শিশু সুরক্ষার মূল বিষয়গুলো বাস্তব বা অনলাইনে একই

প্রযুক্তির ওপর জোর না দিয়ে ইন্টারনেট যে প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করা হয়, তা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ
ছবি: প্রথম আলো

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একটি প্রতিবেদন (মার্চ, ২০২১) অনুযায়ী, কোভিড-১৯ মহামারির সময় ৩০ শতাংশ শিশু অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির সম্মুখীন হয়েছে। পাঁচটি জেলায় (ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কক্সবাজার ও খুলনা) জরিপের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি। হয়রানির শিকার হওয়া শিশুদের মধ্যে ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ মেয়ে। ৪১ শতাংশ শিশু তাদের মা-বাবাকে বিষয়টি জানিয়েছে এবং ১২ শতাংশ তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলেনি। মাত্র ৬ শতাংশ ক্ষেত্রে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালের শুরুতে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জরিপ থেকে জানা যায়, ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ মেয়েশিশু অনলাইনে হয়রানির সম্মুখীন হয়েছিল। কিন্তু ২০২১ সালে এই সংখ্যা চার গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী শিশুরা মহামারির সময় অনলাইনে অতিরিক্ত সময় কাটাচ্ছে, যা তৈরি করেছে নানা ধরনের উদ্বেগ।

শিশুরা শিক্ষা, যোগাযোগ ও বিনোদনের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এর অনেক ইতিবাচক দিক আছে, তবে নতুন ধরনের শিশু সুরক্ষা ঝুঁকিও দেখা দিয়েছে। অনলাইন জগতে নানাভাবে শিশুদের ক্ষতি হতে পারে। এর একটি হলো শিশু যৌন নির্যাতনের ছবি/ভিডিও উৎপাদন, বিতরণ ও ব্যবহার। অনলাইনে ‘গ্রুমিং’ আরেকটি গুরুতর বিষয়, যেখানে একজন নির্যাতনকারী শিশুদের আস্থা অর্জন করার পর তাদের ক্ষতি করে। প্রাপ্তবয়স্কদের পর্নোগ্রাফি ইন্টারনেটে প্রচুর পরিমাণে আছে, যা শিশুরা দেখতে পারে। এ ছাড়া এখানে জঙ্গিবাদ, মাদক, আত্মহত্যাসহ বিভিন্ন নেতিবাচক বিষয়ে তথ্য তারা পেয়ে যায়। অনলাইনে চ্যাট রুম, মেসেজ বোর্ড, গেমস ইত্যাদির কারণে শিশুরা একত্র হয়। এর ফলে নির্যাতনকারীরা তুলনামূলকভাবে সহজেই শিশুদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পায়। অসংখ্য শিশু সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে।

অন্য যেকোনো স্থানের চেয়ে পরিবারের মধ্যে শিশুদের নির্যাতিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। পরিবারের কেউ শিশুকে যৌন নির্যাতন করতে চাইলে অনলাইনের মাধ্যমে তারা শিশুটির কাছে আসার অতিরিক্ত সুযোগ পায়। এর পাশাপাশি ইন্টারনেট অপরিচিত ব্যক্তিদের এমন শিশুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সাহায্য করে, যাদের সঙ্গে অন্য কোনোভাবে তাদের পরিচয় হতো না।

অনলাইনের ক্রিয়াকলাপ বাস্তব জীবনের প্রতিফলন। কেবল প্রযুক্তির ওপর জোর না দিয়ে ইন্টারনেট যে প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করা হয়, তা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। যদি শিশুরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে কঠিন পরিস্থিতিতে বাস করে, ইতিমধ্যে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে, একাকিত্ব বা আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগে এবং মা-বাবা এবং অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্নতা বোধ করে, তবে তাদের অনলাইনে ঝুঁকির আশঙ্কা বেশি। এ ধরনের শিশুরা নির্যাতনকারীদের সহজে বিশ্বাস করে বিপদে পড়ে।

