শোকের মাসে এরশাদের ঢিলতত্ত্ব

আগস্ট শোকের মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপালিত ও সামরিক পোশাক পরিহিত কতিপয় দুর্বৃত্ত বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। পরবর্তীকালে এই দুর্বৃত্তরা ক্ষমতা টেকসই করতে না পারলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে যে ভয়াবহ ক্ষত সৃষ্টি করেছে, তার দায় এখনো গোটা জাতি বয়ে চলেছে। ১৫ আগস্টের পর হারিয়ে যাওয়া ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি শেখ হাসিনা ফিরিয়ে আনতে পারলেও রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি পুনর্বহাল করতে পারেননি। রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা একসঙ্গে চলতে পারে না। যেমন একসঙ্গে চলতে পারে না গণতন্ত্র ও স্বৈরাচার।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনই দেশ পরিচালনার একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কুচক্রীরা প্রথম বন্দুকের নলে ক্ষমতা দখল করে জনগণের ওপর জবরদস্তির শাসন চাপিয়ে দেয়, পরবর্তী দেড় দশক হত্যা, অভ্যুত্থান, বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রই হয়ে ওঠে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রধান হাতিয়ার। নব্বইয়ে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন হলেও তাঁর শাসনামলের সব অনাচারই আবার জেঁকে বসেছে।
আগস্ট একই সঙ্গে আমাদের শোক ও আত্মোপলব্ধির মাস। এই মাসে বাংলাদেশ স্বাধীনতার মহানায়ককে হারিয়েছে। ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায়ই জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়। আর এ কারণে আত্মোপলব্ধির প্রয়োজন যে, সেদিন শত্রু-মিত্র চিনতে ভুল করেছিলাম। আমরা ইতিহাসের ট্র্যাজেডি রুখতে পারিনি। এই ব্যর্থতা কেবল আওয়ামী লীগের নয়, যারা আওয়ামী লীগের চেয়ে উন্নত শাসন দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল, তাদেরও। পঁচাত্তর-পূর্ব রাজনীতিতে যত সংঘাত-বিরোধই থাকুক না কেন, রাজনীতিটা রাজনীতিকদের হাতে ছিল। কিন্তু পরবর্তী রাজনীতি যে রাজনীতিকদের হাতে নেই, তার প্রমাণ আজকের সংসদ ও আজকের বিরোধী দল।
সহকর্মী সেলিম জাহিদ ঠিক জায়গাটিতেই আঘাত করেছেন। তিনি গত বুধবার প্রথম আলোতে লিখেছিলেন, ‘চতুর্মুখী ঢিল ছুড়ছেন এরশাদ’। আর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন এই সাবেক স্বৈরশাসক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ক্ষমতা দখলের নানা তত্ত্ব আছে। বাংলাদেশের নব্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরশাদ ঢিলতত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তিনি ঢিল ছুড়ে একবার ক্ষমতায় এসেছিলেন। বন্দুকের নল থেকে উৎসারিত সেই ঢিল বহু ছাত্র-তরুণের প্রাণ নিয়েছে। বহু রাজনীতিককে কারাগারে পাঠিয়েছে। বহু নারীর জীবনকে করেছে দুর্বিষহ। জিয়াউর রহমানের শুরু করা কেনাবেচার রাজনীতি তাঁর আমলে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। শিল্পী কামরুল হাসান তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘বিশ্ববেহায়া’। বিশ্ববেহায়া থেকে এখন তিনি বিশ্বদূতে পরিণত হয়েছেন গণতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রীর বদৌলতে।
নব্বইয়ে গণ-অভ্যুত্থানের সময়ও এরশাদ সেনাবাহিনীতে ঢিল ছুড়ে ক্ষমতা আরও দীর্ঘস্থায়ী করার কোশেশ করেছিলেন। লে. জেনারেল নূরউদ্দিন খানের অনড় ভূমিকার কারণে তাঁর সেই চেষ্টা সফল হয়নি। এরপর ১৯৯৬ সালে সংসদে কেউ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে ফের তিনি দুই দলের সঙ্গে দর-কষাকষি করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে সহায়তা করলেও মধুচন্দ্রিমা স্থায়ী হয়নি। পরে এরশাদ বিএনপির সঙ্গে মিলে চারদলীয় জোট করেন। ২০০৭ সালে ফের আমরা তাঁর দ্বিচারী ভূমিকা দেখতে পাই। একবার তিনি বাবর-তারেকের সঙ্গে ডাল-ভাত খান। আরেকবার শেখ হাসিনার প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন ঘোষণা করেন।
এরশাদ ঢিলতত্ত্বের নিকৃষ্টতর উদাহরণ দেখান ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের আগ মুহূর্তে। তিনি দলের একাংশকে বলেন, ‘নির্বাচন করো,’ অপরাংশকে পরামর্শ দেন ‘নির্বাচন বর্জন’ করার জন্য। কয়েক মাস ঝানু দাবাড়ুর মতো দুই দিকেই চাল দিয়ে যাচ্ছিলেন এই একদা উর্দিধারী রাজনীতিক। শোনা যায়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের সঙ্গে টাকার অঙ্ক ও আসনসংখ্যা নিয়ে দর-কষাকষির মাঝখানে রাজনৈতিক অসুখে তাঁকে সিএমএইচে ভর্তি হতে হয়। বিনিময়ে নির্বাচন না করেও তাঁর দল ৩৪টি আসনে জয়ী হয় এবং জাতীয় পার্টিতে বিএনপিপন্থী বলে পরিচিত রওশন এরশাদ হন বিরোধী দলের নেতা।
এরশাদ সংসদে ও সংসদের বাইরে নিয়ত পরস্পরবিরোধী কথা বলে চলেছেন। কখনো সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার কথা বলেন, কখনো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
কয়েক দিন আগে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, এই সরকারের আর ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার অধিকার না থাকলেও তাঁর বিশেষ দূত থাকার পূর্ণ অধিকার রয়েছে এরশাদের।
রাজনৈতিক ভণ্ডামি আর দ্বিচারিতা কাকে বলে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]