শুধু পড়ে বা ক্লাস করে নয়, দেখেও শেখা যায়

সকালে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের ক্যানটিন একটু দেরিতে খুলত। আমরা ঘুম থেকে উঠেই প্রাতরাশ সারার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিনে যেতাম। মিলনদার ক্যানটিন-হল থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্ব। ভেতরে দাঁড়ানোর জায়গা আছে। বসার জায়গা বাইরে। চেয়ার-টেবিল নেই। বাঁধানো স্থায়ী বেঞ্চ। প্রায় দিনই একই সময় হাসিমুখে এক মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক আসতেন। সাধারণ পোশাক। খোলা আকাশের নিচে বসে কথা বলছেন আরও কয়েকজনের সঙ্গে। মাঝেমধ্যে দেখতাম পত্রিকা পড়ছেন। হাতে চা, মাটির ভাঁড়ে। আমাদের একদম পাশে বসে। নিত্যদিনের ঘটনা। ভেবেছিলাম কোনো ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক হবেন। অনেক শিক্ষকই চা খেতে মিলনদার ক্যানটিনে আসতেন। হঠাৎ একদিন এক বন্ধু বলল, ‘তোর পাশে বসে যে ভদ্রলোক চা খাচ্ছিলেন তাঁকে চিনিস?’ আমি বললাম, না।’ সে বলল, ‘আমাদের ভাইস চ্যান্সেলর। অশোক নাথ বসু। নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী।’

ভারতের প্রথম পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার পরও নিয়মিত তিনি সন্ধ্যায় এবং ছুটির দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছাত্র এবং গবেষকদের সময় দিতেন। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পায়ে হেঁটে ঘুরতেন। প্রায় দুই দশক আগের ঘটনা। অশোক নাথ বসুর সঙ্গে আমার কোনো দিন কোনো কথা হয়নি। কিন্তু এখনো পরিষ্কার মনে আছে তাঁর চেহারা। কেন? কোনো প্রতিষ্ঠানের বিশেষ কেউ হয়েও সাধারণের মতো আচরণ করাটা শেখানোর জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু বই পড়ে বা ক্লাস করে নয়, দেখেও শেখা যায়।

রের কাছ থেকে শিখেছিলাম আসলে বিনয় নেতৃত্বের একটি বড় গুণ। বিনয় শুধু ক্ষেত্রবিশেষে নয়, সবখানে সবার জন্যই সমানভাবে বরাদ্দ করা উচিত।

২.
রে জোনস বিলেতে আমাদের মাস্টার্সে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখাতেন। বহু বছর কোম্পানিতে চাকরি করে পড়াতে এসেছিলেন। পাতাল রেলস্টেশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি হাঁটা দূরত্বের। প্রায় দিনই সকালে দেখতাম এক বা দুই ছাত্র রে জোনসের ছাতার নিচে স্টেশন থেকে ডিপার্টমেন্টে হেঁটে আসছে। রে একদিন আমাকে তাঁর অফিসে ডাকলেন। অফিসে ঢুকতেই, আমাকে দেখে রে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে অভ্যর্থনা জানালেন। আমি না বসা পর্যন্ত রে নিজের আসনে বসলেন না। আলাপ শেষে দরজা পর্যন্ত এসে বিদায় জানালেন।

এরপর বহুবার গিয়েছি রের অফিসে। একই রকম অভিজ্ঞতা। যতক্ষণ রে জোনসের ঘরে থাকতাম তাঁর নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ আমার দিকে থাকত। রের কাছ থেকে শিখেছিলাম আসলে বিনয় নেতৃত্বের একটি বড় গুণ। বিনয় শুধু ক্ষেত্রবিশেষে নয়, সবখানে সবার জন্যই সমানভাবে বরাদ্দ করা উচিত।

৩.
প্রফেসর রিচার্ড ওয়াইজ। ছয় ফুটের মতো লম্বা। সাদা শার্টের ওপরে সব সময় বো টাই পড়ে থাকতেন। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের কনসালট্যান্ট নিউরোলজিস্ট ছিলেন। ইম্পেরিয়াল কলেজ বিশ্বের প্রথম সারির অন্যতম একটি বিশ্ববিদ্যালয়। রিচার্ড ওয়াইজের খ্যাতি জগৎজোড়া। নেচার, ল্যানসেটের মতো জগদ্বিখ্যাত সব গবেষণা গ্রন্থে বছরে একাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশ পায়। বিজ্ঞানের ক্যারিয়ার তৈরি করতে ল্যানসেট বা নেচারে একটি গবেষণা গ্রন্থই যথেষ্ট।

মস্তিষ্কসংক্রান্ত বিভিন্ন রোগের কারণ জানা এবং নতুন ওষুধের উদ্ভাবনের কাজ কিছুটা সুগম করা রিচার্ডের গবেষণার প্রধান লক্ষ্য ছিল। অত্যাধুনিক ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হতো এসব গবেষণায়। অক্সফোর্ড কেমব্রিজ কিংস কলেজ থেকে বড় বড় গবেষকেরা রিচার্ডের বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করার জন্য আসতেন। শতকোটি টাকার বরাদ্দ এক একটি প্রজেক্টে। ব্রিটিশ সরকারের বিজ্ঞানী হিসেবে দীর্ঘদিন রিচার্ডের অধীনে কাজ করেছি।

গবেষক এবং লেখক রে ডালিয়, বিল গেটস, স্টিভ জবস, ইলন মাস্কের মতো উদ্যোগপতি এবং প্রযুক্তিবিদদের ধরন নিয়ে গবেষণা করেছেন। রে দেখতে পেয়েছেন এরা সবাই বিনয়ী এবং কর্মক্ষেত্রে অন্য সাধারণ কর্মচারীর মতোই আচরণ করেন।

