শেষ ভরসা সূর্য

.
.

বাঁচতে হলে আমাদের সূর্যের দিকে তাকাতে হবে, সূর্যের সাহায্যই নিতে হবে। এক সকালে ড. সাজেদ কামাল যখন এভাবে বলেন আমাদের, আমরা কেউ দ্বিমত করতে পারিনি। তিনি সুফিয়া কামালের পুত্র, সুলতানা কামালের সহোদর। কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর নিজেরই রয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতি। এ বিষয়ে তিনি আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাও করছেন বহু বছর ধরে।
তবে সাজেদ কামালের বক্তব্য বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। সারা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা এখন একবাক্যে এসবই বলছেন। কেন বলেছেন তার সরল ব্যাখ্যাও রয়েছে। তা হচ্ছে, আমরা যেসব অনবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে থাকি, তা খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা একমত যে জ্বালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও ইউরেনিয়ামের মজুত আগামী ৫০ বছর এবং কয়লার মজুত আগামী ১৫০ বছরের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যাবে। পৃথিবীতে কোনো কোনো দেশের সামনে পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে বটে, কিন্তু তা ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ, দুর্ঘটনাপ্রবণ ও ব্যয়বহুল। তা ছাড়া বিশ্বে বর্তমানে থোরিয়াম-নির্ভর যেসব পারমাণবিক জ্বালানি প্রকল্পগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলো চালু করতে গেলেও কিছুটা ইউরেনিয়ামের প্রয়োজন হয় বলে এটিও কোনো বিকল্প জ্বালানির উৎস হতে পারছে না।
জ্বালানি না থাকলে আমরা কীভাবে চলব? জ্বালানির অভাবে শুধু যানবাহন বা শিল্পকারখানা চলবে না তা নয়, আমাদের প্রাত্যহিক ব্যবহার্য সবকিছুর উৎপাদন মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে, আমাদের গার্হস্থ্য জীবন বিপন্ন হবে, মানুষকে ফিরে যেতে হবে এক আদিম জীবনব্যবস্থায়। কিন্তু মানুষের সে রকমভাবে জীবন যাপন করার কিংবা অন্য সব জীব ও উদ্ভিদের শুধু নিশ্বাস নেওয়ার মতো একটি বিশ্বও কি তখন থাকবে আর? আশঙ্কা হচ্ছে, সেটিও তখন থাকার কথা নয়। অনবায়নযোগ্য জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি ব্যবহার অব্যাহত থাকলে বৈশ্বিক উষ্ণতা আগামী কয়েক দশকে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাবে যে পৃথিবীর অস্তিত্বই তখন মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।

এসব হুমকি বাস্তব, কিন্তু তা মোকাবিলার উপায় ও সুযোগ আমাদের রয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির এক অফুরন্ত ভান্ডার রয়েছে আমাদের সামনে। তা হচ্ছে সূর্য, আমাদের সৌরজগতের সব শক্তির উৎস যে সূর্য। ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরের সূর্য থেকে এর বিকিরিত শক্তির কয়েক শ কোটি ভাগের এক ভাগ মাত্র পৃথিবীর বুকে এসে পড়ে। কিন্তু তারপরও এই সূর্য থেকে প্রতি ঘণ্টায় যে শক্তি পৃথিবীতে আসে, তা দিয়ে পৃথিবীর এক বছরের সব জ্বালানির চাহিদা মেটানো সম্ভব।

সোলার এনার্জি বা সৌরশক্তি পৃথিবীতে আলো, উত্তাপ, বাতাস, পানিপ্রবাহ ও ফটোসিনথেসিস—মূলত এই পাঁচ নবায়নযোগ্য প্রক্রিয়ায় সঞ্চালিত হয়। পৃথিবীকে অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে আমাদের এসব শক্তির ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। তেল, গ্যাস, কয়লার ব্যবহার ক্রমান্বয়ে কমিয়ে একপর্যায়ে বন্ধ করতে হবে। বন ও জলাভূমির পরিমাণ বহুলাংশে বাড়াতে হবে। এসব কিছুই অসম্ভব নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে মানুষের যথেষ্ট উদ্বেগ থাকলেও করণীয় বিষয় এবং এর বৈশ্বিক কর্মকৌশল নিয়ে রাষ্ট্রসমূহের যথেষ্ট ঐকমত্য নেই।

গত বছর জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত প্যারিস চুক্তি সম্পাদনকালে এবং এর আগে প্রায় এক যুগ ধরে এ নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি অবশেষে ঢিলেঢালা ধরনের হলেও প্যারিস চুক্তির মতো একটি ব্যাপকভিত্তিক ঐকমত্যে আসতে পেরেছে। এই চুক্তি আশাতীত দ্রুততার সঙ্গে কার্যকরও হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কি যথেষ্ট?

