শিশুরা শুধু ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমানও

এই সময়ের শিশুরা ভবিষ্যতে ‘কোভিড প্রজন্ম’ নামে পরিচিত হবে। তাদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, সুরক্ষা এবং সামগ্রিকভাবে ভালো থাকা এই মহামারি দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। ইউনিসেফের ‘ডিরেক্ট অ্যান্ড ইনডিরেক্ট ইফেক্টস অব দ্য কোভিড-১৯ প্যানডেমিক অ্যান্ড রেসপন্স ইন সাউথ এশিয়া’ রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যু বেড়েছে ১৩ শতাংশ। মহামারি-পরবর্তী দশকে শিশুদের জীবনে বড় ধরনের নেতিবাচক পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। কিংবা এই সময়ে শিশু অধিকার অর্জনে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হওয়া সম্ভব। এটি নির্ভর করবে আমরা এখন কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেব তার ওপর। আমরা কি শিশুদের জন্য বাসযোগ্য একটি পৃথিবী গড়ে তুলতে ইচ্ছুক? যদি তা-ই হয়, তাহলে শিশুদের অগ্রাধিকার দেওয়া এবং তাদের মূলধারার উন্নয়ন এবং আলোচনার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন।

আমরা প্রায়ই বলি ‘শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ’। শিশুর ‘বর্তমান’কে অর্থবহ করতে আমরা কী করছি? এই লেখায় শুধু নগরের পরিস্থিতির উল্লেখ করতে চাই। বাংলাদেশের নগরগুলোতে প্রাচুর্য ও দারিদ্র্য পাশাপাশি থাকে। বস্তি এলাকায় বাস করা বেশির ভাগ শিশুই উপযোগী বাসস্থান, পরিষ্কার পানি, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যসেবা ও মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। খুবই উচ্চমাত্রার বায়ু ও শব্দদূষণের শিকার হচ্ছে তারা। প্রকৃতি উপভোগের সুযোগ তাদের নেই বললেই চলে। হাসপাতাল, ক্লিনিক, গণপরিবহন, রেস্তোরাঁ, গ্যালারি, জাদুঘরসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সেবা শিশুবান্ধব নয়। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সুযোগ খুবই কম। তাই যোগাযোগ ও বিনোদনের জন্য শিশুদের প্রযুক্তির ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতা তৈরি হচ্ছে। বাড়ছে স্মার্টফোন আসক্তি; তারা আজ নিঃসঙ্গ। বিত্তবান পরিবারের শিশুরাও আবেগের দিক থেকে খুব দরিদ্র। শিশুরা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন, শোষণ ও অবহেলার শিকার। এই পরিস্থিতিতে শিশুদের বিকাশ ব্যাহত হয়, যা শিশু অধিকারের লঙ্ঘন।

যেকোনো স্থানে শিশুদের ভালো থাকা সেখানকার স্বাস্থ্যকর আবাসন, গণতান্ত্রিক সমাজ ও সুশাসনের চূড়ান্ত সূচক। একটি শিশুবান্ধব নগর হলো স্থানীয় পর্যায়ে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের বাস্তবায়ন। এ ক্ষেত্রে নগরটির নীতিমালা, আইন, কর্মপরিকল্পনা ও বাজেটে শিশুদের অধিকার থাকবে। একটি শিশুবান্ধব নগরে শিশুরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে; সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের মতামত গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়।

আলবেনিয়ার তিরানা থেকে কলম্বিয়ার বোগোটা, বিভিন্ন নগরে শিশুদের কেন্দ্র করে উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। বোগোটার সবচেয়ে দরিদ্র এলাকাগুলোর একটি সিউদাদ বলিভার। সেখানে অপরাধের হার খুব বেশি। সবুজ নেই বললেই চলে। কমিউনিটির সদস্যরা ‘আরবান ৯৫’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। এটি বার্নার্ড ভ্যান লিয়ার ফাউন্ডেশনের একটি উদ্যোগ। তিন বছর বয়সী শিশুর গড় উচ্চতা সাধারণত ৯৫ সেন্টিমিটার। এ অবস্থান থেকে দেখলে নগরের নকশায় কী পরিবর্তন আনতে হবে, সেই বিষয়টি নিয়েই ‘আরবান ৯৫’ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। সিউদাদ বলিভারে শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো শনাক্ত করে এলাকার বাসিন্দারা এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালান।