এসব গবেষণার বরাদ্দ প্রক্রিয়া অত্যন্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ। সৃজনশীল, নতুন ধরনের ধারণা আর তার পেছনে শক্ত বিজ্ঞান না থাকলে এ ধরনের গবেষণা প্রকল্পের বরাদ্দ মেলে না। অধিকাংশই মাল্টিডিসিপ্লিনারি-বিজ্ঞানের নানা শাখার মিলন। নিউরোলজি, গণিত, পরিসংখ্যান, শরীর তত্ত্ব, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন থেকে শুরু করে কম্পিউটারের মডেলিং। সমন্বিতভাবে বিজ্ঞানের একাধিক শাখাকে ব্যবহার করে কোনো সমস্যার সমাধান করা জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির একটি অতি প্রয়োজনীয় স্কিল। একাধিক বিষয়ে রিচার্ডের অগাধ পাণ্ডিত্য থাকলেও বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের মতামতকে সব সময় গুরুত্ব দিতেন।

বড় বড় প্রকল্পের ধারণা যাঁর মাথা থেকে বের হচ্ছে সেই রিচার্ডকে দেখেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে প্রতিটি অ্যানালিসিসের ফলাফল পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করতে। শিশুর মতো অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে। অনেক সময় গবেষণালব্ধ ফলাফল রিচার্ডের ধারণাকে ভুল বলে প্রমাণিত করত। অনায়াসেই নিজের ধারণাকে শুধরে নিতেন।
সফল বিজ্ঞানী, শিল্পোদ্যোক্তা বা উদ্ভাবক, কি অন্যদের থেকে আলাদাভাবে কাজ করেন? এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। গবেষক এবং লেখক রে ডালিয়, বিল গেটস, স্টিভ জবস, ইলন মাস্কের মতো উদ্যোগপতি এবং প্রযুক্তিবিদদের ধরন নিয়ে গবেষণা করেছেন। রে দেখতে পেয়েছেন এরা সবাই বিনয়ী এবং কর্মক্ষেত্রে অন্য সাধারণ কর্মচারীর মতোই আচরণ করেন। সফল ব্যক্তিদের কাজের ধরনে কিছুটা বৈপরীত্য চোখে পড়ে। যেমন অনায়াসে এঁরা সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যতের ছবি আঁকতে পারেন। নতুন কোনো পণ্য, সেবা বা গবেষণার ধারণা কল্পনা করতে পারেন। সেই সঙ্গে অত্যন্ত খুঁটিনাটি বিষয়েও এঁদের তীক্ষ্ণ নজর থাকে। একই সঙ্গে এঁরা কল্পনাপ্রবণ এবং বাস্তববাদী।

আমেরিকার লেখক মেহালী সিকজেন্টমেহালায় ৯১ জন উদ্যোক্তা এবং নোবেলজয়ীদের নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন কর্মক্ষেত্রে তাঁরা সবাইকে নিয়ে কাজ করেন। অন্যের মতামতকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন।

প্রযুক্তিবিদ ইলন মাস্কের কথাই ধরুন। ভবিষ্যতে অন্য গ্রহে বসতি বানানোর স্বপ্ন দেখছেন। মহাশূন্য প্রযুক্তিতে প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করেছেন। একাধিকবার ব্যবহার করা যায় এমন রকেট বানিয়েছেন। একই সঙ্গে নিজের পরিবেশবান্ধব টেসলা গাড়ি তৈরির কারখানায় অনেক ছোটখাটো কাজও তিনি তদারকি করেন।

রে বলছেন, ‘সফল ব্যক্তিরা কখনো কখনো অন্যের ধারণাকে সাদরে গ্রহণ করেন আবার কখনো নিজের ইচ্ছাকে এঁরা প্রাধান্য দেন। এঁদের অনেকের মধ্যেই দ্বৈত সত্তা আছে। যেটি সচরাচর অন্যদের মধ্যে দেখা যায় না। যেমন ধরুন, এঁরা একই সঙ্গে সৃজনশীল এবং শৃঙ্খলাপরায়ণ। সাধারণত সৃজনশীল লোকেরা শৃঙ্খলাবদ্ধ নাও হতে পারে।’

অ্যাপলের কর্ণধার স্টিভ জবসের কথাই ধরুন। ম্যাকবুক এবং আইফোন তৈরির জন্য অন্য কোম্পানির বিশেষজ্ঞদের ভাগিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। অনেক সময় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ শোনেননি, নিজের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের বারণ সত্ত্বেও পণ্যের প্যাকেজিংকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন।

আমেরিকার লেখক মেহালী সিকজেন্টমেহালায় ৯১ জন উদ্যোক্তা এবং নোবেলজয়ীদের নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন কর্মক্ষেত্রে তাঁরা সবাইকে নিয়ে কাজ করেন। অন্যের মতামতকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। এঁরা সব সময় অত্যন্ত প্রতিযোগিতাপ্রবণ নন। অন্যদের কাছ থেকে জানতে এঁরা অত্যন্ত আগ্রহী। অজানা বিষয়গুলো নিয়ে তাঁরা সব সময়ই বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেন, তাঁদের কাছ থেকে জানতে চান। অনায়াসে এঁরা বিভিন্ন বিষয়ের সংযোগ ঘটান। যেমন ধরুন, ইলন মাস্ক। আদতে ছিলেন সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞ। বানাতে শুরু করলেন গাড়ি আর রকেট, যা কিনা সাধারণ গাড়ি আর রকেটের থেকে অনেক বেশি সফটওয়্যারনির্ভর।

ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট
[email protected]