প্যারিস চুক্তি গ্রহণ করা হয় ১২ ডিসেম্বর ২০১৫। এটি কার্যকর হওয়ার জন্য দুটো শর্ত ছিল। এ জন্য কমপক্ষে ৫৫টি দেশের অনুসমর্থন (রেটিফিকেশন) প্রয়োজন ছিল। কিন্তু একই সঙ্গে প্রয়োজন ছিল মোট গ্রিনহাউস গ্যাসের অন্তত ৫৫ শতাংশ উৎপাদনকারী দেশগুলোর অনুসমর্থন। চীন, আমেরিকা, ব্রাজিল, ভারতের মতো বিপুল জ্বালানিশক্তি ব্যবহারকারী দেশগুলোর অনুসমর্থনের (এবং একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুসমর্থন) কারণে এ দুটো শর্ত দ্রুত পূরণ হয়ে যায় এ বছরের ৫ অক্টোবর। ফলে এই চুক্তি অনুসমর্থনকারী দেশগুলোর জন্য (এখন পর্যন্ত ৮৩) ৪ নভেম্বর ২০১৬ সাল থেকেই কার্যকর হবে। ধারণা করা হচ্ছে যে আগামী বছর মারাক্কেশে প্যারিস চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর সম্মেলনের আগেই বাদবাকি অধিকাংশ দেশ (মোট ১৯৬) এই চুক্তিটির পক্ষরাষ্ট্রে পরিণত হবে। কিন্তু তাই কি যথেষ্ট হবে?

প্যারিস চুক্তিটি পূর্ববর্তী ১৯৯৭ সালের কিয়েটো প্রটোকলের উত্তরসূরি। কিয়েটো প্রটোকল শুধু শিল্পোন্নত দেশগুলোকে কার্বনসহ অন্যান্য বৈশ্বিক উষ্ণতা সৃষ্টিকারী গ্রিনহাউস কমানোর বাধ্যবাধকতা তৈরি করেছিল। অন্যদিকে প্যারিস চুক্তিতে বিশ্বের সব দেশকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন (এমিশন) কমানোর দায়িত্ব অর্পণ করেছে। তবে কিয়েটো প্রটোকলে যেখানে ১৯৯০ সালের তুলনায় গড়ে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ এমিশন কমানোর লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিল এবং এর লঙ্ঘন হলে ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত হারে কমানোর শাস্তির বিধান করেছিল, প্যারিস চুক্তিতে এ ধরনের কিছু নেই।

প্যারিস চুক্তিতে বরং প্রতিটি দেশকে স্বেচ্ছায় নিজের এমিশন কমানোর লক্ষ্যমাত্রা এবং এর কর্মকৌশল নির্ধারণের (ইনটেনডেড ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন—সংক্ষেপে আইএনডিসি) বাধ্যবাধকতা তৈরি করা হয়েছে। এতে সম্মিলিতভাবে শিল্পবিপ্লব-পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৫ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (ওয়েল-বিলো ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস) পর্যন্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি অনুমোদন করা হয়েছে (গ্রিনহাউস গ্যাস এমিশন বৃদ্ধি ১৯৯০ সাল থেকে অব্যাহত থাকলে এটি এমনকি ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারত)। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রতিটি দেশের গ্রিনহাউস এমিশন ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্য মাত্রায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। শূন্যমাত্রা বা নেট জিরো এমিশনের মূল কথা হচ্ছে এ সময়ে প্রতিটি দেশ ততটুকুই গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপন্ন করতে পারবে, যা তার নিজস্ব বন, জলাশয় প্রভৃতি প্রাকৃতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ধারণ করে নিতে পারবে।

প্যারিস চুক্তির মূল দুর্বলতা হচ্ছে এটি সম্পূর্ণভাবে সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। প্রতিটি দেশের আইএনডিসি অন্য সব দেশের সঙ্গে শেয়ার করা এবং নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে এটি প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো দিয়ে নিরীক্ষণ এবং সে অনুসারে সংশোধনের দায়দায়িত্ব এতে রয়েছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর দায়দায়িত্ব রয়েছে অন্যান্য দেশকে তার আইএনডিসি অনুসারে দায়িত্ব পালনে আর্থিক, প্রযুক্তিগত ও কৌশলগত সহায়তা প্রদান করার। কিন্তু আইএনডিসি বা সংশোধিত আইএনডিসি অনুসারে প্রতিটি দেশকে এমিশন কমাতেই হবে, এটি শক্ত করে প্যারিস চুক্তিতে বলা নেই। এখন পর্যন্ত যে দেড় শতাধিক আইএনডিসি জমা পড়েছে, তা সত্যি সত্যি পালন করা হলে প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা (২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপ বৃদ্ধি) শতাংশ অর্জিত হবে, তারও নিশ্চয়তা নেই।

তবে বিশ্বের জাতিসমূহের সদিচ্ছা থাকলে তারপরও প্যারিস কাঠামোর মধ্যেই বিশ্বকে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি থেকে বহুলাংশে মুক্ত করা সম্ভব। সংশোধিত আইএনডিসিতে আরও উঁচু লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়ে এবং সুনির্দিষ্ট কর্মকৌশল গ্রহণ করে এমনকি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা না বাড়তে দেওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যমাত্রা পর্যন্ত অর্জন করা সম্ভব।

সদিচ্ছা থাকলে কীভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস এমিশন দ্রুতবেগে কমিয়ে আনা যায়, এর একটি বাস্তব উদাহরণ দেখা যায় চীনের ২০০৮ সালের অলিম্পিকের সময়। বেইজিং এ সময় একটি উচ্চমাত্রায় কার্বন এমিশনকারী শহর ছিল বলে তা অ্যাথলেটদের স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগ সৃষ্টি করছিল। চীনের এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি এ অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণের জন্য প্রাইভেট গাড়ির ওপর নিয়ন্ত্রণ (জোড় সংখ্যার গাড়ি এক দিন, বিজোড় সংখ্যার অন্য দিন চালানোর অনুমতি দিয়ে), উচ্চমাত্রার দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পগুলো বন্ধ করে দিয়ে, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বহুমাত্রায় বৃদ্ধি করে এবং প্রচুর বনায়ন করে দূষণ দ্রুতগতিতে কমিয়ে আনে। দীর্ঘ মেয়াদে সৌরশক্তির মতো নবায়নযোগ্য ও দূষণমুক্ত প্রযুক্তির ওপরও চীন বেশি করে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করে এ সময় থেকে।

চীন পরিবেশ বিষয়ে তুলনামূলকভাবে কম সচেতন একটি দেশ হিসেবে পরিচিত। সেই চীনই তাদের আইএনডিসিতে ২০৩০ সালের পর থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস এমিশন ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে ২০০৫ সালের তুলনায় গ্রিনহাউস গ্যাস এমিশন ৬০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা করেছে।

চীনের তুলনায় ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের লক্ষ্যমাত্রা আরও উঁচুতে। কিন্তু চীনের মতো শিল্পোন্নত প্রতিটি দেশই এখন বুঝতে পেরেছে, উন্নত প্রযুক্তি ও উন্নয়ন কর্মকৌশলের মাধ্যমে শুধু তেল, গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে বা ব্যাপক বনায়ন করে গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে না। এটি করতে হলে ব্যাপকভাবে সৌরশক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে। চীন আগামী ৫০ বছরের মধ্যে অন্তত ৩০ ভাগ সৌরশক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে, জার্মানি ২০৩০ সালের মধ্যেই শতভাগ নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে, সৌদি আরবের মতো অতি দূষণকারী দেশ সৌরশক্তির ওপর এখন সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। সারা পৃথিবীর নেতৃস্থানীয় বহু ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন-সহযোগী ও বেসরকারি সংস্থা সৌরশক্তিসংক্রান্ত প্রকল্পে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে।

প্রশ্ন আসে, এমন এক সময়ে আমরাও কি সূর্যের দিকে তাকাতে পারি না, সূর্যের কথা ভাবতে পারি না? সূর্যস্নাত এ দেশে আমরা কি সুন্দরবন উজাড় করার মতো দূষিত কয়লাশক্তি প্রকল্পের বদলে অন্য কিছুর চিন্তা করতে পারি না? সারা দেশকে নবায়নযোগ্য সৌরশক্তি ব্যবহার করে সমৃদ্ধ করতে পারি না?

সাজেদ কামালের মতো বহু বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে কাজ করছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। আমাদের সরকার কি তাঁদের ডেকে তাঁদের কথা একবার শুনতে পারে?

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়