শুভ নববর্ষে প্রীতির কথা বলি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে চারুকলা অনুষদ থেকে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। শাহবাগ, ঢাকা, ১৪ এপ্রিল। ছবি: সাজিদ হোসেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে চারুকলা অনুষদ থেকে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। শাহবাগ, ঢাকা, ১৪ এপ্রিল। ছবি: সাজিদ হোসেন

মেলা কথাটা এসেছে মিল থেকে, মিলনের উৎসবই মেলা। ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে’—রবীন্দ্রনাথের এই কথা যেখানে ব্যর্থ, সেখানে মেলার মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়। উৎসবগুলো আমাদের মিলিত করে। শহর গ্রামে যায়, গ্রাম শহরে চলে আসে, ধনী আর নির্ধন একই প্রাঙ্গণে সমবেত হয়, হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি-অবাঙালি ভেদও থাকে না—যদি না থাকে, তাহলেই উৎসব সার্থক হয়।

বাংলা নববর্ষ আমাদের অন্যতম প্রধান উৎসব হয়ে উঠছে, এ বড় আনন্দেরই কথা। প্রথম আলোর খবর, ‘বৈশাখী বেচাবিক্রিতে অর্থনীতি চাঙা।’ বৈশাখ উপলক্ষে কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। গ্রামীণ কারিগরদের পণ্য বিক্রি হয়। তাঁতিরা উপকৃত হন। বাংলা সন চালু হয়েছে মোগল আমল থেকে। এটা প্রধানত ফসলি সন। কৃষকেরা বীজ বুনবেন, ধান কাটবেন, তারই সুবিধার জন্য বাংলা পঞ্জিকার উদ্ভব। বাঙালিরা যখন নববর্ষ করে, তখন পাহাড়িরাও করে থাকে উৎসব, প্রায় একই সময়ে আরও পুবের দেশগুলোতেও নববর্ষ পালিত হতে দেখা যায়। আমাদের ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখ এত রঙিন আর আড়ম্বরপূর্ণ ছিল না। হালখাতা করতেন ব্যবসায়ীরা, সেটাই ছিল প্রধান। ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকেরা বাংলা আর বাঙালি সংস্কৃতির ওপরে হামলা করতে থাকলে বাংলা নববর্ষ নতুন তাৎপর্য লাভ করে। ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে পয়লা বৈশাখের বড় ঘটনা।

বঙ্গবন্ধু কারাগারের রোজনামচায় ১৫ এপ্রিল ১৯৬৭-তে লিখেছেন, ‘আজ বাংলা বর্ষ, ১৫ এপ্রিল। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি নুরে আলম সিদ্দিকী, নুরুল ইসলাম আরও কয়েকজন রাজবন্দী কয়েকটা ফুল নিয়ে ২০ সেল ছেড়ে আমার দেওয়ানিতে হাজির। আমাকে সব কয়েকটা গোলাপ ফুল দিয়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাল।...আমি ২৬ সেল থেকে ২০ সেলে বন্দী হাজী দানেশ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, হাতেম আলি খান, সিরাজুল হোসেন খান ও মৌলানা সৈয়াদুর রহমান সাহেব, ১০ সেলে রফিক সাহেব, মিজানুর রহমান, মোল্লা জালালউদ্দিন, আবদুল মোমিন, ওবায়দুর রহমান, মহিউদ্দিন, সুলতান, সিরাজ এবং হাসপাতালে খোন্দকার মোশতাক আহমদকে ফুল পাঠালাম শুভেচ্ছা জানিয়ে।...জেলের ভেতরে ছোট ছোট জেল, কারও সঙ্গে কারও দেখা হয় না—বিশেষ করে রাজনৈতিক বন্দীদের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছে। বিকেলে পুরোনো সেলের সামনে নুরে আলম সিদ্দিকী, নুরুল ইসলাম ও হানিফ খান কম্বল বিছাইয়া এক জলসার বন্দোবস্ত করেছে। বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার, শুধাংশু বিমল দত্ত, শাহ মোয়াজ্জেমসহ আরও কয়েকজন ডিপিআর ও কয়েদি, বন্দী জমা হয়ে বসেছে। আমাকে যেতেই হবে সেখানে, আমার যাওয়ার হুকুম নাই, তবু আইন ভঙ্গ করে কিছু সময়ের জন্য বসলাম। কয়েকটা গান হলো, একজন সাধারণ কয়েদিও কয়েকটা গান করল। চমৎকার গাইল।...আমি কারাগার থেকে দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই। ১০ সেল থেকে মিজানুর রহমান চৌধুরী আমাকে শুভেচ্ছা জানাইয়া এক টুকরা কাগজে নিম্নলিখিত কবিতাটি লিখে পাঠায়, আজিকে নতুন প্রভাতে নতুন বরষের আগমনে মুজিব ভাইকে—

‘বন্ধু হও শত্রু হও যেখানে যে কেউ রও

ক্ষমা করো আজিকার মত

পুরাতন বরষের সাথে

পুরাতন অপরাধ হতে।’

(শেষের শব্দটা যত হবে, বাংলা একাডেমিকে অনুরোধ করছি, এই ছোট ছাপার ভুলটা ঠিক করে নিতে)।

এটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা—

নিশি অবসানপ্রায়, ওই পুরাতন

          বর্ষ হয় গত!

আমি আজি ধূলিতলে এ জীর্ণ জীবন

          করিলাম নত।

বন্ধু হও, শত্রু হও,        যেখানে যে কেহ রও,  

      ক্ষমা করো আজিকার মতো     

          পুরাতন বরষের সাথে

          পুরাতন অপরাধ যত। (নববর্ষে/ চিত্রা)

পয়লা বৈশাখে যেটা খুব ভালো লাগে, নারী-পুরুষ সুন্দর করে সেজেগুজে ঘর থেকে বের হয়। এক ধানমন্ডি লেকের ধারে কত যে অনুষ্ঠান হয়! আমাদের পোশাক কারখানার কর্মীরা পর্যন্ত এই ছুটির দিনটায় খুব সুন্দর শাড়ি পরে মাথায় ফুল গুঁজে হাঁটতে থাকেন। এখানে-ওখানে ছোট-বড় মেলা বসে। চুড়ি, খেলনা, মণ্ডামিঠাই—কত কিছুর পসরা। নগরে বৈশাখী মেলা কিন্তু শুরু করেছিল বিসিক। গ্রাম থেকে মেলা একদিন শহরে এসেছিল, এখন শহর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামে-গঞ্জে।

আমার মনে আছে, ছোটবেলায় রংপুর শহরের উপকণ্ঠে গিয়েছিলাম চড়কের মেলায়, সেখানে আটার তৈরি রসগোল্লা খেয়েছিলাম সস্তায়, আর বালতির পানিতে ডোবানো গ্লাসে পয়সা ফেলতে ব্যর্থ হয়ে ১০ পয়সা হেরে এসেছিলাম। আর এখন, কত নামীদামি মিষ্টির দোকান, সারা দেশের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টিও পাওয়া যায় ঢাকার দোকানে। পয়লা বৈশাখে আর একুশে ফেব্রুয়ারিতে রাস্তায় বেরোলে বুঝতে পারি, এই দেশের মানুষের কী প্রাণশক্তি। একই কথা বারবার বলি, ক্ষমা চাই সে জন্য, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের নোবেল পুরস্কার ভাষণের এই কথাটা ভুলতে পারি না, ‘মানুষের পরাজয় নেই তা এ জন্য নয় যে তার ভাষা আছে, তা এ জন্য যে তার আত্মা আছে।’ আর আমাদের কবি আবুল হাসান বলেছিলেন, ‘মারি ও মড়কে যার মৃত্যু হয় হোক, আমি মরি নাই শোনো, কেউ কোনো দিন কোনো অস্ত্রে আমার আত্মাকে দীর্ণ মারতে পারবে না।’