আমাদের সমাজে অনেক মা-বাবা শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে উদ্বিগ্ন। বেশির ভাগ মনে করেন যে তাঁরা এ বিষয়ে যথেষ্ট জানেন না এবং সন্তানদের কোনো সহায়তা করতে অপারগ। আসলে অনলাইনে শিশুদের নিরাপদ রাখতে উপযুক্ত নির্দেশনা দেওয়ার জন্য মা-বাবার প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক। মা-বাবা যদি সন্তানদের সঙ্গে মনোযোগ দিয়ে সময় কাটান, সক্রিয়ভাবে তাদের কথা শোনেন এবং আগ্রহের বিষয়, পছন্দ-অপছন্দ, বন্ধুবান্ধব ইত্যাদিসহ তাদের জীবন সম্পর্কে জানেন, তবে তাঁরা বাস্তব জগৎ এবং অনলাইনের জন্য সঠিক নির্দেশনা ও সহায়তা দিতে সক্ষম হবেন।

প্রতিটি শিশুই আলাদা—তাদের সক্ষমতা ও ঝুঁকিও ভিন্ন ধরনের হয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন এবং নিজেদের রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে পারে, কিন্তু কারও কারও পক্ষে তা সম্ভব নয়। নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে কীভাবে ইন্টারনেট ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করা যায়, সে বিষয়ে শিশুদের সচেতনতা বাড়াতে মা-বাবা ও শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে।

অস্ট্রেলীয় ই-সেফটি কমিশনার সুনির্দিষ্ট কিছু পরামর্শ দিয়েছেন, যা সব দেশের মা-বাবার জন্য প্রযোজ্য। এর মধ্যে আছে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে নিজেদের মধ্যে একটি মুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক তৈরি করা; অনলাইনে কোনো কিছু দেখা বা খেলার সময় শিশুদের সঙ্গে অংশ নেওয়া; সন্তানদের ডিজিটাল জগৎ সম্পর্কে শিক্ষিত করা; সন্তানদের সামাজিক এবং আবেগপ্রবণ দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করা; সন্তানকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলা; ডিভাইসগুলো ঘরের উন্মুক্ত স্থানে ব্যবহার করতে শিশুদের বলা; অনলাইন ও বাস্তব জগতের ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া; সন্তান কী কী অ্যাপস, গেমস ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছে সে সম্পর্কে জানা; গোপনীয়তা (প্রাইভেসি) সেটিংসের বিষয়ে নজর রাখা; ডিভাইসগুলোয় মা-বাবার নিয়ন্ত্রণ কাজে লাগানো; সন্তানের মধ্যে যেকোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা।

বাংলাদেশের আইনে অনলাইন যৌন হয়রানি এবং পেডোফিলিয়া (শিশুদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে স্থাপনে প্রবণতা) নিয়ে স্পষ্টতার অভাব আছে। উদাহরণস্বরূপ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এ পেডোফিলিয়া সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট বিধান নেই। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২-এ শিশুদের পর্নোগ্রাফিতে ব্যবহার করা অন্তর্ভুক্ত। তবে যেসব ক্ষেত্রে অপরাধী ও ভুক্তভোগী—উভয়ই শিশু, সে ক্ষেত্রে কোনো নির্দেশনা নেই।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব অনলাইনে শিশু সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় আইন ও নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি সেগুলোর বাস্তবায়ন এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সবার জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ। সাইবার অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অধীনে অনলাইন শিশু হয়রানি মামলার বিচার করা উচিত। অনলাইনে শিশু সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রাসঙ্গিক আইনগুলোর সমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন—এর মধ্যে আছে শিশু আইন ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৮), তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩); ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এবং পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২।

ইন্টারনেট সেবা সরবরাহকারী, মোবাইল ফোন কোম্পানিসহ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে পণ্য তৈরি এবং সেবাদানের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়ে শিশুদের সুরক্ষা বিবেচনা করতে হবে। ডিজিটাল প্রমাণ সংগ্রহের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা উচিত। তাঁদের শিশু-সংবেদনশীল হতে হবে।

গোপনীয়তা, তথ্য পাওয়া, মতামত প্রকাশ, একত্র হওয়া-সংক্রান্ত শিশুদের অধিকার বাস্তবায়নের সময় যাতে তারা অনলাইনে সুরক্ষিত থাকে, সে জন্য একধরনের ভারসাম্য প্রয়োজন। ইন্টারনেট ব্যবহার শিশুদের জন্য যাতে একটি ইতিবাচক অভিজ্ঞতা হয় এবং তাদের পরিপূর্ণ বিকাশে ভূমিকা রাখে, তা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব।

লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী