শিশুদের মানবাধিকার কারও চেয়ে কম নয়

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯’ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৮৯ শতাংশ শিশু জরিপ-পূর্ববর্তী এক মাসের মধ্যে শারীরিক শাস্তির শিকার হয়েছে। জরিপে আরও দেখা যায়, ৩৫ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন শিশুকে শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করতে ২০১১ সালে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তারপরও শিশুরা শিক্ষকদের দ্বারা মারধর ও অপমানের শিকার হচ্ছে। তা ছাড়া বাড়ি, প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রেও শিশুদের শাস্তি দেওয়া হয়।

শারীরিক শাস্তি বলতে এমন শাস্তিকে বোঝায়, যেখানে কোনো না কোনো মাত্রার ব্যথা বা অস্বস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে শারীরিক বলপ্রয়োগ করা হয়। নিষ্ঠুর ও অবমাননাকর আচরণ এ ধরনের শাস্তির অন্তর্ভুক্ত।

শাস্তি শিশুর মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে এবং নিঃসন্দেহে শিশু অধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘন। ২০১৩ সালে গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ টু অ্যান্ড অল করপোরাল পানিশমেন্ট অব চিলড্রেন ১৫০টির বেশি গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে শারীরিক শাস্তির ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে। শাস্তি স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে শিশুর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামগ্রিক বিকাশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে শিশুদের মধ্যে আগ্রাসী মনোভাব বেড়ে যায়। মা-বাবা এবং শিক্ষকদের শিশুরা সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে। তারা যখন শাস্তি দেয়, তখন শিশুরা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে নির্যাতনকে স্বাভাবিক মনে করে, মেনে নিতে শেখে। শাস্তি পাওয়া শিশুরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরে নিজেরাও নির্যাতন করবে অথবা নির্যাতনের শিকার হবে—এমন আশঙ্কা বেড়ে যায়। আমরা যদি শিশুদের শাস্তি দেওয়া বন্ধ না করি, তাহলে সমাজে সহিংসতার চক্র ভাঙা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

বড়রা যখন শিশুদের কিছু শেখানোর নামে মারধর অথবা বকাবকি করেন, তখন শিশুরা শুধু শাস্তি এড়ানোর জন্যই কোনো আচরণ করতে শেখে। কিন্তু তারা এর কারণ উপলব্ধি করে না। এর ফলে পরে তারা আবার একই আচরণ করে। বোঝাই যাচ্ছে, শেখানোর কৌশল হিসেবে শাস্তি একটি অকার্যকর পদ্ধতি। গত তিন দশকের বেশি সময়ের গবেষণা এবং কাজের অভিজ্ঞতায় জানা যায়, শিশুদের সঠিকভাবে বড় করার জন্য প্রয়োজন ভালোবাসা এবং বয়স অনুযায়ী নির্দেশনা, শাস্তি নয়। এখন পর্যন্ত মাত্র ৬০টি দেশ বাড়িসহ সর্বত্র শিশুর ওপর শারীরিক নির্যাতন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এই তালিকায় নেই।

গবেষণায় দেখা যায়, শারীরিক শাস্তি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হলে এ বিষয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর ব্যাপকতা কমতে থাকে।

বাংলাদেশের শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়ার যে প্রবণতা, তা মূলত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরই বহিঃপ্রকাশ। প্রায়ই শোনা যায় যে মা-বাবা ও শিক্ষক কর্তৃক শাস্তি প্রদান আমাদের সমাজে বহুদিন ধরেই চলে আসছে এবং এটি এখানে সাধারণ চর্চা। অনেকে এমনও দাবি করেন, তাঁরা আজ যে অবস্থানে আছেন, শাস্তি না দিলে তাঁরা সে জায়গায় আসতে পারতেন না! মা-বাবা তাঁদের মারধর না করলে তাঁরা কেমন মানুষ হয়ে বেড়ে উঠতেন, সেটা কিন্তু কেউ জানে না। অনেকে শাস্তির কারণে কষ্ট পাওয়ার বিষয়টি বড় হয়ে অস্বীকার করেন। আগে প্রচলিত ছিল বলেই আমরা কোনো আচরণ অব্যাহত রাখব, তা তো হতে পারে না, বিশেষত যখন জানি যে সেটা শিশুদের জন্য ক্ষতিকর।

গবেষণায় দেখা যায়, শারীরিক শাস্তি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হলে এ বিষয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর ব্যাপকতা কমতে থাকে। সুইডেন এর একটি উদাহরণ। ১৯৭৯ সালে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে শিশুদের সব ধরনের শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে সুইডেন। নতুন আইন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশটিতে বড় আকারের গণশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। তা ছাড়া মা-বাবারা শিশু ও প্রসূতি ক্লিনিকগুলো থেকেও সহায়তা ও তথ্য পান। নিষিদ্ধ করার পর থেকে বয়স্কদের মধ্যে শারীরিক শাস্তির অনুমোদন ও ব্যবহার ধারাবাহিকভাবে কমে আসে। ১৯৭০-এর দশকে দেশটির প্রায় অর্ধেক শিশু নিয়মিত মারধরের শিকার হতো, যা কিনা ১৯৮০-এর দশকে এক-তৃতীয়াংশে এবং ২০০০ সালের পর মাত্র কয়েক শতাংশে নেমে এসেছে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৬.২ নম্বর লক্ষ্যে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশু নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জনে শারীরিক শাস্তির অবসান ঘটানো আবশ্যক। বাংলাদেশে শিশুদের শাস্তি বন্ধে কিছু সুপারিশ:

১. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধকরণে সরকার যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, তার বাস্তবায়ন ও যথাযথ তদারক করতে হবে। সব ক্ষেত্রে (বাড়ি, বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র, বিকল্প শিশু পরিচর্যাকেন্দ্রসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) শিশুদের শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। পাশাপাশি নীতিমালা, কর্মসূচি ও জনসচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে আইনি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা এবং এর বাস্তবায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।

২. শাস্তি না দিয়ে ইতিবাচকভাবে শিশুদের বড় করা ও শিক্ষা প্রদান সম্পর্কে মা-বাবা এবং শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। পরিবার ও শিশুদের নিয়ে বা তাদের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সেবা খাতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলোতে এ-সংক্রান্ত তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

৩. শিশুদের মতামতকে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে এবং শাস্তি বন্ধের প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে শিশুদের কথা শোনা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

শিশুরা বয়সে ছোট, কিন্তু তাদের মানবাধিকার কারও চেয়ে কম নয়। আসুন, সব ক্ষেত্রে শিশুদের শারীরিক শাস্তি আইন করে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি একে সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য করে তুলি। শিশুদের পরিপূর্ণ মানুষের মর্যাদা দিতে শিখি।


লায়লা খন্দকার: উন্নয়নকর্মী