বাংলাদেশের মানুষের পরাজয় নেই, কারণ আমাদের আত্মা আছে। কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকেও কিন্তু এই বার্তাটা আসে। আমাদের তারুণ্যের আত্মাটা সজীব আছে। এই অপরিমেয় তারুণ্যশক্তিকে মানুষের আর দেশের কাজে লাগাতে হবে। দেশ সুন্দর হবে, পৃথিবী সুন্দর হবে, যদি আমরা মিলনের গান গাই। বিভেদের সূত্র না খুঁজে ঐক্য ও প্রীতির সূত্র খুঁজি। আর এই অপরাজেয় তারুণ্যের মনে স্বপ্ন আর কর্মস্পৃহার বীজ বুনে দিতে পারি। একটা তথ্য বেশ উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৮ সালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৮২ লাখ। আর বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার। এই হিসাবটা আসে আইএলওর সংজ্ঞা থেকে, মানে গত তিন মাসে চাকরি খুঁজেছেন ২৬ লাখ ৮০ হাজার মানুষ। (যুগান্তর, ২৮ মার্চ ২০১৮)।

২০১৭ সালে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, সরকারি পদ খালি আছে প্রায় ৩ লাখ। এর মধ্যে ৩৯ হাজারের মতো প্রথম শ্রেণির পদ খালি। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুসারে, কোটার কারণেও হাজার হাজার পদে লোক নিয়োগ দেওয়া যায়নি। এখন দেশে যদি ২৬ লাখ লোক গত তিন মাসে চাকরি খুঁজে থাকে, সবগুলো সরকারি পদ পূর্ণ করলেও মাত্র ১২ শতাংশের কর্মসংস্থান হবে। আরও ৮৮ শতাংশই সরকারি চাকরি পাবে না। সবাই সরকারি চাকরি করবে না, অনেকে বেসরকারি চাকরি করবে; আবার অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে, কৃষি-শিল্পে কাজ করবে, উদ্যোক্তা হবে। আমাদের কৃষিক্ষেত্রে, মাছ চাষে, ফল উৎপাদনে, পোলট্রি, দুগ্ধ উৎপাদনে যে বিপ্লব চলছে, তাতে এরা শরিক হবে। কারখানা গড়বে। তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের কান্ডারি হবে। প্রতিবছর প্রায় সাত লাখ লোক বিদেশে যায় কাজের সন্ধানে। এ দেশের অর্থনীতিতে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান সবচেয়ে বেশি। সরকারের কাজ হবে পথের বাধা সরিয়ে নিয়ে মানুষকে এগোতে দেওয়া, অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করা, ব্যাংক খাতে লুট বন্ধ করা, বিদেশে টাকা পাচার রোধ করা এবং প্রবাসী শ্রমিকদের সম্মান, নিরাপত্তা, মর্যাদা, দক্ষতা এবং উৎকর্ষ বিধানে পরিকল্পিত সযত্ন উদ্যোগ নেওয়া।

 আমাদের জনসংখ্যার সিংহভাগ তরুণ। এরা পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার মতো চঞ্চল। এই বিপুল প্রাণশক্তি আমাদের দেশকে এগিয়ে নেবে। আমাদের গণতন্ত্রকে পাহারা দেবে। আমাদের অর্থনীতির চাকা ঘোরাবে। নববর্ষে আমরা গাইতেই পারি—তোরা সব জয়ধ্বনি কর, ওই নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়। কিন্তু আমরা যেন ঐক্যের কথা, মিলনের কথাই প্রচার করি। বিভেদের কাঁটা যেন আমরা বিছিয়ে না রাখি। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিদ্বেষের প্রচার, ঘৃণার প্রচার দেখলে মনটা আঁতকে ওঠে। আমরা কি এসব মাধ্যমকেও মেলা আর মেলানোর জন্য ব্যবহার করতে পারি না?

আমরা কি বলতে পারি না—

বন্ধু হও, শত্রু হও,         যেখানে যে কেহ রও,   

      ক্ষমা করো আজিকার মতো    

          পুরাতন বরষের সাথে 

          পুরাতন অপরাধ যত।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক