ্ছে।

ক্রেতা-বিক্রেতার সরাসরি সাক্ষাৎ তো নয়, এমনকি টেলিফোনেও হয়তো কথা হচ্ছে না। কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে অর্থনীতি। হচ্ছে বাস্তব লেনদেন। এ উদ্যোগ এখন ছড়িয়ে পড়েছে খাবার, মনিহারি, স্টেশনারিসহ নানাবিধ পণ্য ও সেবায়। অনেক ‘হোম মেড’ খাবারের দোকানও এখন ফেসবুকে চালু হয়েছে। এ উদ্যোক্তারা তাঁদের ব্যবসার সবটুকু ঘরে বসে করতে পারেন। একটি স্মার্টফোন থাকলেই তাঁরা ব্যাংক হিসাব, বিকাশের হিসাব খুলতে পারেন। সেখানে নিজেদের বিল নিতে পারেন। সেটা দিয়ে পেমেন্টের মাধ্যমে তৈরি করে নিতে পারেন নিজেদের উদ্যোগের জন্য একটি ওয়েবসাইটসহ সামাজিক মাধ্যমের জন্য নানা কিছু।

কিন্তু এসব উদ্যোগের একটি আইনি বৈধতা সহজে দিতে পারেন না তাঁরা। কারণ, ট্রেড লাইসেন্স করতে হলে তাঁদের দিতে হয় একটি অফিস ভাড়ার চুক্তিপত্র এবং দেখাতে হয় একটি ‘বাস্তব অফিস’। যাঁদের এটি নেই (বেশির ভাগ এফ-কমার্সধারীই তাই), তাঁদের ট্রেড লাইসেন্স করার জন্য একটি ‘মিথ্যা ভাড়া দলিল’ বানাতে হয়! এই ২০২১ সালে! তারপর তাঁদের হয় সিটি করপোরেশনের অফিসে অফিসে ঘুরতে হয় অথবা দালালের শরণাপন্ন হতে হয়! অথচ ডিজিটাল উদ্যোগের ক্ষেত্রে যদি ঘরভাড়ার শর্ত তুলে দিয়ে ট্রেড লাইসেন্স করা ও নবায়নের কাজটি সম্পূর্ণ অনলাইনে করার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে শুরু থেকেই এই উদ্যোক্তারা তাঁদের উদ্যোগের আইনি দিকটি সেরে রাখতেন। পরবর্তী দিনগুলোয় সরকারের প্রণোদনাসহ নানাবিধ সুযোগও তাঁরা পেতেন। সরকারও সামান্য রাজস্বের পাশাপাশি তরুণদের কর্মসংস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেত।

কয়েক বছর ধরে বাজেটের সময় আমি খুব আশা করি তরুণদের পথের এ রকম ছোটখাটো বাধাগুলো দূর হবে। কিন্তু প্রতীক্ষার প্রহর কেবল বাড়তে থাকে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ডাকে সাড়া দিতে শুরু করেছে আমাদের তারুণ্য।

কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কি সেই ডাক শুনতে পান?

মুনির হাসানপ্রথম আলোর যুব কার্যক্রম ও অনুষ্ঠানপ্রধান