শিশুরা কি শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ পাচ্ছে?

ধরা যাক, এমন একটি ছোটদের স্কুল রয়েছে, যেখানে আবদ্ধ কোনো দেয়াল নেই, সুনির্দিষ্ট কোনো বাঁধাধরা শ্রেণিকক্ষ নেই কিংবা পুরো জায়গাই শ্রেণিকক্ষ। আছে খেলাধুলা করার পর্যাপ্ত জায়গা। আছে খেলার ছলে শিশুদের গাছে ওঠার সুব্যবস্থা। আছে পর্যাপ্ত আলো। তবে শিশুদের কৌতূহল মেটানোর জন্য কিছু জায়গা আবার অন্ধকার করে রাখা হয়েছে। ছাদের উচ্চতা কোনো কোনো জায়গায় এতটাই কম, যেন খুব সহজেই স্পাইডারম্যানের মতো যে-কেউ লাফিয়ে উঠতে পারে যেকোনো সময়। স্কুলটিতে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। তাতে কী? সেই অনিয়মের মধ্যেই শিশুরা শিখছে। ক্লাস সাজাচ্ছে নিজেদের মতো করে। ভালো না লাগলে বাইরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু স্কুলটি নকশায় গোলাকার হওয়ায় ঘুরতে ঘুরতে শিশুরা ঠিক আগের জায়গায় চলে আসছে। এমনই একটি স্কুল গড়ে উঠেছে জাপানের রাজধানী টোকিওতে।
স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় জাপানি স্থপতি তাকাহারু তেঁজুকা শিশুদের জন্য এই স্কুলের নকশা করেছেন। এখানে একটি শিশু মাত্র ২০ মিনিটে গড়ে প্রায় চার হাজার মিটার হাঁটাহাঁটি করতে পারে। আর এভাবেই একটি সম্পূরক স্থাপনা গড়ে দিতে পারে শিশুদের ভবিষ্যৎ অভ্যাস, রীতিনীতি; শেখাতে পারে আন্তরিকতা আর তৈরি করতে পারে নিজেদের মধ্যে সহমর্মিতা।
এবার চোখ ফেরানো যাক আমাদের দেশের প্রচলিত স্কুলগুলোর দিকে। সামনে লম্বা বারান্দা, তার পাশ দিয়ে সারি সারি শ্রেণিকক্ষ সুউচ্চ দেয়াল দিয়ে একটি থেকে আরেকটি আলাদা করা। নেই কোনো আন্তসংযোগ। শ্রেণিকক্ষের মধ্যে সারি সারি বেঞ্চ, যেখানে সাধারণত ভালো ছাত্রছাত্রীরা সামনের সারিতে আর তথাকথিত খারাপ ছাত্রছাত্রীদের অবস্থান পেছনের সারিতে। আর এভাবেই নিজেদের অজান্তেই তৈরি হচ্ছে নিজেদের মধ্যে অদৃশ্য দেয়াল। আলাদা করে ফেলছে একে অন্যকে, যার প্রভাব হয়তো পড়ছে পরবর্তী সময়ে আমাদের সমাজেই। একপাশে জানালা, অপর্যাপ্ত আলো আর সেই আলো পুষিয়ে নেওয়ার জন্য দিনের বেলায় জ্বালানো হচ্ছে কৃত্রিম আলো, ক্লাস চলাকালীন বারান্দা থেকে বাইরের ধুলাবালু কক্ষের মধ্যে প্রবেশ কিংবা ব্ল্যাকবোর্ডে ব্যবহার করা চকের গুঁড়া ঢুকে পড়ছে নাকেমুখে, হাঁচি উঠছে সবার একসঙ্গে। একটু ক্লাস করেই হাই তুলছে বড় করে। অথচ সামনে সুবিশাল একটি মাঠ অযথাই পড়ে আছে কোনো সামাজিকীকরণের উপাদান ছাড়াই। পড়া দেওয়া, পড়া ধরা, মুখস্থ করা, পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়াই হয়ে উঠছে সবার কাছে একমাত্র মুখ্য। এ যেন সবকিছু মিলিয়ে একটি জেলখানা।
মনে পড়ে, ছোটবেলায় যখন স্কুলে যেতাম, মাঝেমধ্যে সামান্য হাওয়া খাওয়ার জন্য লুকিয়ে ক্লাসের সামনের সুদীর্ঘ বারান্দায় আসতাম আর ভয়ে থাকতাম এই বুঝি কোনো শিক্ষক দেখে ফেলেন। কোনো শিক্ষককে বারান্দার ওপর প্রান্ত থেকে আসতে দেখলেই দৌড়ে সোজা ক্লাসের মধ্যে। আর মাঝেমধ্যে এটিই হয়ে উঠত একমাত্র খেলা। যদিও সামনের সুবিশাল মাঠটি চুপচাপ পড়ে থাকত।
পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি শিশুর সুষ্ঠু মনন বিকাশে তার চারপাশের পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যার অভাব পরবর্তী সময়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য ও মূল্যবোধ অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে গণ্য। তথাপি বর্তমানে একদিকে যেমন আমরা সৃজনশীলতার নামে শিশুদের কাঁধে দিনকে দিন বইয়ের বোঝা বাড়িয়েই চলেছি, অন্যদিকে তাদের জন্য আনন্দময় ও পরিবেশবান্ধব স্বাস্থ্যসম্মত শিক্ষার পরিবেশ ঠিক সেভাবে তৈরি করতে পারছি না। দেশে বর্তমানে শিশুশিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও নকশা নিয়ে অনেক গবেষণা হলেও তা রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না। অন্য কথায় বলা যায়, সঠিক পন্থায় সেগুলো কাজে লাগাতে পারছি না।
শিক্ষার জন্য আমাদের জাতীয় বাজেটে মোটা অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে প্রতিবছর, নতুন বই পাচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। কিন্তু শিশুরা শিক্ষার সুষ্ঠু সৃজনশীল পরিবেশ পাচ্ছে না। আমাদের ভাবতে হবে, একজন শিশুকে যে স্কুলঘরটিতে দিনের এক-তৃতীয়াংশ সময় পার করতে হয়, সেটি কতটা পরিবেশবান্ধব অথবা স্বাস্থ্যঝুঁকিহীন। কারণ, আমরা অনেকেই ছেলেমেয়েদের এয়ারকন্ডিশনার-যুক্ত শ্রেণিকক্ষে পাঠিয়ে ভেবে থাকি শিশুটি নিরাপদ আছে, বাইরের জীবাণু থেকে মুক্ত আছে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, বিষয়টি মোটেও সে রকম নয়। অনেক সময় ঠিক এর উল্টো। বদ্ধ ঘরে অনেক জীবাণুর সংক্রমণ হতে পারে এবং খুব সহজেই সেগুলো ছড়িয়ে পড়তে পারে। আমাদের দেশে শ্রেণিকক্ষের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ শিশুদের স্বাস্থ্যবান্ধব কি না, এ বিষয়ে দেখভালের জন্য সুপরিকল্পিত কোনো ব্যবস্থা (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) নেই, যার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা একান্ত প্রয়োজন বৈকি।
সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। জাপানে গবেষণারত।
[email protected]