‘আরবান ৯৫’ প্রমাণ করে যে শিশুসংবেদনশীল হওয়ার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন নেই, দরকার শুধু শিশুর চোখ দিয়ে বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করা। একটি রেস্তোরাঁয় শিশুদের উপযোগী চেয়ার এবং পুষ্টিকর খাবার রাখতে কিন্তু অতিরিক্ত খরচ লাগে না। হাসপাতাল, ক্লিনিকের ওয়েটিং রুম থেকে শুরু করে স্টেশন, বিমানবন্দরে শিশুদের খেলার স্থান এবং তাদের জন্য বই, কাগজ, রংপেনসিলসহ নানা ধরনের উপকরণ থাকতে পারে। এতে তারা আনন্দের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবে, বিকাশের জন্যও তারা উদ্দীপনা পাবে। শিশুরা সেবা নিতে যায়, এমন জায়গায় টেলিভিশনে সহিংসতাপূর্ণ খবরের পরিবর্তে শিশুতোষ অনুষ্ঠান চালাতে আমাদের সদিচ্ছাই যথেষ্ট। শিশুদের উচ্চতা মনে রেখে বেসিন তৈরির ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। ইউরোপের বেশ কিছু আর্ট গ্যালারিতে দেখেছি যে নানা শিল্পকর্মের বর্ণনা শিশুদের বোধগম্য ভাষায় লিখে নিচু করে টাঙানো হয়েছে, যাতে তারা সহজে পড়তে পারে। এমন আরও উদাহরণ আছে। বিভিন্ন অবকাঠামো ও সেবা যে শুধু বয়স্করা নয়, শিশুরাও ব্যবহার করবে, এটি মনে রাখলে শিশুদের উপযোগী অনেক কিছু বিদ্যমান সামর্থ্যের মধ্যেই করা সম্ভব।

বাংলাদেশ সরকারকে শিশুবান্ধব নগর গড়ে তোলার জন্য সব খাতের সমন্বয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নগর-পরিকল্পনা, অবকাঠামো নির্মাণ, সেবাদান ও দারিদ্র্য দূরীকরণের সময় শিশুদের চাহিদা বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে। আরও প্রয়োজন শিশুদের কথা শোনা এবং তাদের সঙ্গে নিয়ে নকশা তৈরি করা; অবকাঠামোতে শিশুর নিরাপত্তাকে বিবেচনায় নেওয়া; শহরাঞ্চলে সবুজ গাছপালা ফিরিয়ে আনা এবং শিশুর খেলাধুলা ও সৃজনশীল কার্যক্রমের ওপর গুরুত্বারোপ করা; রাস্তা ও কমিউনিটিকে শিশুর জন্য নিরাপদ করা; স্থপতি এবং পরিকল্পনাবিদদের মধ্যে শিশুদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে সচেতনতা ও সংবেদনশীলতা বাড়ানো; শিশুবান্ধব নগর-পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিনিয়োগ করা।

সঠিক আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ, সেবা প্রদানকারীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিশুর সুরক্ষার সামগ্রিক সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তবে সমাজের প্রত্যেককে তার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা এবং শিশুসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সিভিল সোসাইটি এবং গণমাধ্যমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিভিন্ন বয়সের শিশুদের আলাদা চিন্তা ও অনুভূতি মা-বাবা, শিক্ষক, ডাক্তার, নার্স, পরিকল্পনাবিদ, সাংস্কৃতিক ও সমাজকর্মীদের বুঝতে হবে এবং সে অনুযায়ী তাদের সঙ্গে আচরণ করা এবং তাদের চাহিদা পূরণে উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অনেক বিষয় নিয়েই নতুন করে ভাবার সুযোগ দিয়েছে। আসুন, আমরা শিশুদের নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনি। শিশুদের ‘ভবিষ্যৎ’ বলা বন্ধ করি, তাদের কথা শুনি, তাদের স্বার্থকে বিবেচনা করি এবং একটি শিশু সংবেদনশীল সমাজ তৈরিতে নিজেদের দায়িত্ব পালন করি।

লায়লা খন্দকার লেখক উন্নয়নকর্মী